Sabbir Jadid

Sabbir Jadid

This is official page of Sabbir Jadid. He is short story writer and khatib.

18/01/2024

আজ থেকে শুরু হয়েছে কলকাতা বইমেলা।

15/12/2023

পিতামহ এবং গোত্রহীনের ইতিকথার মতো মোটা বই ৪৯% ছাড়ে কেনার সুযোগ, এই প্রথম। বিস্তারিত কমেন্টে...

15/12/2023

বিষ্ণুদিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আজ জুমার নামাজ পড়াবেন সাব্বির জাদিদ।

—অ্যাডমিন।

05/12/2023

কালজয়ী কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবস আজ। সেই উপলক্ষ্যে ঐতিহ্য ঐতিহ্য Oitijjhya দিচ্ছে গোত্রহীনের ইতিকথার ওপর ৩৫% ছাড়। অফার চলবে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। যারা সংগ্রহ করতে চান, তাঁদের জন্য এটা ভালো সুযোগ।

25/11/2023

মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছে কাফনাবৃত কয়েকজন যুবক। তাদের সাদা পোশাক থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে আলোর অপার্থিব দ্যুতি। যেন কোনো এক দরগাহর কবর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা জীবন্ত পুণ্যাত্মা।

যুবকদের প্রতিটি পদক্ষেপ, স্লোগান, অঙ্গভঙ্গি মুগ্ধতা বাড়ায় আদনানের। বন্ধু আতিকুল্লাহকে নিয়ে ও এগিয়ে যায় সামনের সারিতে। সাদার মাঝে ওদের রঙিন পোশাক বেখাপ্পা দেখালে আফসোস হয় আদনানের। আগে থেকে জানলে এক প্রস্থ কাফনের ব্যবস্থা নিশ্চয় করতে পারত ও। তাতে মিছিলের নেতৃত্ব দেয়া যুবকদের ভেতর সহজে মিশে যেতে পারত।

কাফন-বিষয়ক আফসোসের ভেতরই এক প্রৌঢ় কোত্থেকে এক বোঁচকা কাফন নিয়ে হাজির। বোঁচকাটা উঁচু করে ধরে প্রৌঢ় উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলেন, যারা সামনের দিকে আছো, কাফনের কাপড় পরে নাও। জীবনে অনেক কাফন বিক্রি করেছি। এগুলো আজাদির জন্য উৎসর্গিত।

প্রৌঢ়ের আহ্বান লুফে নেয় আদনান ও আতিকুল্লাহ। দুজন দুই খণ্ড কাফন পরে নব-উদ্যমে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়। পেছন ফিরে ওরা দেখে, ওদের মতো হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় পথে বেরিয়ে এসেছে।

সামনের মোড়টা পার হয়ে ওরা জানতে পারে, কাশ্মীরের প্রতিটি অঞ্চলই আজ নিকটবর্তী দরগাহর উদ্দেশে মিছিল বের করেছে। মিছিল শেষে দরগাহে গিয়ে তারা স্বাধীনতার জন্য দোয়া করবে।

শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে গাছপালায় আচ্ছাদিত গ্রাম্য সজীবতার মধ্যে ঢুকতেই অভূতপূর্ব এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় মিছিলটি। গ্রামের নারী এবং শিশু, যারা মিছিলে অংশ নিতে পারেনি, তারা মানব-ফটকের মতো করে পথের দু পাশে সার ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

তাদের কারো হাতে পানির পেয়ালা, কারো হাতে খাবারের পাত্র, কারো হাতে ফুলের ডালি। তরুণীরা চাল ও চিনির সহযোগে তৈরি সাদা শিরিন তুলে দিচ্ছে মিছিলকারীদের মুখে, যা কেবল বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রীর জন্য প্রস্তুত করা হয়। কিশোরীরা কেশর বিযুক্ত জাফরান ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিচ্ছে পথে।

অনেক মা কোলের শিশুকে সামনে বাড়িয়ে বলছে, আমাদের সন্তানকে আজাদির জন্য উৎসর্গ করলাম। এরা বড় হতে হতে যদি কাশ্মীর স্বাধীন না হয়, তবে এরাও যুদ্ধে যাবে। অনেক বোন তাদের ছোট ভাইয়ের চিবুক স্পর্শ করে বলছে, আমরা আমাদের ভাইদের বড় করছি আজাদির জন্য। এরা বড় হতে হতে যদি কাশ্মীর স্বাধীন না হয়, তবে এরাও যাবে যুদ্ধে।

