Humairah Hasan: হুমাইরা হাসান

Humairah Hasan: হুমাইরা হাসান

ছন্দময়ীর কল্পকথা 🍁

Humu_🖤

04/01/2024

#ইন্দ্রজাল
#পর্বসংখ্যা_১৬
#হুমাইরা_হাসান
____________________

- এই আফজাল জাল খবর দেয়না স্যার। আমি যা বলতেছি একদম শিওর। অন্যান্য দিন আমি নয়টার পরেই বেরিয়ে যায়, ওদিন একটা বেওয়ারিশ লাশ এসেছিল। কোনো খোঁজ খবর ছিলো না বলেই আমায় ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল।

আফজাল যথাসম্ভব ফিসফিসিয়ে বলতে চাইলেও ওর কণ্ঠস্বর বেশ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে আশেপাশে। সেসবের তোয়াক্কাও করলো না অবশেষে। মেঘালয় মনোযোগী শ্রোতার মতো ওর কথাগুলো শুনছে আর ফাইলের একটা একটা করে পৃষ্ঠা ওলটাচ্ছে। পুরো ফাইলটা ঘেটে ফের এসে থামলো সেপ্টেম্বরের ষোলো তারিখ। ওদিন হসপিটালের মর্গে মোট চারটা লাশ ঢুকেছে। তিনজন পুরুষ, একটা বাচ্চা। পুরুষ তিনজনের একটা অ্যাক্সিডেন্ট। আর যেটা অ্যাক্সিডেন্টের কেস ওই সারিতেই আহসান মির্জার সিগনেচার। অর্থাৎ ওটাই ছিলো তাঁর ছেলে রাফসান।

- লাশটাকে এখান থেকে রিলিজ করে নিয়েছিল কয়টা নাগাদ?

- স্যার মনে হয় দশটার একটু আগে নয়তো পরে।

মেঘালয়ের কপাল জড়ো হলো, তীক্ষ্ণ চোখে আফজালের মুখের দিকে তাকালো। পান খাওয়া লালচে দাঁত গুলো ক্রমশই ঢাকা পড়লো অপ্রতিভ থমথমে ঠোঁটে। মুখাবয়ব স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টায় আফজাল মেকি হেসে বলল,

- স্যার বহুত ক্ষণ খাড়াই আছিলাম। তাই একটু এক নম্বর সারতে…

মেঘালয় ফোন বের করে পৃষ্ঠার একটা ছবি তুলে নিলো। আফজালকে জিগ্যেস করলো,

- লাশটার অবস্থা কেমন ছিলো? দেখে কী মনে হচ্ছিলো?

আফজাল মুখটা বিকৃত করে বলল,

- গাড়ি নিয়েই খাদে পড়ছিল মনে হয়, চেহারা আর চেনার মতো ছিলো না। পরনের কাপড়েও রক্ত, ধুলায় মাখামাখি। তাও অর্ধেক ছেড়া।

- তাহলে বডি আইডেন্টিফাই কীভাবে করেছিলো?

- ব্লাড টেস্ট করছিলো স্যার। আর অ্যাক্সিডেন্ট প্লেসে যে গাড়িটা ছিলো ওটা মির্জা বাড়ির। ওনারা এসে নিজেরাই চিনে নিয়ে গেছিলো বডি।

মেঘালয়ের কেমন একটু অদ্ভুত ঠেকলো কথাটা। বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

- শুধু ব্লাড টেস্টের ভিত্তিতে শিওর হলো এটা কেমন লজিক!

- চুলের ডিএনএ টেস্ট ও করিয়েছিলো মনে হয়। আমারে ডাক্তার একটা ওষুধ আনতে দিছিলো কার্ডিয়াক পেশেন্ট এর জন্য, অনেকক্ষণ ধরেই ডিউটি করছিলাম তাই ওষুধ নিয়ে একটু কাজ সেরে আসতে দেরি হয়েছিলো আমার। আমি যতক্ষণে এসেছিল ওরা চলে গেছিলো।

মেঘালয়ের নিশ্চুপ অবস্থাটা বহাল থাকলেও আফজাল ফের বলল,

- এই খবরটা আপনাকে আমার চেয়ে ভালো রুহুল দিতে পারবে।

- রুহুল কে?

- ড্রাইভার। এসব অ্যাক্সিডেন্ট কেসের বডি আনা আর তা বাড়ি অব্দি পৌঁছানো ওর’ই কাজ। কেসের ডিটেইলস ডাক্তারের চেয়েও ওয় ভালো কইতে পারে।

মেঘালয় বেশিক্ষণ কথা বাড়ালো না। আফজাল ফোন করেছিলো বেশ কয়েকদিন আগে, তবে অত্যাধিক ব্যস্ততায় ও আসতে একটু দেরি করে ফেলেছে৷

…………

বেলা নয়টা গড়িয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। শীতের নরম রোদের একাংশ গায়ে মেখে রাস্তার ধারের ছোট একটা বেঞ্চিতে বসে আছে সুমু। হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোন বের করে দ্বিতীয় বারের মতো সময় দেখে রাখলো। নয়টা বেজে চৌদ্দ মিনিট হয়ে গেলো অথচ কারো আসার নাম নিশানা নেই। মনটা কেমন থিঁতিয়ে এলো, মুখের চঞ্চলতায় ভাঁটা পড়লো। অল্পতেই অনেকটা ভেবে ফেলা মস্তিষ্ক মানুষটা আসবে কি না এই ভেবে নিজেকেই দ্বিধাবোধে জড়িয়ে ফেললো। বুকের ভেতর কেমন ভোঁতা যন্ত্রণা অনুভব করালো। ভাসা ভাসা চোখ দু'টোকেও টইটম্বুর করে ফেললো। দুঃখ, ক্ষোভ দুটোর সংমিশ্রণে একাকার হয়ে ধপ করে উঠে দাঁড়ায়। বাঁ দিকটা ধরে হাঁটা শুরু করলে দুই থেকে তিন কদম এগোতেই একটা ডাক কানে আসে,

- সুমু!

ভীষণ প্রত্যাশিত,অপেক্ষারত কণ্ঠে ভেতরের রাগ আর দুঃখ গুলো উগড়ে আসতে চাইলো৷ তবুও তাকে প্রাণপণে দমিয়ে হাঁটতে নিলে পেছন থেকে খপ করে হাতটা কেউ মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। উক্ত হাতের মালিক হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,

- কোথায় যাচ্ছ, ডাকছিতো!

সুমু জবাব দেয়না, নাইবা তাঁর দিকে চোখদুটি মেলে চায়। গোলগাল মুখটার থমথমে দৃশ্যটা দেখে আগন্তুকের মনটা কুণ্ঠিত হয়। ইশ বেশিই দেরি করে ফেলেছে বোধহয়! ধ্রুব সুমুর দুবাহু ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,

- দেরি করে ফেলেছি তাই না! স্যরি সুমু।

সুমুর চোখদুটো ভরে আসে৷ নিজের এই স্বভাবটাতে ব্যাপক বিরক্তি ওর, তবুও কিছুতেই এই অভিমান সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেলার ব্যাপারটাতে নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনা। আবারও কানে এলো ওর প্রিয়পুরুষের কণ্ঠ,

- রাগ করেছ? আর এমন হবেনা সত্যি।

ছলছল চোখদুটি তাঁর চূড়ান্ত নির্লজ্জতা দেখিয়ে সুরসুর করে গড়িয়ে দিলো দু ফোঁটা অশ্রু। ধ্রুব সুমুর নতজানু মুখটায় অশ্রুর অস্তিত্ব দেখে অস্থির হয়ে বলে,

- এই সুমু! কাঁদে না প্লিজ, আমি সত্যিই আর কক্ষনো দেরি করবো না৷ রাতে ফিরতে অনেক দেরি হয়েছিলো। জার্নি করে টায়ার্ড ছিলাম সকালে অ্যালার্ম বেজে গেছে টের পাইনি। তুমি কেঁদোনা প্লিজ!