আজাদির জন্য পাগলপারা এই জাতির ভালোবাসার নজরানা দেখে চোখে জল এসে যায় আদনানের। ও চোখ মুছে ফিসফিস করে বন্ধু আতিকুল্লাহকে বলে, আজকের মিছিল কাশ্মীরের হৃদয়কে নতুন করে চিনিয়ে দিল। এরপরও যদি এই জাতি পরাধীনতার নাগপাশে বন্দি থাকে, তবে তা হবে ইতিহাসের বেদনাবিধুর ঘটনা।

💝 আজাদির সন্তান
সাব্বির জাদিদের নতুন উপন্যাস, আসছে.... ২০২৪ এর বইমেলায়।

(এডমিন পোস্ট)

24/11/2023

লাশ বহনকারী যুবকের কথাই ঠিক। একটু আগে ওরা মানুষের কোলাহলের জন্য হাহাকার করছিল, অথচ এই তুষার ঝরা শীতেও রহমতবাগ গোরস্তান পরিণত হয়েছে মানুষের বাজারে। তাদের মধ্যে আছে সব বয়সের মানুষ। তারা সসম্ভ্রমে আদনানদের দিকে তাকায়, সঙ্গীর সাথে ফিসফিস করে।

এরই মধ্যে জাফরান, কাঠবাদাম ও এলাচের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে। গেরিলাদের জন্য এক কিশোর কেটলিভর্তি কাওয়া নিয়ে এসেছে। তুষারঢাকা দুর্গম পথের দীর্ঘ সফরের পর বড্ড প্রার্থিত ওই সুবাসিত কাওয়া। কিন্তু গোরস্তানে লাশ ও লাশের জানাজা সামনে রেখে কাওয়ার পেয়ালায় চুমুক দেয়া কতটুকু সঙ্গত হবে, সেই ভাবনা বুকের ভেতর খচখচ করে।

ইকবাল মির বলেন, আপনাদের খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। কাওয়া পান করে নিন। চাঙ্গা বোধ করবেন।

কাতার সোজা হতে হতে ওরা কাওয়ার পেয়ালায় ঠোঁট লাগায়। জানাজার আগে উপস্থিত জনতার সামনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখে আদনান। শফিকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ওর কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। সবশেষে ও দোয়া চায় মুসল্লিদের কাছে, বিশেষত শফিক ও কাশ্মীরের আজাদির জন্য।

জানাজা পড়ান স্থানীয় মসজিদের ইমাম। শফিককে চিরনিদ্রায় শায়িত করার পর খোদার দরবারে হাত তোলে সবাই। মোনাজাতে এক বিরল দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। অচেনা যুবক শফিক, যার সাথে এই মানুষগুলোর কোনদিন দেখা হয়নি, আগামীতেও দেখা হবে না কোনদিন, সেই অদেখা অচেনা ছেলেটার জন্য কান্নায় ভেঙে পড়ে তারা।

মনে মনে ভাবে আদনান, স্বজাতির মুক্তির জন্য শ্বাপদসংকুল পথে পা রাখে যে জানবাজ তরুণ, ব্যক্তিক জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠে যায় সে। সে হয়ে ওঠে নৈর্ব্যক্তিক, সকলের গর্বের ধন। তার জন্য জল বিসর্জন দেয়া চোখের অভাব হয় না। শফিকের সৌভাগ্যে মনে মনে ঈর্ষান্বিত হয় আদনান। অস্ফূট স্বরে বলে, শফিক, বিদায় বন্ধু। হয়তো তোমার পদরেখার সাথে মিলিত হবে আমাদের পায়ের ছাপ।

দাফন-কাফন শেষ হয় কিন্তু পাতলা হয় না মানুষের জটলা। সকলেই কথা বলতে চায় যোদ্ধাদের সাথে। তাদের অভিজ্ঞতা শুনতে চায়। তারা কোথা থেকে এল, কোথায় যাবে, শফিক মারা গেল কীভাবে, এ পর্যন্ত তারা কতজন সৈন্যকে হত্যা করেছে, তাদের অস্ত্রগুলো কীভাবে কাজ করে ইত্যাদি। কিন্তু এইসব জিজ্ঞাসা যে যুদ্ধনীতির পরিপন্থী, এবং এইসব প্রশ্নের জবাবের মধ্যে যে তাদের বিপদ লুকায়িত আছে, গ্রামের সরল মানুষগুলো তা বুঝতে চায় না।

শেষে কঠোর হতে হয় ইকবাল মিরকে। সহযোগীদের নিয়ে তিনি সবাইকে সরিয়ে দেন। ভিড় পাতলা হয়ে এলে সারিবদ্ধ কয়েকটি কবরের ওপর চোখ পড়ে আদনানের। অন্যান্য কবরের সমাধিলিপিতে মৃতের নাম ঠিকানা থাকলেও এই কবরগুলিতে তা নেই।

শুধু, এক দুই তিন—এভাবে বারোটি কবরে মোট বারোটি সংখ্যা বসানো। আদনান গভীর দৃষ্টিতে কবরগুলোর দিকে তাকায়। সংখ্যার নিচে তাদের মৃত্যুর সন-তারিখ আছে, কিন্তু জন্মতারিখ নেই।

ইকবাল মির বিষণ্ন কণ্ঠে বলেন, ওরা সেইসব যুবক, যারা রহমতবাগে আশ্রয় নিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের আক্রমণে শহিদ হয়েছে। আমরা ওদের নাম-ঠিকানা জানি না, বয়সও জানি না, শুধু জানি ওরা মারা গেছে। ওই এক দুই তিন সংখ্যাই ওদের পরিচয়।
ইকবাল মিরের কথার প্রেক্ষিতে আদনান কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। খানিক সময় নিয়ে একটু পর সে বলে, এক টুকরো কাঠকয়লা দিতে পারবেন?

ওর কথা হুট করে ধরতে পারেন না ইকবাল মির। কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকেন তিনি, তারপর বলেন, ও, কাঠকয়লা! ব্যবস্থা করছি। ব্যবস্থা করছি।

অকল্পনীয় দ্রুততায় এক কিশোরের হাতে কাঠকয়লা চলে আসে গোরস্তানে। আতিকুল্লাহর সাথে ধরাধরি করে আদনান একটি সাদা পাথর শফিকের মাথার কাছে রাখে। তারপর পাথরের গায়ে কাঠকয়লার কালিতে খোদাই করে সমাধিলিপি :

নাম : শফিক গুল।
পিতা : আলতাফ গুল।
গ্রাম : গুরিহাকা, পেহেলগাম।
জন্ম : ১৯৭০।
মৃত্যু : জানুয়ারি, ১৯৯২।
বন্ধু, আমাদের আজাদি তোমার নামে উৎসর্গিত হবে।

💝 আজাদির সন্তান
সাব্বির জাদিদের নতুন উপন্যাস, আসছে.... ২০২৪ এর বইমেলায়

11/09/2023

যে দুইটা গুনাহ্ জীবনে করবেন না 🥺
শায়েখ সাব্বির জাদিদ।

23/07/2023

কীভাবে আপনার সন্তানকে মাদক থেকে ফেরাবেন?
🎙️সাব্বির জাদিদ

17/07/2023

ম*দ কে কি সিরকা বানানো যাবে?? শায়খ সাব্বির জাদিদ

12/07/2023

যে ৯ জিনিস এর উপর আল্লা লানত করেছেন। শায়খ সাব্বির জাদিদ।

09/07/2023

যে কাজটি করলে আপনি আর মুমিন থাকবেন না 😭🥺

🎙️🎙️শায়খ সাব্বির জাদিদ।

30/06/2023

শায়খ সাব্বির জাদিদ আজ বিষ্ণুদিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুমুআর নামাজ পড়াবেন। ইংশাআল্লাহ