সুমুর মুখের কাছে ঝুঁকিয়ে আনা ধ্রুবের মুখে চোখ দু'টো আঁটকে যায় ওর ঝাপসা দৃষ্টিতে ৷ মায়ামায়া মুখটা গুনে গুনে এক বছর তিনমাস পর দেখছে। এতগুলো দিন পর এলো লোকটা আর ও রাগ করে চলে যাচ্ছিল! নিজের করা নিষ্ঠুর কাজ আর ধ্রুবের এমন অসহায় দুঃখপ্রকাশে সুমুর কান্না থামার পরিবর্তে আরও বেড়ে যায়। ধ্রুব চোখ মুছিয়ে দেয় সুমুর, ভালোবাসার মানুষটার এমন উৎকণ্ঠিত চেহারা আর যত্নে কোমলমতি নারীমনটা আরও ফুঁপিয়ে ওঠে। নিজের অনবরত কান্নায় নিজেই বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে আকস্মিক ভাবে সুমু ধ্রুবের বুকে হামলে পড়ে। ধ্রুব আকস্মিকতায় বিস্মিত হয়, অপ্রস্তুত হাতটা আলতো করে ছোঁয়ায় সুমুর পিঠে। দ্বিধাদ্বন্দে মুনের কুঠুরি নড়বড়ে হয়ে ওঠে, মেয়েটা ওর চোখে তাকাতেও লজ্জা পায় এখন অব্দি সে কী না এমন আগাম বার্তা হীনা জড়িয়ে ধরলো! ধ্রুব আলতো হেসে আগলে নেয় সুমুকে। তবে ধ্রুব ধাতস্থ হলেও সুমু যে এমন ভয়ংকর কাজটা করে ফেললো সেটা সামাল দেবে কীভাবে এই ভেবে ফের ওর কান্না পায়। এমন রাস্তার মাঝে জড়িয়ে ধরার মতো কাজটা কীভাবে করতে পারলো। আলগোছে সরে আসে সুমু, পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার কোনো খেঁই না পেয়ে বলে,

- আম্ … আমি যাচ্ছি।

ধ্রুব শক্ত হাতে ওর কবজি চেপে নেয়।

- কোথায় যাচ্ছ? দেখাটাই তো ঠিক করে হলো না।

সুমুর মুখটা নামিয়ে নেয়। এমন নির্লজ্জের মতো কাজটা করে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকার মতো কাজটা ওর কাছে যুদ্ধ সমান লাগছে। কোনো মতে আমতা-আমতা করে বলে,

- ম্ মানে। কাল দেখা করবো।

- চুপ। চলো আমার সাথে।

ধ্রুব ওর হাতটা ধরে এগিয়ে চলে। মেয়েটা কী ভীষণ লজ্জা পেয়েছে তা ও নিজেও আঁচ করতে পারে৷ নিতান্তই ভদ্র ছেলের তকমাটার যথার্থতা খাটিয়ে সুমুকে আর ব্যতিব্যস্ত করে না।
একটু খানি পথ, দুজনে নিঃশব্দেই পেরোলো। গন্তব্যের কাছাকাছি এসে ধ্রুব বলে,

- আজ স্কুল ছিলো না?

- যাইনি।

ধ্রুব বুঝে নেয় প্রিয়তমা তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়ার উৎকণ্ঠায় নিজের চাকরিতেও অবহেলা করে ফেলেছে। আর সেই কিনা দেরি করার মতো অন্যায় টা করে ফেলল! ভীষণ ভুল করে ফেলেছে, এর মাশুলে কিছু তো করতেই হয়! হাঁটতে হাঁটতে বাগানবিলাস গাছের কাছটায় এলে হাতটা উঁচিয়ে কয়েকটা পাপড়িযুক্ত একটা ছোট অংশ ছিড়ে নেয়। সুমুকে দাঁড় করিয়ে ওর কানে গুঁজে দিয়ে বলে,

- অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত সাহেবা, আশা করি এইবার স্যরি গ্রহনযোগ্য হবে!

সুমু হেসে ফেলে। আঙুলের ভাঁজে জড়ানো গোলাপি ওড়নাটা চেপে ধরে। বুকের ভেতর কেমন উথাল-পাথাল ঝড় উঠেছে। কতগুলো দিন পর ধ্রুবকে নিজের এতটা কাছে পেলো, এতগুলো দিন কতই না অপেক্ষা করেছে মানুষটাকে সামনে পাওয়ার জন্য।

………….

- কঙ্গ্রাচুলেশন্! গান রেকর্ডের সব কাজ শেষ, এখন শুধু এডিট আর রিলিজের পালা। আই হোপ, আমার মতো দর্শকেরও নিউ স্টারকে পছন্দ হবে।

নিবিড় স্মিত হাসে। আজ ওর ফাইনাল রিচেইক ছিলো। বেশ কয়েকদিন ধরেই গানটার জন্য কাজ করে যাচ্ছে ও। প্রথমেই এতো বড় অথোরিটির সাথে কাজ আর তা ঠিকঠাক করতে পারার নার্ভাসনেস বারবার ভুল করিয়ে দিচ্ছিলো ওকে। কিন্তু লিটন সাহেব যে ওকে এতটা আন্তরিক ভাবে সবটা বোঝাবে সেটা ওর জন্য অনেক বড়ো একটা সুবিধা। কাজটার শুরু থেকে দ্বিধাবোধ আর জড়ত্বের বেরিবাঁধে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছিলো। আজ হালকা লাগছে ভীষণ। সকাল করেই লিটন সাহেবের কল পেয়ে বেশ ঘাবড়ে গেছিলো। এখানে এসে যখন জানতে পারলো গানের রেকর্ডিং টা খুব পছন্দ হওয়ায় আর অপেক্ষা না করে সকাল করেই ডাক পাঠিয়েছে ওকে তখন যেনো বুকের ওপর থেকে খুব বড় একটা বোঝা সরে গ্যাছে।

- বেস্ট অফ লাক্!

লিটন সাহেবের বাড়িয়ে দেয়া হাতে হাত মিলিয়ে নিবিড় কৃতজ্ঞচিত্তে মাথা নাড়িয়ে বলল,

- অল থ্যাংকস টু ইউ স্যার। আপনি না থাকলে আমার পক্ষে এতবড় কাজটা করা সম্ভব হতো না।

- ইটস্ অল অ্যাবাউট ইও’র ট্যালেন্ট। এমন হিডেন জেম কে নিয়ে কাজ করতে পেরে আমি খুশি।

সেটের প্রত্যেকে অভিবাদন জানায় নিবিড়কে। ইতঃমধ্যে অনেকের সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছে। অন্যান্য ওয়ার্কার্স এক এক করে বেরিয়ে গেলেও লিটন সাহেব নিবিড়কে ধরে রাখলেন। ওকে নিজের সাথে ওপরতলায় নিজের ঘরে নিলো সাথে করে। ভেতরে ঢুকেই হাঁক ছেড়ে ডাকলেন স্ত্রী’কে,

- নুপুর আর নুপুরের আম্মু কোথায়! দ্যাখো কাকে এনেছি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন মাঝবয়েসী আর তাঁর সাথে অল্পবয়সী একটা মেয়ে এলো। মহিলা সুহাস্য মুখে এগিয়ে এলে লিটন সাহেব বললেন,

- ও হলো নিবিড়। আজই আমাদের গানের কাজ শেষ করেছি।

- তুমিই নিবিড়! নুপুরের বাবা প্রায়ই তোমার কথা বলে, কেমন আছো বাবা?

- আলহামদুলিল্লাহ আন্টি৷ ভালো আছি।

মহিলা বেশ অভিমান দেখিয়ে বললেন,

- সেই কবে থেকে বলছি তোমার সাথে দেখা করিয়ে দেওয়ার কথা। একই বাড়িতে কাজ করতে আসো অথচ এতদিনেও দেখা হয়নি ভাবা যায়!

নিবিড় সৌজন্য বজায় রেখে হাসে৷ লিটন সাহেব আয়েসি ভঙ্গিমায় বসে নিবিড়কে তাঁর পাশে বসতে বলে সহধর্মিণীকে বললেন,

- এই যে আজ এনেছি। আজ নিবিড় আমাদের সাথে ব্রেকফাস্ট করবে যাও খাবার রেডি করো।

- স্যা..

নিবিড়কে আগেই থামিয়ে দিয়ে লিটন সাহেব বললেন,

- না কথাটা আজ থাক নিবিড়।

অগত্যা নিবিড়কে থাকতে হলো৷ পুরোটা সময় লিটন সাহেব আর তার মিসেসের সাথে টুকটাক কথা বললেও নুপুর নামের মেয়েটা একটা শব্দও বলেনি। নিবিড় নিজেও সেদিকে ধ্যান দেয়নি। তবে প্রথম বার দেখে চেনাচেনা মনে হয়েছিলো। কথা না বললেও মেয়েটা একদৃষ্টে নিবিড়ের দিকেই তাকিয়ে ছিলো পুরোটা সময়, সেটা অন্য কেউ খেয়াল না করলেও নিবিড়ের চোখ এড়ায়নি। এভাবে কারো দৃষ্টির কেন্দ্রে থাকতে নিবিড়ের একবারেই ভালো লাগেনি। তাই কাজের দোহাই দেখিয়ে আধ ঘন্টা পরেই বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। পালক আজ যেতে বলেছিল ওর বাড়িতে। গেইট থেকে বেরিয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলো তখনই পেছন থেকে একটা কণ্ঠে ডাক এলো,

- এই যে!