অ্যাডমিন।

25/05/2023

পরিবার কে নিয়ে অবাক করা তথ্য দিলেন

🎙️🎙️ শায়েখ সাব্বির জাদিদ

ইউটিউব

https://youtu.be/dtzPobMHn54

06/03/2023

তোবারক আলির শরীর খারাপ। জ্বর আর গলার ভেতর খুশখুশানি কাশি। তার উপর বয়সের ভার। দুই সপ্তাহ যাবত বিছানায় শোয়া সে। চলাফেরার ক্ষমতা নেই। অথচ একটা সময় কত দাপটের সাথেই না সে সংসারের কাজকর্ম করে বেড়িয়েছে। মাঠে, গনগনে রোদে বসে গরুর ঘাস কেটেছে। ধান লাগিয়েছে। নদী সাঁতরে ওপার গেছে মাছ ধরতে। সে সব কথা আজ ভাবতে গেলেও হাত-পা অবশ হয়ে আসে।
তোবারক আলির মনে হচ্ছে এ-যাত্রা সে আর টিকবে না। এর আগেও সে কয়েকবার এমন সপ্তাব্যাপী বিছানায় পড়েছিল। বিছানা তাকে আটকে রাখতে পারেনি। বারবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। মোষ যেভাবে দীর্ঘ সময় ধুলোয় শুয়ে থাকার পর হঠাৎ দাঁড়িয়ে গা ঝাড়া দেয়, তেমন। এবার আর সেই শক্তি নেই। অনেকে বলে, তোবারক আলি শুনেছে, কেউ কেউ নাকি মৃত্যুর আগে আজরাইলের গন্ধ পায়। তোবারক আলিও গন্ধ পাচ্ছে, তার সময় শেষ। কিন্তু চলে যেতে ইচ্ছে করছে না। কারই বা করে! তার মনে পড়ছে বড় ছেলের কথা। তালাক খাওয়া দুই মেয়ের মাকে বিয়ে করে বাড়ি উঠতে চেয়েছিল শরিফুল। তোবারক আলি মানেনি এই সম্বন্ধ। কী করে মানবে! সে গরিব হতে পারে, তাই বলে কি তার মানসম্মান জ্ঞান নেই! দুনিয়ায় কুমারী মেয়ের এতই আকাল পড়ল যে স্বামী খেদানো বুড়িকে তার বিয়ে করা লাগবে! শরিফুল বউ আর উপরি হিসেবে পাওয়া দুই মেয়েকে নিয়ে সেই যে গেল, আর ফেরেনি। কোথায় গেছে কেউ জানে না। ছোট ছেলে চোরাচালানির কেসে জেলে পচছে। ছেলেদুটোর একটাও যদি আজ পাশে থাকত, তোরাব আলি হয়ত এ-যাত্রায় বেঁচে যেত। না বাঁচুক, অন্তত দুই বোতল জ্বরের সিরাপ খেয়ে আরামে মরতে পারত। বিনা চিকিৎসায় মরা– এই লজ্জা থেকে রেহাই পেত।

সংসারে এখন তোবারক আলি আর তার বউ নবিছন। নবিছনেরও বয়স হয়েছে। এই বয়সে সে নিজেই হাল ধরেছে সংসারের। মুন্সি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করছে। বিনিময়ে যা পাচ্ছে– দুইবেলা ভাত আর মাস শেষে দুশো টাকা– এই আয়ে ওষুধ খাওয়ার বিলাসিতা অসম্ভব।
তোবারক আলির ঘরের সাথে ছুটিপুরের একমাত্র জামে মসজিদ। এতটাই লাগোয়া, দুই দেয়ালের মাঝে তৃতীয় কোন বস্তু নেই। তোবারকের টিনের বেড়া দেয়া ঘর। মসজিদের দেয়াল অবশ্য ইটের। তোবারকের ঘরের দিকে দুটো জানালা আছে মসজিদের। খোলাই থাকে প্রায় সময়। এই জানালা দিয়ে ভেতরের কথাবার্তা সবই শুনতে পায় তোবারক। এই যেমন এখন জুমার বয়ান চলছে। ইমাম সাহেব চিৎকার করে করে নামাজের ফজিলত শোনাচ্ছে মুসল্লিদের। মাঝে মাঝে সুবহানাল্লার ঢেউ উঠছে মসজিদজুড়ে। বিছানায় পড়ে থাকা তোবারক পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। সুস্থ থাকতে তোবারকও জুম্মার নামাজে শরিক হতো। যদিও নিয়মিত নয়। সংসারের হাজারটা কাজ। সব সামলে-সুমলে ওযু-গোছল করে পাকসাফ হয়ে জুমার জামাতে যেতে প্রায়ই তার দেরি হয়ে যেত। আর পাঁচ ওয়াক্তর জামাতে সে কোনদিনই নিয়মিত হতে পারেনি। এই নিয়ে কথাও কম শুনতে হয়নি তার। জালালুদ্দিন বকশ তো দেখা হলেই বলে, তোর মতো ভাগ্যবান আর কয়ডা আছে দুনিয়ায়! তুই হলি আল্লার ঘরের সপচে নিকটতম পোতিবেশি। তুই যদি নামাজটা নিয়মিত পড়িস, তোর জান্নাতে যাওয়া কিডা ঠ্যাকায়, ক!
তোবারকের খুব শখ জান্নাতে যাওয়ার। আর সে-জন্য সে ভাবে, নামাজটা তার শুরু করা দরকার। দুনিয়া কয়দিনের! কিন্তু জালালুদ্দিন বকশর সামনে থেকে সরে এসে আবার যখন সে লিপ্ত হয় সংসারের কাজে, সব ভুলে যায়। কখনো জালালুদ্দিন বকশর আক্ষেপের জবাবে সে বলে, মন তো চায় নামাজ ধরি, কিন্তু সুংসারের এতো কাম…।
জালালুদ্দিন বকশ কেড়ে নেয় মুখের কথা– সুংসারের কাম চেরকালই থাগবি। ইর ভিতর দিয়েই আল্লার কাম করা লাগবি।
আল্লাহর কাম আর করা হল না তোবারকের। এর আগেই ডাক পড়ে গেল বিছানার। তারপর হয়ত কবরের।
তোবারক খুব আশায় থাকে, ইমাম সাহেব একদিন হয়ত জুমার বয়ানে গরিব মানুষের কথা বলবে। অসুস্থ মানুষের সেবার উৎসাহ দেবে। ইমাম সাহেবের বয়ান শুনে হয়ত কিছু লোক ছুটে আসবে তাকে দেখতে। নবিসনের হাতে ওষুধ কেনার কয়টা পয়সা গুঁজে দেবে। সেই পয়সার ওষুধ খেয়ে তোবারক আবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠবে। শেখের বাড়িতে কামলা খাটবে। নবিসনের জন্য একটা শাড়ি কিনবে। নিজের জন্য লুঙ্গি। আর শরীরের দুর্বলতা কাটাতে একটু মাছ। কিন্তু ইমাম সাহেব গরিব মানুষের কথা বলে না। প্রতি জুমায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কখনো নামাজ, কখনো মিলাদ, কখনো জিহাদের কথা বলে। কিন্তু ইসলাম ধর্মে যে মানবসেবার কথা আছে, তোবারক জানে। না, সে লেখাপড়া