নিবিড় ফিরে তাকালে নুপুরকে দেখে বেশ বিস্মিত হয়। নুপুর এগিয়ে এসে ফোনটা সামনে ধরে বলল,

- ফোনটাই তো রেখে আসছিলেন, এতো কিসের পারা!

নিবিড় নিজের ফোনটা ওর কাছে দেখে পকেটে হাত রেখে নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই হতবাক হলো। ফোনটাও তাড়াহুড়ায় রেখে আসছিলো। শুধু ক্ষীণ স্বরে বলল,

- থ্যাংকস।

রিকশা এসে দাঁড়ালে সহবত টুকু বজায় রেখে বিদায় জানানোর প্রয়োজন টাও মনে করলো না নিবিড়। ধপ করে উঠে বসলো রিকশাতে তবে এগোনোর আগেই নুপুর রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

- দেখেশুনে নিয়ে যেও মামা, আর ভাড়াটা ওনার থেকে নিও না। স্পেশাল গেস্ট।

- আইচ্ছা আফা।

রিকশাওয়ালা মহা আনন্দে টান দিলো৷ নিবিড় বেশ অবাক হলেও তেমন গা করলো না৷ রিকশা এসে থামলো পালকের অর্থাৎ রাফাতের বাড়ির সামনে। রিকশা থেকে নেমে পকেট থেকে মানিব্যাগ টা বের করতে নিলে তার অপেক্ষা না রেখেই রিকশাওয়ালা এগোতে নিলে নিবিড় বলল,

- আরে ভাড়াটা তো নিয়ে যাবেন!

- লাগবো না মামা, আফাই দিয়া দিবো।

বেশ রাগ হলো নিবিড়ের। পেছন থেকে বার কয়েক ডেকেও থামানো গেলো না লোকটাকে,যেনো কোনো হেলদোল নেই। একটা অল্পপরিচিত মেয়ে ওর ভাড়া দিয়ে দেবে ব্যাপারটা নিবিড়ের আত্মসম্মানে লাগলো। তবে এখন আর কিছু করার নেই দেখে ভোঁতা মেজাজে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। পালকের ঘরের সামনে এসে দরজাটা খোলা পেয়ে ঢুকতেই আদ্রিশ হুট করে এসে ওকে পেছন জড়িয়ে ধরে বলল,

- ব্রো দেরি করলি ক্যান!

নিবিড়ের ভোঁতা মেজাজটা নিমিষেই ফুরফুরে হয়ে গেলো। হাসিমুখে জবাব দেওয়ার আগেই সামনে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে এলো। বিচলিত স্বরে বলল,

- তুই এমন করে আছিস কেনো?

নিবিড়ের দৃষ্টি লক্ষ্য করে আদ্রিশ সামনে তাকিয়ে হুড়মুড়িয়ে ছেড়ে দেয় নিবিড়িকে। আপদ টাকে এখনি আসতে হলো!

- নিবি বেবি তুই ও!

নিবিড় বিব্রত চেহারায় আদ্রিশের দিকে একবার তাকিয়ে ফের আরশির দিকে তাকিয়ে বলে,

- আমিও কি?

- রাফাইত্তা আর আদ্রিইশশার মতো তুই ও! এ আমি মানতে পারছি না, খোদা!

আরশির অতিরঞ্জিত ন্যাকামো দেখে আদ্রিশ ক্ষেপে আশেপাশে তাকিয়ে একটা ফুলদানি হাতে তুলে ওর দিকে যেতে যেতে বলল,

- আজ আমি তোর কুৎসিত মাথাটা ফা টিয়েই ফেলব চুন্নি।

নিবিড় তড়িঘড়ি করে আদ্রিশকে থামালে আরশি সুযোগ বুঝে চট করে ওকে পাশ কাটিয়ে পালায়। আদ্রিশ বলে,

- নিবিড় ছাড় তুই। ওরে আজ আমি ধ্বংস করে ফেলবো। ওর জন্য টিকতে পারছিনা আমরা, ওর মতো একটা ভাইরাস আমাদের মাঝে থাকলে করোনার চেয়েও দ্রুত আমাদের বদনাম পাড়ায় পাড়ায় ছড়াবে।

চলমান।
❤️

01/01/2024

#ইন্দ্রজাল
#পর্বসংখ্যা_১৫
#হুমাইরা_হাসান
_____________________

- তোরে ভাগাড়ে যাইতে বললাম দেইখা তুই সত্যিই ভাগাড়ে আনলি ইতর!

দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে রাফাত বললেও আদ্রিশ জবাব দিলো না। জবাব দেওয়ার মতো অবস্থাটাও পাচ্ছে না। ড্রেনের উৎকট দুর্গন্ধের চোটে মুখ খুলতেও বাজে লাগছে। আদ্রিশের জবাব না পেয়ে রাফাত ওর পিঠে চিমটি কেটে বলল,

- কথা কস না ক্যান? তুই সরছিস না কেনো এখান থেকে, ওয়াক্! জঘন্য!

আদ্রিশ বহুকষ্টেও চুপ থাকতে পারলো না রাফাতের এরূপ আচরণে। এক হাতে মুখটা চেপে ধরে বলল,

- মুখটা বন্ধ করবি তুই? বকবক করেই যাচ্ছিস। কথা বলতে থাকলে তোর মুখেও দুর্গন্ধ ঢুকে যাবে।

- এখান থেকে চল তুই ভাই। নাড়িভুঁড়ি উলটে এলো আমার এই গন্ধে৷

সামনে থেকে যানবাহনের লাইন ছুটে গেলে আদ্রিশ খুব আলগোছে বেরিয়ে এলো ওখান থেকে৷ স্কুল থেকে খানিকটা দূরত্বে বাইকটা দাঁড় করিয়ে হা করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

- দম বন্ধ হয়ে গেছিলো৷

রাফাত শান্ত স্বরে বলল,

- তুই এখানে থামালি কেনো?

- ল্যায়লা যাহা ম্যায় ভি ওয়াহা..

বাইক থেকে নেমে চাবিটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল,

- তোকে যেতে বলছিনা৷ দুই মিনিট দাঁড়া আমি দশ মিনিটে আসছি।

- আমার চাবি দিয়ে যা।

রাফাতের পেছনের ডাক অগ্রাহ্য করে আদ্রিশ দৌড় ধরলো। রাফাত ধ্যাত্ বলে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলো। সবাই ওর বাইকটাকে আদৌও পেয়েছে টা কি! যে যেভাবে পারছে চাবি নিয়ে দৌড় দিচ্ছে। বিরক্ত হলেও কোনো উপায় না পেয়ে ফোনটা কানে ধরে বাইকের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

- নিব কোথায় তুই!

স্কুলের ছুটির ঘণ্টা বাজতেই আদ্রিশ গেইটের সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। একটু দূরে, সেদিন যেখানটায় দেখা হয়েছিল সেখানেই একটা মোটাসোটা মেহগনি গাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। একটা একটা করে মেয়ে বের হতে দেখছে আর তাঁদের মাঝে চশমা পরা একটা ভোলাভালা চেহারার মেয়েটার খোঁজ করে চলেছে।

- এইটা না, এইটাও না … উফ এইটাও না।

- তাহলে কোনটা?

হকচকিয়ে পেছনে ফিরে আরশির মুখটা দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আদ্রিশ। কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,

- তুই? তুই কে!

- আমি তোর ভাতার।

আদ্রিশ চ জাতীয় শব্দ করে বলল,

- আবিয়াত্তা মইরা যাম তাও তোর মতো চুন্নিরে বিয়াম না আমি আদ্রিশ। এখানে কোত্থেকে টপকেছিস সেটা বল।

আরশি গার্লস স্কুলের গেটের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বলল,

- আমি যেখান থেকেই আসি তুই এখানে কি করছিস?

আদ্রিশ স্কুল গেইটের দিকে তাকিয়ে দেখলো সব মেয়েরা বেরিয়ে গ্যাছে। ভীষণ রকম বিরক্ত হয়ে বলল,

- তুই ভাগাড় থেকে আই আর ভাগাড়ে যা আমার কোনো আসে যায় না। আপাতত এখান থেকে তুই সর।

আরশি গাট হয়ে বলল,

- জীবনেও না। তুই এখানে কি করছিস সেটা বল। আর রাফাত কোথায়? দুজনকে একসাথে এদিকে আসতে দেখেছি আমি।

- তুই আমাদের ফলো করছিলি?

আদ্রিশের সন্দিহান গলাতে সুর মিলিয়ে আরশি সগৌরবে বলল,

- অবশ্যই। তোদের হাবভাবে আমার প্রচুর সন্দেহ।

- এ্যাহ্ …এসেছেন উগান্ডার সর্দারী আমাদের সন্দেহ করতে। আমরা যেখানে ইচ্ছে যাবো তুই কে সেসব নজরে রাখার?

- আমি না তো কে রাখবে। দ্যাখ আদ্রিশ, আমি ইয়ার্কি করছি না। তুই সত্যি করে বল তো তোদের ভেতর কিছু চলছে?

কেমন অসহায় ছলছল দৃষ্টিতে চেয়ে আরশির বলা কথায় আদ্রিশের একটুও মায়া হলো না। বরং প্রচণ্ড রকম ক্ষেপে বলল,

- হ আছে। কিছু না বহুত কিছু আছে। তোর কি?

আরশি হতাশ চোখে বিমূর্ত নজরে আশাহত স্বরে কিছু প্রকাশ করবে, কিন্তু সে চেষ্টায় জল ঢেলে আদ্রিশ বলল,

- ওই যে দ্যাখ ওখানে আমার প্রেমিক দাঁড়িয়ে আছে। যা ওর কাছে গিয়ে জিগ্যেস কর গে ফোট্।

আঙুল উঁচিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাফাতকে দেখিয়ে দিলো যাকে আরশি এতক্ষণেও খেয়াল করেনি। কপালের ভাঁজ একবার সটান করে তো আরেকবার কুঁচকে নেয় আরশি। ওর যে মনোভাবটাকে আদ্রিশ খুব তাচ্ছিল্যের সাথে উড়িয়ে দিলো সেটাকে আরও দৃঢ়ভাবে মস্তিষ্কে গেঁথে নিয়ে বলল,

- তোকে আমার কসম। সত্যি করে বল।

আদ্রিশ আড়চোখে তাকালো। ওর মুখোভিব্যক্তির মতো করেই বিদ্রুপাত্মক হেসে বলল,

- তোর নামে কসম করে তো আমি জু য়া খেলতেও বইসা পরুম। এবার বল দিবি নিজের নামের কসম?

- তুই একটা নর্দমা, আফ্রিকান কীটপতঙ্গের সর্দার। গরুর দুর্গন্ধযুক্ত বিষ্ঠা। দূর হয়ে যা। খবরদার যদি আমার নামে কসম করেছিস, আমার এখনো বিয়ে হয়নি।

এটা বলে হনহন করে হাঁটা ধরলো। উদ্দেশ্য রাফাতের মাথাটা খারাপ করা। আদ্রিশ যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু তাতে কী! ওর ল্যায়লা কে তো দেখতে পেলো না। একটু এগিয়ে স্কুলের পাশের রাস্তায় এগোলো। দোকানের ভিড়ে কিছুক্ষণ ওর বাঁকা চোখের জহুরি নজরে চেয়ে যেনো আমাবস্যার চাঁদটা হাতে পেলো। উৎফুল্ল চিত্তে এগিয়ে গেলো সেদিকে।

- চড়ুই ছাড় না, পাঁচ টাকায় তো দিয়ে দে।

- তুই চুপ কর। দিয়ে দেবো মানে? পাঁচ টাকার দাম নেই? এটা কি ইনকাম করতে হয়না? নাকি রূপ দেখে দিয়ে দেয়? এক টাকাও বেশি দেবো না। পাঁচ টাকার কলম আমি কেনো দশ টাকা দিয়ে কিনবো!

চড়ুই আর শায়লার কথার মাঝে দোকানদার ফোড়ন কেটে বলল,

- পাঁচটা ট্যাকার জন্য এমন ঝগড়া করতাছেন ক্যা আফা। দিয়া দ্যান, আমরা গরীব কয়ডা ট্যাকা বেশি দিলে ক্ষতি কী?

- আপনি থামুন। আমি মোটেও বড়লোক নই। না আমার চাকরি আছে না জামাই, কোত্থেকে পাবো টাকা? আম্মুর স্বামীর থেকে চেয়েচিন্তে আনি।

নিজের মেকি অসহায়ত্বের বিপরীতে এমন উদ্ভট জবাব দোকানীর কিছুতেই প্রত্যাশিত ছিলো না। আধ টাক পড়া মাথায় হাত বুলিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। চড়ুই কলম টা ব্যাগে ভরে পাঁচ টাকা রেখে বলল,

- না সাইজে বড় করেছে না কালি বেশি করেছে কেনো দেবো বেশি দাম। এই ধরুন টাকা এর চেয়ে এক পয়সাও বেশি দেবো না।

- আফা আপনে দেখি দিনে দুপুরে ডাকাতি করতাছেন৷ এমনে জোর করে তো জিনিস নেয়া যাবে না।

- কীসের ডাকাতি আমি কী ফ্রি তে নিচ্ছি?

রীতিমতো তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেলো একচোট। শায়লা নাকের ডগা থেকে চশমাটা চোখের কাছে ঠেলে অসহায় চোখে তাকালো। এই মেয়েটার সাথে তার কীভাবে বন্ধুত্ব হয়েছিল তা ওর জানা নেই। যেখানে যায় ঝামেলা যেনো বস্তা ভরে সাথে নিয়ে চলে। এমন কোনো দিন নেই যে চড়ুইয়ের কারো সাথে ঝামেলা হলো না। স্কুলের দারোয়ান থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা পর্যন্ত সবার সাথেই ওর ঝগড়া নামক অভিজ্ঞতায় ষোলোকলা পূর্ণ।

- এই লায়লা!

পরপর দুবার ডাকটা কানে এলো শায়লার। প্রথমে মনের ভুল ভাবলেও এবার বেশ কাছ থেকে শোনা গেলো। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে কণ্ঠের মালিককে খোঁজার চেষ্টা করলো তখন পুনরায় কানে এলো,

- লায়লা! এদিকে।

এই সময়, এইখানে আদ্রিশকে একেবারেই আশা করেনি শায়লা। ভয়াতুর চোখে চড়ুইয়ের অবস্থান দেখে ফের তাকালো আদ্রিশের দিকে। ছেলেটা ওকে দূর থেকেই বারবার ইশারায় ডাকছে। শায়লা ভীত মুখ হাত উঁচিয়ে চড়ুই কে দেখিয়ে অসম্মতি দেখালেও আদ্রিশের বারংবার ডাকে এগিয়ে এলো৷ চড়ুই এখনো ঝগড়া চালাতে ব্যস্ত। এই সুযোগে দোকানের ছাউনি থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি এলে আদ্রিশ ওর হাত ধরে লোকজনের ভিড় থেকে সরিয়ে আনলো।

- আরে কী করছেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন!

আদ্রিশ একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে এসে থামলো। শায়লা এদিক ওদিক তাকিয়ে একবার তাকালো আদ্রিশের মুখে। লজ্জায় ঘাড় নামিয়ে নিলো। ছেলেটা কেমন হা করে তাকিয়ে থাকে। আজ আবার কেমন ছ্যাঁচড়ার মতো হাসছে। আদ্রিশের মনে যেনো ঢাকঢোল পেটানো শুরু হয়েছে। ও ভাবতেও পারেনি শায়লা আসবে ওর সাথে। বেশ কিছুক্ষণ বোকা বোকা হেসে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

- কেমন আছো লায়লা?

শায়লা স্মিত ঘাড় নাড়িয়ে বলল,

- জ্বি, শায়লা।

- আমি তোমাকে দেখতে এসেছিলাম।

আদ্রিশের কথা শুনে শায়লা মুখ তুলে তাকালো। মাঝবেলার রোদটা বেশ তেজি।সেই তাপে তাকিয়ে থাকতে না পারলেও আদ্রিশ উচ্ছ্বসিত সুহাস্য মুখটা ঠিকই স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে। শায়লার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। এভাবে কেউ মুখের ওপর বলে যে দেখতে এসেছে! লোকটা ভারি বোকা। এই ভেবে ফিক করে হেসে উঠলো।

- হাসছো কেনো লায়লা?

মাথা নাড়ালো শুধু। আদ্রিশ বলল,

- তোমাকে দেখতে সুন্দর লাগছে লায়লা।

শায়লা যেনো পারছেনা লজ্জায় মাটি ফুড়ে ঢুকে পড়তে। দুহাতের আঙুলে আঙুল বাঁকিয়ে কিছু বলবে তখনই কানে এলো,

- তোকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি এখানে কি করছিস তুই?

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে একটু দূরেই চড়ুইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ দু'টো আপনা আপনি বড় বড় হয়ে এলো শায়লার। সেদিন হাত তুলে বাই দেওয়ার জন্য থাপ্পড় খেয়েছিল, আজ নিশ্চিত মেয়েটা ওকে শূলে চড়াবে! চড়ুই এর দাঁড়িয়ে থাকা জায়গা টা থেকে শুধু শায়লাকেই দেখা যাচ্ছে। শায়লার হেলদোল না দেখে ও এগিয়ে এলো। এসে সামনে তাকিয়ে বলল,

- এখানে তুই একা দাঁড়িয়ে কি করছিলি?