করেনি কখনো। ইসলাম নিয়ে তো নয়ই। তবু সে জানে কিছুটা। সেই ঘটনা আরেকটু পেছনের। বারো বছর আগের। শরিফুল বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তোবারকের খুব অনুশোচনা হতো। প্রথম সন্তান শরিফুল। কত স্মৃতি, কত আদর জড়িয়ে আছে ছেলেটার গায়ে। অথচ অপছন্দের মেয়েকে বিয়ে করায় তোবারক তাড়িয়ে দিয়েছে ছেলেকে। প্রথম প্রথম তোবারকের মনে হতো, ছেলে ফিরে আসবে। অল্পদিনের ভেতর তার রাগ মুছে যাবে। যেভাবে স্লেট থেকে মুছে যায় চকের দাগ। এ তো সেই ছেলে, হাটের দিন আব্বার কাঁধে চড়ে হাটে যেতে না পারলে ধুলোয় গড়াগড়ি দিতো। কেঁদে মাথায় তুলত পাড়া। এই ছেলে কি আব্বাকে ছেড়ে থাকতে পারে! কিন্তু তোবারকের অঙ্কে ভুল ছিল। বইয়ের অঙ্ক তো সে বোঝেই না, জীবনের অঙ্কেও কাঁচা। সে বোঝেনি, এই শরিফুল আর কাঁধে ওঠা শরিফুলের ভেতর দুই যুগের ব্যবধান। শরিফুল ফেরেনি। তিন বছর পার হয়ে গেলেও শরিফুল ফেরেনি। তখন ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হতে থাকে তোবারক। তার এই দগ্ধ বুকের ঘা আরো বাড়িয়ে দেয় নবিসন। প্রায়ই সে বলে, খোঁটা দেয়ার মতো করে বলে, তুমার জন্নি, খালি তুমার জন্নি ছাওয়াল থাকতিউ আজ আমি ছাওয়ালহারা। জানিনে খুকা আমার কুথায় আছে, ক্যাম্মা আছে! বউয়ের বিলাপে তোবারক আলির অনুশোচনা একগুণ দুইগুণ হতে হতে বহুগুণ বেড়ে যায়। আর তখন অপরাধবোধের তাড়নায় কাউকে কিছু না বলে সে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল ঢাকার পথে, ছেলের খোঁজে। কারণ, সে শুনেছে, এই দেশে যারাই বাড়িছাড়া হয়, ঢাকায় গিয়ে ওঠে। এমনি এক মহাআশ্রয়দাতা ঢাকা। কিন্তু সে জানত না, ঢাকা ছোট্ট কোন শহর নয়। সেখানে ঠিকানা ছাড়া মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। একশটা ছুটিপুর অনায়াসে ঢুকে যাবে ঢাকার পেটে তবু তার তেষ্টা মিটবে না। জানলে সে হয়ত এই বোকামিটা করত না। এবং এই সফরে বিস্ময়কর সেই মানুষটার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল তোবারকের। সে-কথা আসছে।
কুষ্টিয়া টার্মিনাল থেকে তোবারক আলি দৌলতদিয়ার বাসে চড়েছিল। দৌলতদিয়া নেমে লঞ্চে পাটুরিয়া ঘাট পার হয়ে বিআরটিসি বাসে পৌঁছে যাবে গাবতলি। রাস্তায় পরিচিত হওয়া এক লোক এভাবেই তার ঢাকা গমনের পথ এঁকে দিয়েছে। দৌলতদিয়া নেমে তোবারক আলি পেটের অসুখে পড়ে। বাসে তিন টাকা দিয়ে টক হয়ে যাওয়া একটা সিঙ্গারা সে খেয়েছিল ক্ষুধার তাড়নায়। সম্ভবত এই পচা সিঙ্গারা পেটের ভেতর গিয়ে শিংঅলা দানব হয়ে পেটের দেয়ালে ঘাই মারছে। তা না হলে এত ব্যথা উঠবে কেন পেটের ভেতর। পেটের ব্যথায় তোবারক নাম না জানা একটা গাছের নিচে পেট চেপে ধরে বসে থাকে। অথবা গাছের নামটা সে জানে। পেটের যন্ত্রনায় ভুলে গেছে কিংবা খেয়াল করেনি। তোবারক আলি আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে, তার যেন পায়খানা না চাপে। কারণ এই বিদেশ-বিভূইয়ে পায়খানার উপযুক্ত জায়গা তার চোখে পড়ছে না। এই বিপদের কালে একটা অপরিচিত মানুষ এসে দাঁড়ায় তার পাশে। এমন একটা লোকের সত্যিই খুব দরকার ছিল তখন। সে তোবারকের মাথায় হাত দিয়ে বলে, কী হয়েছে চাচা!