শায়কা হতভম্বের মতো সামনে তাকিয়ে আদ্রিশের জায়গায় ফাঁকা রাস্তা দেখে হকচকিয়ে গেলো। এই তো এখানে ছিলো ছেলেটা, ও কী স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ!

- এমন মূর্তির মতো করে আছিস কেনো তুই?

- আ আব্ ভিখারি। ভিখারি ছিলো।

চড়ুই চোখ ছোট করে বলল,

- কই আমিতো দেখতে পাচ্ছি না!

- ছিলো এখানেই। তুই আসার একটু আগে চলে গেলো।

- তো তুই কেনো হা করে দাঁড়িয়ে ছিলি। চল।

শায়লা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে যেনো। চড়ুই এতো সহজে বিশ্বাস করবে তা ওর জানা ছিল না। ইনিয়েবিনিয়ে বলল,

- আসলে লোকটার কথায় ভাবছিলাম। ছেড়া ময়লা জামাকাপড় পরে ছিলো। দুদিন ধরে নাকি কিছু খায়নি। খুব মায়া করছিলো।

- থাক, আর জনদরদীগিরি দেখাতে হবেনা।যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে বসে থাকে।

শায়লা আর চড়ুই দূরে চলে গেলে আদ্রিশ পাশের ক্লাবঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তখন চড়ুই এর গলা শুনে ফট করে ঢুকে পড়েছিল। মেয়েটা যা দস্যি ওকে এখানে দেখলে নিশ্চিত ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলতো। শায়লার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আদ্রিশ হতাশার শ্বাস ফেলে বলল,

- এসেছিলাম প্রেমিক হতে, সে কী না ভিখারি বানিয়ে দিলো!

••••

বাইকটা এসে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে থামলে পালক নেমে দাঁড়ালো। দুপুরের রোদ বেশ কড়া হওয়াতে গায়ের জ্যাকেট টা খুলে হাতে নিয়েছে। বেশ বাতাস হচ্ছে আজ। শীতের দুপুরে ঠান্ডা বাতাস আর গরম রোদের বেশ চার্মিং একটা কম্বিনেশন। বেশ লাগছে পালকের। চোখ দু'টো ছোট ছোট করে হাসি হাসি মুখে এদিক ওদিক তাকিয়ে এগোতে লাগলো বাড়ির দিকে। কিন্তু আজ যেন বাতাসটা বড্ড বেয়াদব, খানিক বাদে বাদেই তেজ দেখিয়ে পালকের গলায় ঝুলিয়ে রাখা পাতলা স্কার্ফটাকে সরিয়ে দিচ্ছে। মেঘালয় বাইকটা গ্যারাজে পার্ক করে এগিয়ে এলো। পালক ভেতরে যাচ্ছিল তবে মেঘালয় পেছন থেকে ডাকলে ঘুরে দাঁড়ায়, আর খুব অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দমকা হাওয়ায় তাল মেলানোর ইচ্ছেতে গায়ের ওড়না টা ফুড়ুৎ করে সরে গেলো। মেঘালয়ের একদম সামনা-সামনি ঠিক এই ঘটনাটা ঘটার কী খুব দরকার ছিলো! তড়িঘড়ি করে গলায় পেঁচিয়ে নিলেও লজ্জায় মাথা হেট হলো পালকের। ওর এমন অপ্রীতিকর মুখোভঙ্গিমায় চেয়ে মেঘালয়ের হেলদোল হলো না। ও বেশ দায়সারা ভাবে বলল,

- ওড়নাই তো উড়েছে এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে।

পালক তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। ছোট গলায় বলে,

- অসভ্য৷

- নাহ্। যুগ এখন সভ্যতার চূড়ান্তে আর এই যুগের ছেলে হিসেবে আমিও বেশ আপডেট।

পালক বলল,

- একটু বেশিই আপডেট। তা বোঝায় যায়।

এগোতে নিলে মেঘালয় এসে তাল মিলিয়ে হাঁটে ওর সাথে।

- আরে এভাবে দৌড়াচ্ছ কেনো? সারাটা পথ তো আমার সাথে চিপকেই ছিলে এখন এতো ইনোসেন্ট সাজতে হবে না।

- আপনি প্রচণ্ড অসভ্য।

- হ্যাঁ তা ঠিক। তবে তোমার সাথে তো করিনি অসভ্যতা।

- মানে অন্যদের সাথে করেছেন!

মেঘালয় খানিক চুপ থেকে বলল,

- হ্যাঁ তবে ওটাকে অসভ্যতা বলা যায় না দুজনের সম্মতিতেই ছিল।

পালক অবাক চোখে তাকায় মেঘালয়ের দিকে। মেঘালয় আলতো হেসে বলে,

- হেই কুল! এভাবে কেনো তাকাচ্ছ যেনো আমি কাউকে রেপ করে ফেলেছি? বাইরের আমি যেখানে থেকেছি ওসব জাগায় গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড ইজ ভেরি নরমাল।

মেঘালয়ের দায়সারা ভঙ্গিমায় বলা কথাগুলো যেনো একদম পছন্দ হলো না পালকের। ও তো শুনতে চায়নি এসব। তবুও কেনো যেয়েচেয়ে শোনাচ্ছে! ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

- আপনার এসব জঘন্য গল্প জানার কোনো ইচ্ছে নেই,আমায় শোনাবেন না।

পালক নিজের ঘরে ঢুকে গেলে মেঘালয় দুষ্টু হেসে সিড়ি হয়ে ওপরে উঠে নিজের ঘরে ঢুকলো। ফোনটা বিছানায় রেখে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে সারা ঘর জুড়ে চোখ বুলালো। ভ্রু কুঁচকে এলো কোনো অজানা কারণে। কি একটা মনে হতে টেবিলের ওপর রাখা ওর ব্যাগটায় হাত দিলো। কপাল আপনা আপনি প্রসারিত হলো। সন্দেহ টা বিশ্বাসে উপনীত হলে ঠিক যেমনটা হয় সেরকম মুখোভিব্যক্তি স্থির হলো। যা সন্দেহ করেছিলো ঠিক তাই! ব্যাগের একদম নিচের দিকে রাখা কাগজ গুলো ওপরে আর ওপরের গুলো অন্য পাশে, অর্থাৎ ওর অবর্তমানে কেউ এসেছিল আর ওর জিনিসপত্র নিয়ে হাতাহাতি করেছে!

চলমান।

❤️

29/12/2023

#ইন্দ্রজাল
#পর্বসংখ্যা_১৪
#হুমাইরা_হাসান
__________________

- ফজলুলের মার্ডার নিয়ে যাসব কৈফিয়ত, জিজ্ঞাসাবাদ তা অনেক আগেই করা হয়ে গ্যাছে। সেসব এখন আবার নতুন করে তোলার কারণ টা বুঝলাম না?

- নো প্রবলেম। বুঝিয়ে দিচ্ছি। হাইয়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাদের এই কেসের ভার দেয়া হয়েছে, আর আমাদের সাথে আপনাদের দেখা এই প্রথম। তাই কৈফিয়ত টা পুনরায় দিতে হবে এমনটায় স্বাভাবিক নয় কী?

ভ্রুদ্বয় সটান করে নীরবতা কায়েম রাখলেন আবিদ মির্জা। ফলজলুলের ব্যাপারে মেঘালয় আর পালকের আগমনে যে তিনি মোটেও খুশি হননি সেটা তাঁর মুখাবয়বেই স্পষ্ট। তবে তাঁর বড় ভাইয়ের মুখটা বেশ স্বাভাবিক। হালকা পাতলা লম্বাটে লোকটা গোফের আড়ালে ঢাকা ঠোঁট নাড়িয়ে বললেন,

- আপনারা এ বিষয়ে আর কী জানতে চাচ্ছেন তাহলে?

- কেসটা যেহেতু খু নের মতো একটা সিরিয়াস ইস্যু তাই এক্সাক্টলি কোনো একটা ব্যাপার জানতে চাচ্ছি এমনটা বলা ভুল হবে। বরং যতদিন না মার্ডারারকে না পাওয়া যাচ্ছে ততদিনই জানতে চাইবো।

চওড়া কপালে বড় বড় ভাঁজ ফেলে চাপা নিঃশ্বাস ছাড়লেন আহসান মির্জা। নিথর চোখদুটো প্রসারিত করে পালকের মুখের দিকে তাকালেন একবার। অতঃপর ফের মেঘালয়কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

- ফজলুলের খুন হয়েছে তো ওর সাথে কার শত্রুতা আছে কার সাথে ওঠাবসা ছিলো, লেনদেন ছিলো তাঁদের খোঁজ করুন। আমাদের জেরা করার কী কারণ? অ্যানিহাউ আপনারা কী আমাদের সন্দেহ করছেন?

- ফার্স্ট অফ অল আমরা কাকে জেরা করবো কাকে করবো না সেটা কোনোভাবেই কৈফিয়ত যোগ্য নয় মিস্টার মির্জা৷ আর দ্বিতীয়ত ফজলুল আপনাদের বাড়ির কাছাকাছি জাগায় মার্ডার হয়েছে আর আপনার বাড়ি থেকে বের হবার পরেই। এক্ষেত্রে প্রথম সন্দেহ টা এদিকেই কী আসা উচিত নয়? খু নী কে তা না বের হওয়া পর্যন্ত সবাই সন্দেহভাজন তাই এত বেশি প্রশ্ন না করে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিন৷

এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে ভাবে বলা কথাগুলোর মাঝে কেউ ফোড়ন অব্দি কাটার সুযোগটুকু পেলো না। একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠের কতগুলো কড়া সূক্ষ্ম বাক্যের তোপে ভীষণ রেষাত্মকতা সত্ত্বেও চুপ করে যেতে বাধ্য হলেন মির্জা ভাই দুজন। তাঁদের স্ত্রী’রা অদূরেই দাঁড়িয়ে। বরাবরের মতো একদম শান্ত, সাজানো পরিবেশে আজ পালকের কণ্ঠের তেজটা বেশি স্পষ্ট শোনালো। পরক্ষণেই নিজের উষ্মা প্রকাশিত মুখটা শান্ত করে পালক যথাসম্ভব মন্থর গলায় বলল,

- আপনার ছেলে। তাঁর নাম কি?

আহসান মির্জা যেনো থতমত খেলেন। ছেলে কথাটা শুনে মুখোভিব্যক্তি টা বেশ নড়বড়ে হয়ে উঠলো। আশুউত্তেজিত স্বরে বললেন,

- ছেলে!

- হ্যাঁ আপনাদের ছেলে। কেনো আপনাদের কোনো ছেলে ছিল না?

আহসান মির্জার মুখটা বিবর্ণ হয়ে এলো। ক্লান্তির এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,

- ছিলো। আমার ছেলে রাফসান। কিন্তু ও মারা গ্যাছে আড়াই মাস পেরিয়ে গেলো।

নিচু কণ্ঠে যেনো খুব কষ্টে আওড়ালো বাক্যটা৷ পালকের মুখটা নরম হয়ে এলো। ফের বলল,

- রাফসানের একটা ছবি দরকার।

- আমার ছেলের ছবি দিয়ে তোমাদের কী কাজ?

একটা কম্পিত স্বরের বেশ তেজস্বী কথাগুলো কানে এলো। গায়ে মোটা শাল জড়ানো মহিলা এগিয়ে এসে বললেন,

- তোমরা তোমাদের কাজ করো। আমার ছেলের ছবি কেনো চাচ্ছ?

মুহুর্তেই শান্ত মুখটা ভীষণ ভাবে তেঁতে উঠলো। নির্লিপ্ত চোখজোড়ার ছলছল দৃষ্টিতে বেশ ক্রোধ ঠেসে বললেন কথাগুলো। আহসান মির্জা উঠে এসে তাঁর সহধর্মিণীকে বললেন,

- শিলা কি করছো? এভাবে উত্তেজিত হলে শরীর খারাপ করবে।

স্বামীর এই সান্ত্বনা বাণী কিছুতেই দমাতে পারলো না তাঁকে। বরং ক্ষ্যাপাটে হয়ে বললেন,

- কেনো শান্ত হবো? আমার ছেলেটা মারা গ্যাছে এখন কি ওকে ও তুলে জেরা করবে নাকি?

আহসান পুনরায় মিসেস শিলাকে শান্ত করে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আবিদের স্ত্রী কুহেলীকে ইশারা করলে সে এগিয়ে এসে শিলা কে ধরে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলে আহসান কাতর গলায় বললেন,

- একমাত্র ছেলে হারানোর শোক সামলাতে পারেনি এখনো। ছেলের কথা উঠলেই ওমন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।

অত্যন্ত বিনয়ের সহিত বলা কথার পৃষ্ঠে তাঁর ভাইয়ের অভিব্যক্তি নিতান্তই দায়সারাহীন। মেঘালয় বলল,

- ইট’স অলরাইট। তবে রাফসানের একটা ছবি আমাদের লাগবে৷ দেখুন আমাদেরকে আমাদের মতো কাজ করতে দিলেই ভালো হয়। আমরা তো কোনো ভাবে ডিস্টার্বড করছিনা। আপনাদের ছেলে মারা গ্যাছে আমরা সমবেদনা জানাই তবে যা আমাদের দরকার তা দিতে হবে।

আহসান মির্জা ওদের অপেক্ষা করতে বলে নিজের ঘরের দিকে গেলেন৷ মেঘালয়ের ফোনটা বেজে ওঠায় ও পাশে সরে গেলো৷ পালক একা বসে থাকতে না চেয়ে উঠে দাঁড়ালো। অন্য দিকে এগোনোর জন্য পা বাড়ালেও পেছনের কথাটা শুনে পা দুটো থামলো। ঘাড় সহ শরীরটা ঘুরিয়ে তাকালো সোফায় বসে থাকা আবিদ মির্জার দিকে, লোকটার মুখ দেখে কোনো ভাবেই মনে হচ্ছে না সে ভুলক্রমে কিছু বলেছে। বরং নিজের কথার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে ফের বলল,

- যে কেস কোনো লজিক না পেয়ে আগেই ধামাচাপা পড়েছে সেসব আবার টেনে তোলার কী দরকার ছিলো?

- আমার কী করা দরকার ছিলো আর কী না তার জবাব আপনাকে দেওয়ার প্রয়োজন তো দেখছি না!

আবিদ পালকের আপাদমস্তক চোখ বুলায়৷ কালো জিন্সের সাথে হাঁটুর ওপর সমান একটা টপ আর তার ওপর জড়িয়ে রাখা লেডিস জ্যাকেট। জামার গলায় ঝুলিয়ে রাখা চশমা আর পোনিটেল করে রাখা লালচে চুলগুলো। সবশেষে চোখ আঁটকায় ফর্সা মুখের দীপ্তিমান চোখজোড়ায়। যেখানে কোনো ইতস্তত কিংবা জড়তার ছিটাফোঁটা নেই। আবিদ উঠে দাঁড়ায়। হাতদুটো পেছনে রেখে আস্তেধীরে হাঁটতে হাঁটতে বলে,

- শুনলাম প্রথম শুরু করেছ ক্রাইম ডিপার্ট্মেন্টের জার্নি। তাই এই রাস্তাটা সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেও অভিজ্ঞতাটা বোধহয় এখনো শূন্যের খাতায়।

পালক বিব্রতহীনতায় জবাব ছুড়লো,

- আমার অভিজ্ঞতা হয়তো শূন্যের খাতায় থাকতে পারে, তবে আমার যা ক্ষমতা আছে তাতে আপনার মতো কয়েকজনের নাম পুলিশ স্টেশনের ওই আধছেঁড়া মোটা খাতায় তোলার জন্য মনে হয় যথেষ্ট। সো, ডোন্ট আন্ডারেস্টিমেট।

আবিদের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। একদম শুরু থেকেই এই জবাবদিহিতায় প্রচণ্ড বিরক্ত সে। সামান্য একটা মালির খুনের তদন্তে তাঁকে কৈফিয়ত দিতে হবে তাঁর সাথে সেটা মোটেও মানানসই নয় তাঁর ব্যক্তিত্বে। তবে নিজের ভেতর ফুঁসে রাখা চোট আর প্রকাশ করলো না। বরং মিচকে হেসে বলল,

- খুন মানে পুলিশি,আইনি বড় বড় নেতাদের কারবার। মেয়ে মানুষ। এসবে জড়ালে কখন কী হয়ে যায় বলা তো যায় না৷ সাবধানে থেকো,কেমন?

যেনো কতশত উদ্বিগ্নতা আর মমতার মেকি সুর মিশিয়ে দিলো নিজের কপট স্বরে৷ পালক জবাব দেওয়ার আগেই পেছন থেকে একজনের জবাব টা এলো খুব স্পষ্টভাবে,

- অ্যাবসোল্যিউটলি। একদম ঠিক বলেছেন। কার কখন আমলনামায় টান পড়ে আর কি হয়ে যায় বলা তো যায় না। তাই আমাদের উচিত নিজের সাবধান থাকা আর অন্যকে সাবধান করা।

মেঘালয়ের আগমন আর তাঁর জবাব কোনোটাই যেনো সন্তষজনক না আবিদ মির্জার নিকট। তন্মধ্যে আহসান মির্জা নেমে এলেন৷ একটা ফটো পালকের দিকে এগিয়ে দিলে পালক খামটা নিজের হাতে নিয়ে বলল,

- থ্যাংকস মিস্টার মির্জা। আপনাদের শহরে ফেরার অপেক্ষায় আমাদের অনেকটা বিলম্ব হয়ে গ্যাছে। আশা করছি আমাদের কেস সলভ না হওয়া অব্দি আপনাদের আর শহরের বাইরের ডাক পড়বে না।

খুব নরম হেসে পালক মির্জাদের শহরের গণ্ডি পার না করার আদেশ জারি করে বিদায় জানালো। দরজা পেরোলে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকালো পালক। বেশ হতবাক ও হলো, এই মানুষটাকে ঠিক কতদিন পর দেখছে তার হিসেব নেই।

- কেমন আছো রুনা?