বসা তোবারক মাথা তুলে লোকটাকে দেখে নিয়ে বলে, প্যাটব্যতা।
লোকটা আন্তরিকতা নিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী খেয়েছেন?
তিন টাকার টক সিঙ্গারা।
লোকটা তখন তোবারককে বসিয়ে রেখে এক দৌড়ে ছুটে যায় একটা ফার্মেসিতে। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ আর এক গ্লাস পানি এনে তোবারকের হাতে দিয়ে বলে, এই ওষুধটা খেয়ে নেন। ব্যথা সেরে যাবে ইনশাআল্লাহ।
ঘটনা বড় রহস্যময় লাগে তোবারকের। সে ধারণা করে, এই অঞ্চলের মানুষ বোধহয় এমনই। পেট ব্যথা কম হলে সে লোকটাকে জিজ্ঞেস করে, আপনে কিডা!
লোকটা বলে, আমার নাম সিদ্দিক। ঢাকায় থাকি। ছুটিতে গ্রামে আসছিলাম। এখন ফিরে যাচ্ছি।
আমার উপকার কল্লেন যে!
মানুষ তো মানুষেরই জন্যে। আপনার বিপদে আজ যদি আমি এগিয়ে না আসি কাল আপনি কি আমার বিপদে এগিয়ে আসবেন! আসবেন না। তাছাড়া আমাদের নবীজি বলেছেন, কেউ যদি সকাল বেলা একটা অসুস্থ মানুষকে দেখতে যায়, সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর কেউ যদি সন্ধ্যাবেলা একটা অসুস্থ মানুষকে দেখতে যায়, সকাল পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। বলুন, আপনার কাছে এসে কি আমি খারাপ করেছি!
তোবারক আলি চোখ বড় বড় করে এবার লোকটাকে দেখতে থাকে। হ্যাঁ, ভুল সে দেখছে না। এই লোকই নবীর কথা বলছে। তোবারক এতদিন জেনে এসেছিল, যাদের মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি, গায়ে জুব্বা, হাতে তসবি থাকে– এরাই খালি নবীর কথা বলে। কিন্তু সিদ্দিক নামের এই লোকের মাথায় না টুপি আছে, না মুখে দাড়ি আছে। তোবারকের ঘোর যেন কাটতে চায় না। ঠিকানা হারিয়ে ফেলা কিশোরের মতো সে কেবল আমতা আমতা করতে থাকে। সিদ্দিক জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবেন আপনি?
সিদ্দিককে বড় আপন মনে হয় তোবারকের। সে সব কথা খুলে বলে সিদ্দিককে।
সিদ্দিক এবার বড় সতর্ক হয়ে ওঠে। বলে, আপনি এইভাবে ছেলেকে খুঁজতে কখনোই ঢাকা যাবেন না, চাচা। ঢাকা কোন ছোট শহর নয়। ঠিকানা ছাড়া সেখানে কোন মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তার উপর আপনি বয়স্ক মানুষ। ঢাকায় নির্ঘাত কোন বিপদে পড়বেন। তোবারক তবু গাঁইগুঁই করে। কিক্তু সিদ্দিকের দৃঢ়তার মুখে মাঝপথ থেকে ফিরে আসে তোবারক। সঙ্গে নিয়ে আসে এক টুকরো বিস্ময়। সে ভাবে, এই মসজিদের ইমাম সাহেব কি নবীর সেই হাদিসটা জানে না, যেটা বলেছিল সিদ্দিক, বারো বছর আগে, ঢাকায় যাওয়ার পথে, দৌলতদিয়া বাস টার্মিনালে!