- ভালো আছি ম্যাডাম।

ফ্যাকাশে মুখটার চিত্র আর তার জবাবে কোনো রকম মিল পেলোনা পালক। বরং একটু বেশিই কপট লাগলো৷ উষ্কখুষ্ক চেহারায় চেয়ে পালক বলল,

- এখন কোথায় থাকছো?

- আমার তো ঠিকানা একটাই ম্যাডাম। এ বাড়িতে কামলা খাটছি তার বিনিময়ে দুবেলা ভাত আর শোবার জন্য জায়গা পাচ্ছি।

পালকের জবাবের অপেক্ষা না করে রুনা নিজেই এবার প্রশ্ন করলো,

- লোকটার খু নীকে ধরতে পেরেছেন ম্যাডাম?

নির্লিপ্ত কণ্ঠে কেমন একটা উত্তাপ অনুভব করলো পালক। যেনো ইচ্ছে করেই জিগ্যেস করলো রুনা। ও তো নিজেও জানে এখনো কোনো কিছুর সমাধান হয়নি। পালক বলল,

- না। আমায় একটা কথা বলো, ওইদিন ফজলুল মিয়ার এ বাড়ি থেকে বের হতে দেরি কেনো হয়েছিলো। অন্যান্য দিন সন্ধ্যার আগেই তাঁর কাজ শেষ হয়ে যায় তাহলে সেদিন কেনো রাত দশটা বাজলো?

- কারণ সেদিন কোনো কাজই ছিলো না।

রুনার জবাবে স্পষ্ট হেয়ালি। পালক ভ্রু কুঁচকে বলল,

- মানে?

- আমার দেরি হচ্ছে ম্যাডাম। অন্যের বাড়ির খেয়ে আপনার জবাবদিহি করলে এই ছাদটুকুও হারাতে হবে।

এই বলে ভেতরের দিকে হাঁটা ধরলো রুনা। পালক ওর যাওয়ার পানে বিভ্রান্তিকর চাহনিতে তাকিয়ে নেমে এলো চৌকাঠ মাড়িয়ে। বাইকে বসে থাকা মেঘালয় ওর চিন্তিত মুখটা দেখে বলল,

- মুখটা কালো করে রেখেছ কেনো জুলিয়েট?

পালক বিব্রত হয়ে রুনার সাথের কথপোকথন মেঘালয়কে বললে ও বেশ স্পষ্ট করেই বলল,

- সেদিন কোনো কাজ ছিলো না অর্থাৎ সেদিন ফজলুল এখানে কাজে আসেইনি।

- আসেনি মানে?

কথার মাঝেই বাইকে স্টার্ট করলো মেঘালয়। পালক উঠে বসলে জবাব দিলো,

- ফজলুল মিয়ার বাড়িতে যেদিন গেছিলাম এলাকায় তাঁর সুপরিচিত কয়েকজনের সাথে কথা হয়েছিল আমার। তাঁরা বলেছে ফজলুল খু ন হওয়ার তিনদিন আগে থেকে কাজে যাওয়া বন্ধ করেছিলো। এমনকি সেদিন ও সে বাড়িতেই ছিলো।

- বাড়িতেই যখন ছিলো তাহলে পাঁচ কিলো পথ পেরিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই রাত দশটায় এদিকে কেনো এলো?

পালকের অতিউত্তেজিত কৌতূহলী স্বরের বিপরীতে মেঘালয় বেশ শান্তভাবে বলল,

- এটা জানতে পারলে তো সব সমাধান হয়েই যেতো জুলিয়েট।

পালক চুপ করে গেলো। কতগুলো জটলা পাকানো সমীকরণ মস্তিষ্কে বুদ হয়ে রইলো হুট করেই হাতের মাঝের খামটা খুলে সামনে ধরলো। চলন্ত গাড়িতেই মেঘালয়ের পিঠ খামচে ধরে সশব্দে বলল,

- এটা তো সেদিনকার ওই ছেলের ছবি যেটা আমায় রাস্তায় ওই ছেলেটা দিয়েছিলো!

…………….

- ভাই আই অ্যাম ইন লাভ্।

ভীষণ নাটকীয়তা আর অবেগ মিশিয়ে বলা কথায় রাফাত খুব বিরক্তি আর ক্রুর মিশ্রিত দৃষ্টি ফেলে বলল,

- আই ফা°° ইও’র লাভ।

পিসির কী-বোর্ডে টপাটপ আঙুল চাপতে চাপতে আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। আদ্রিশ মুখটা চুপসানো বেলুনের মতো করে উঠে এলো। রাফাতের পাশে বসে বলল,

- দ্যাখ ফাইজলামি করিস না বেটা। আই অ্যাম ইন লাভ।

- তোর লাভ নিয়ে তুই ভাগাড়ে যা।

- হ্যাঁ যাবো কিন্তু সাথে তোকেও যেতে হবে।

মাউসের ওপর রাখা রাফাতের হাতের ওপর আদ্রিশ ধপ করে ওর হাতটা চেপে রাফাতের দিকে তাকালো। সামান্য দূরত্বে রাফাতের চোখের দিকে করুণ আবেগমিশ্রিত চাহনি ফেলে বলল,

- একবার আমার চোখের দিকে তাকাও এক সমুদ্র প্রেমের জোয়ার দেখতে পারবে। এটাকে তুমি অগ্রাহ্য করতে পারো না রাফাইত্তা।

রাফাত বিস্ফারিত চোখে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আদ্রিশের মুখটা দেখলো। কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক চেয়ে এক অকস্মাৎ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তাল সামলাতে না পেরে বিছানায় ধপ করে পড়লে রাফাত দাঁত খিঁচিয়ে বলল,

- কোনো প্রেমে টেম না তোর হরমোনাল ইমব্যালান্স হয়েছে, ডাক্তার দেখা। তা নাহলে যখন তখন আমার ইজ্জতে হাত দিয়ে ফেলবি তুই।

আদ্রিশ আধশোয়া হয়ে বলল,

- বা’লের ক্যাচাল করিস না তো। ওঠ তুই।

এই বলে উঠে এসে রাফাতের হাত ধরে টান দিলো। রাফাত হাত ছাড়িয়ে বলল,

- কীসের ওঠা। আমি এখন গেইম ছেড়ে উঠছিনা৷

- তুই উঠবি তোর বাপেও উঠবো।

রাফাত ভাবলেশহীন ভাবে আবারও মাউসে হাত রেখে বলল,

- আমার বাপেরেই ওঠা। আমি পারুম না।

আদ্রিশ উঠে এসে রাফাতকে টেনে তুলে ওর পকেটে হাত দিয়ে বলল,

- তোর বাপেরে নিয়া কাম নাই। বাইক নিম, চাবি দে।

- ওই ভাগাড়ে যাইতে আমি জীবনেও বাইক দিম না আদ্রিইশশা।

- চাবি দে কইতাছি রাফাইততা!

আদ্রিশ সজোরে চেষ্টা করছে রাফাতের পকেট থেকে চাবি নেয়ার আর রাফাত বাঁধা দেওয়ার। দুজনের হাড্ডাহাড্ডি ছিনতাই প্রক্রিয়ার মাঝে হুট করেই একটা চাপা আর্তনাদ কানে এলো,

- খোদা খোদা!

এমন আকস্মিক আতঙ্কিত কণ্ঠে রাফাত আদ্রিশ দুজনেই হকচকিয়ে দরজার দিকে তাকালো। আরশি মুখে হাত চেপে এমন এক প্রকার বজ্রাহতের ন্যায় চাহনি দিয়েছে যেনো অষ্টম আশ্চর্যরূপী কোনো মহাবিপর্যয় দেখে ফেলেছে। রাফাত আদ্রিশ দুজনেই থতমত খেলো আরশির এহেন বিস্ফারিত নজরের আঁজলে। ওদের আরও একধাপ অপ্রস্তুত করে দিয়ে আরশি কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,

- হায় খোদা এমন দিনও দেখালে তুমি! শেষে কী না আমার ছুডো বেলার বন্ধুদের এইরূপ!

আদ্রিশ প্রচণ্ড বিব্রত হয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে রাফাতকে ধাক্কা দিয়ে সরে যায়। চাবি নিয়ে ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে ও রাফাতের প্যান্টের বেল্ট টেনে ধরেছিল আর রাফাত ওকে সরাতে টি-শার্ট। ব্যস্ ইজ্জতের যেটুকু অবশিষ্ট ছিলো এবার আরশি নামক আপদটা সেটুকুও নিলামে তুলবে এ বিষয়ে দুজনের কারোরই সন্দেহ রইলো না। আদ্রিশ এদিক ওদিক অপ্রস্তুত তাকিয়ে আরশিকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলে রাফাতও কোনো উপায় না দেখিয়ে ওর পিছুপিছু বেরিয়ে পড়লো। আঞ্জুমান নাস্তা করে আনছিলেন ওদের জন্য। দরজার সামনে আরশিকে মূর্তিমান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,

- আরশি যে! কখন এলে? এসো বোসো রাফাত আর আদ্রিশের সাথে নাস্তা করো।

আরশি ছলছল দৃষ্টিতে পুতুলের মতো এগিয়ে এসে বলল,

- এটা কিছুতেই হতে পারে না! আমি হতে দেবো না..

এটুকু বলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। আআঞ্জুমান হতবিহ্বলিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এগিয়ে এসে ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে কম্পিউটারের অনস্ক্রীন বাদে ঘরে আর একটা উপস্তিতিও পেলেন না। বিহ্বলতার শীর্ষে ঘিরে আনমনে বললেন,

- এদের আবার কী হলো?

………………

আগের দুটো বাড়িতে খোঁজ নিলেও তেমন কোনো গতি করতে পারেনি৷ একজনের তো বাড়ির লোকজন নিজেদের বাসাবাড়ি পরিবর্তন করে কোথায় উঠেছে তার কোনো খোঁজ মিললো না। আরেকজনের বাড়ি খুঁজেই পেলো না। এখন শেষ রাস্তা এই লেডিস হোস্টেল৷ মেঘালয় বাইকের ওপর বসেই তাকিয়ে রইলো আধভাঙ্গা দেওয়ালের এই মেসবাড়ির দিকে৷ পালক ভেতরে ঢুকে এলো। একতলা মেসবাড়ির ভেতরে ঢুকে একজন বৃদ্ধাকে দেখে সালাম দিলো৷ মহিলা চশমার আড়ালে কুঁচকানো চামড়া আরও কুঁচকে মুখ বাঁকিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো পালকের দিকে৷ বেশ কিছুক্ষণ আধ অকেজো মস্তিষ্কে জোর দিয়েও চেহারাটা চিনতে না পেরে উচ্চস্বরে বললেন,

- কে?

পালক দুই কদম এগিয়ে এসে বলল,

- চাচী আমি পালক আমি একটু ক..

- পল্লব? এই ছেরা তোকে কবে বলেছি আমার ঘরের ফ্যানটা ঠিক করে দিতে ওটা ঘোরে না ঠিকমতো।

পালক অপ্রতিভ হয়ে অবিন্যস্ত নজর মেলে বলল,

- পল্লব না আমি পালক।

- আরে চাচী এটা মেয়ে তুমি কি এখন ছেলে মেয়েও চিনতে পারছো না!

কোণার দিকের ঘর থেকে একটা মেয়ে এগিয়ে এলো। বৃদ্ধা আড়চোখে পালকের দিকে তাকিয়ে ‘ও’ বলে গিয়ে চেয়ারের ওপর বসলো। মেয়েটা পালকের কাছে এগিয়ে এসে বলল,

- আপনার কেমন রুম লাগবে? দুই সীট নাকি তিন সীটের। এখানে একটা রুম ফাঁকা আছে আপনি চাইলে একাও থাকতে পারেন।

পালক দম ছেড়ে বলল,

- আমি রুম নিতে আসিনি।

মেয়েটা খানিকটা থমকে বলল,

- তাহলে?

পালক ওর ফোন থেকে একটা ছবি বের করে মেয়েটার সামনে ধরে বলল,

- এই মেয়েটাকে চিনতে পারছ?

মেয়েটার ভাঁজ ফেলা কপাল প্রসারিত হয়ে এলো। কালচে মুখে বলল,

- ফাহিমা। আপনি কি ওর আত্মীয়?

- আমি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে আসছি। মেয়েটার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে তদন্ত করতে।

মেয়েটার মুখটায় কেমন বিরক্তি ফুটে উঠলো। কেমন গা-ছাড়া ভাব দেখিয়ে বলল,

- কীসের নিখোঁজ! বড়লোক ছেলে ধরে পালিয়েছে।

পালক ফোনটা নামিয়ে বলল,

- পালিয়েছে? মেস থেকে জিডি করা হয়েছিলো ওর নিখোঁজ হওয়ার এখন পালানোর কথা কেনো?

- না বাপ-মা না কোনো ঠিকানা। মেসে মেসেই থেকে বেড়ায় মেয়েটা৷ এখানে এসে চারমাস ছিলো। তারপর একদিন হুট করেই সেজেগুজে বেরোলো আর ফেরেনি। এখন আমাদের সাথেই যখন ছিলো তাই দ্বায়িত্ব মেটাতে জিডি করে রেখেছিলাম যাতে কোনো অঘটন করে ফিরলে আমাদের দোষ না দিতে পারে।

- ও যে পালিয়েছে তা তোমায় কে বলল?

মেয়েটার আত্মবিশ্বাসে যেনো ভাটা পড়লো। তবুও কেমন ভোঁতা মুখে বলল,

- তা আবার বলতে হবে কেনো। একা থাকে, দুটো টিউশনি করিয়ে মেসভাড়া আর হাতখরচেই তো চলে যায়। দামী ফোন আর জামাকাপড় কোত্থেকে আসবে প্রেম না করলে!

পালক বলল,

- মেয়েটার ঘরে কী কোনো জিনিসপত্র আছে?

- হ্যাঁ ওই কয়েকটা জামাকাপড় আর একটা ব্যাগ।

পালক মেয়েটার সাথে ওর ঘর ব্যাগ সবটায় দেখলো। তবে দেখার মতো কিছুই নেই৷ অগত্যা বেরিয়ে এসে বলল,

- মেসে কয়জন থাকো?

- আমরা এখন চারজন আছি। দুজন গ্যাছে পরীক্ষা দিতে আরেকজন ছুটিতে বাড়ি গ্যাছে।

পালক বৃদ্ধাকে দেখাকে মেয়েটা বলল,

- এই বাড়িটা ওনারই। বয়স হয়েছে তো, চোখ মাথা সবই কম কাজ করে।

পালক বেরিয়ে এলো মেস থেকে। রুস্তম আলীর দেয়া তিনটে মেয়ের নিখোঁজ কেসে এই একজনেরই সূত্র পেলো তাও কোনো কূল কিনারা নেই। গেইটের সামনে এসে মুখটা শক্ত হয়ে এলো। এগিয়ে এসে বলল,

- আপনাকে না বলেছি আমার সাথে থাকলে সিগারেট খাবেন না!

মেঘালয়ের কোনো হেলদোল হলো না। আরামসে ধোঁয়া উড়িয়ে বলল,

- আমি খাচ্ছি, তোমায় তো দুটো টান দিতে বলিনি প্রবলেম কোথায়।

পালক খিটমিট করে বলল,

- সিগারেটের গন্ধ একেবারেই জঘন্য লাগে আমার। দূর হয়ে যান।

- আমি তো এমনিও তোমায় কিস করছি না যে ভালো লাগতে হবে। আমার মুখ দিয়ে আমি যা খুশি খেতে পারি।

পালক ফিসফিস করে নিজেনিজেই বলল, ‘গু খেতে পারেননা’। মেঘালয় থমথমে মুখে বলল,

- ডাস্ট৷ তবে চুমু দিলে খেতে পারি।

- আশ্চর্য। চলুন এখনই। আপনার সাথে যতক্ষণ থাকবো আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।
চলমান।

❤️

Want your public figure to be the top-listed Public Figure in Kushtia?
Click here to claim your Sponsored Listing.

Videos (show all)

“ ধ্বংস করেছে আমায়, বিলীন করেছে আপনাকে ভালোবাসার অভিলাষ। সবদিকে, সবভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে আমায় ”“ যে স্বামীর বুকে মাথা...
||  মোহর রাগান্বিত চেহারায় কঠোরত্ব এঁটে কিঞ্চিৎ ধমকের মত যখন বলে,   “আমি এসে না দিলে তো কখনোই নিজ হাতে ওষুধ টাও তো নিয়ে ...

Category

Website

Address

Kushtia