একদিন সকালে মসজিদের জানালা দিয়ে ভেসে আসে মাংসের ঘ্রাণ। ঘ্রাণ বলে দেয়, মশলাপাতি দিয়ে খুব যত্ন নিয়ে রান্না করা হয়েছে মাংস। এলার্জির রোগি হঠাৎ রোদে গেলে যেমন চামড়া চিড়বিড় করে ওঠে, তোবারকের পেটের ভেতরটাও অমন চিড়বিড়িয়ে ওঠে ক্ষুধায়, মাংসের সুবাস পেয়ে। নবিসনকে সে হাত ইশারায় ডাকে। নবিসন প্রথমে টের পায় না। সে ঘরের বাইরে হাতের তালুর মতো এক টুকরো উঠোন ঝাঁট দিচ্ছিল তখন। তোবারক দুর্বল হাতে চোকির উপর দুটো ঘুসি মারে। ধুম করে শব্দ হয়। নবিসন ঝাঁটা ফেলে ছুটে আসে ঘরে, স্বামীর কাছে– কী হইছে?
গোশ রানছে কারা? খুব বাস্না বারাইছে।
মসজিদি তবলিগ আইছে। তাগোর গোশ।
তোবারক তার তেল চিটচিটে বালিশের মতো চ্যাপ্টা পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, কতকাল গোশ খাইনে!
গোশ খাওয়া লাগবিনেন। গোশের বাস্না পাচ্ছ এই ম্যালা! নবিসন মুখ ঝামটা দিয়ে বেরিয়ে যায়। তার অনেক কাজ।
তোবারক ভাবে, সময় ফুরিয়ে গেলে কি স্বামীরা অসহ্য হয়ে ওঠে বউদের কাছে!
রাতে তোবারকের জ্বর বেড়ে যায়। খুশখুশানি কাশিটাও। নবিসন বালতি ভরে পানি এনে তোবারকের মাথায় ঢালে। দীর্ঘ সময় রোদের তাপে পুড়তে থাকা পানির মতো গরম হয়ে ওঠে মাথাধোয়া পানি। সেই পানির স্পর্শে নাবিসনের বুকের ভেতরটা কেমন কেমন করে। জ্বরে লোকটা এতো পুড়ছে!
জ্বরের প্রকোপে সেই রাতে এক মুহূর্ত ঘুমাতে পারে না তোবারক। সারারাত কাতরায়। পাগলের মতো ছেলেদের নাম ধরে ধরে ডাকে। প্রথম প্রথম নবিসনের খুব মায়া লাগে মানুষটার জন্য। বালিশের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। গামছা ভিজিয়ে মুখ-গলা-বুক মুছে দেয়। ভেজা গামছার স্পর্শে তোবারকের একটু আরাম লাগে। জট পাকিয়ে যাওয়া মাথাটা একটু খোলাসা হয়। তখন আড়াল থেকেও সে টের পায়, মসজিদে ইশার নামাজ শেষ হয়েছে। তাবলিগের লোকেরা ফাজায়েলে আমাল থেকে তালিম করছে। একজন উঁচু গলায় হযরত আবু হুরায়রার ক্ষুধার কাহিনি পড়ছে। আবু হুরায়রা ক্ষুধার তাড়নায় বেহুঁশ হয়ে মসজিদে নববিতে পড়ে থাকতেন। আর মানুষেরা পাগল ভেবে তাকে মাড়িয়ে চলে যেত– এমন কাহিনি। শ্রোতাদের কেউ কেউ আবু হুরায়রার দুঃখে আহ করে ওঠে। তালিম শেষ হলে তারা খাওয়ার আয়োজন করে। মসজিদের ভেতর থেকে ভেসে আসে জগ-গ্লাস-প্লেট নাড়াচাড়ার টুঙটাঙ আওয়াজ আর খাবারের সুবাস। যিনি তালিম করছিলেন, খেতে খেতে বলেন, ইব্রাহিম সাব, কাল সকালে আমি উত্তরপাড়ায় যাব। সেখানে আমাদের তিনচিল্লার এক সাথীভাই আছে। খুব অসুস্থ। তাকে দেখতে যাব। আপনি থাকবেন আমার সাথে।
তোবারক ভাবে, হায়, সেও যদি তাবলিগে সময় দিত, আজ এই মানুষগুলোর সাহায্য সে নিশ্চয় পেতো।
তাদের খাওয়া শেষ হয়। কেউ একজন প্লেট ধোয়া পানি জানালা দিয়ে ফেললে তোবারকের টিনের বেড়ার উপর এসে পড়ে। তোবারকের মনে হয়, এঁটো পানি তার বেড়ায় নয়, বুকের উপর এসে পড়ল। এবং তার পরপরই তোবারকের কাতরানি বেড়ে যায়। নবিসনের এবার রাগ হয়ে যায়। জ্বর মানষির হয় না! এতো চিল্লও ক্যাঁ! মসজিদ ভরা লোক, তারা শুনলি কী মনে করবি! যত্তসপ!
এতক্ষণ সে কপালে জলপট্টি দিচ্ছিল। পট্টি সরিয়ে সে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ে গজগজ করতে করতে। সারাদিনের পরিশ্রমের পর শোয়ার সাথে সাথে তার ঘুম এসে যায়। চোকির উপর একলা শুয়ে থাকে তোবারক। চোখের কোণা বেয়ে তার জল গড়ায়। গলা দিয়ে বেরোয় কাতরানি। বড় ছেলেটার কথা মনে পড়ে। ছোট ছেলেটার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে নবিসনের সাথে বিয়ের প্রথম দিনগুলোর কথা। তখন কত প্রাণময় ছিল জীবন। গতরে শক্তি ছিল। ইনকাম করত। ভাত-কাপড়ের অভাব ছিল না। খালি মুখে ঘুমোতে হয়েছে এমন কোন রাত আসেনি। একটু গুড়মুড়ি কিংবা একটু চিড়ে হলেও প্লেটে সাজিয়ে দিতো নবিসন। অথচ আজ সামান্য রাগে নবিসন শুয়ে পড়ল না খেয়ে। তোবারককেও বলল না খাওয়ার কথা।
জ্বরের সাথে লড়াই করে করে শেষরাতে তোবারক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আগুন-গরম গা। ধান ফেললে খই ফুটে যাবে অবস্থা। জ্বরের ঘোরে সে প্রলাপ বকতে থাকে। কয়েকবার নবিসনকে ডাকার চেষ্টা করে পানি খাবে বলে। কিন্তু গলার ভেতর যেন গাবের কষ, আওয়াজ বের হয় না। তাবলিগের লোকেদের তাহাজ্জুদের ওযু বানাতে টিউবয়েল জেগে উঠলে রাতের নীরবতা ভেঙে পড়ে, খানখান হয়ে যায়। টিউবয়েলের শব্দ তোবারকের পর্দাপড়া মস্তিষ্কে আছাড় খেয়ে তার পানির পিপাসা দ্বিগুণ করে দেয়। তার মনে হতে থাকে, সে মারা যাচ্ছে অথচ মুখে পানি দেয়ার লোক নেই, কানে আল্লাহর নাম দেয়ার মানুষ নেই। সে বড় শঙ্কিত হয়ে পড়ে। বেঈমান হয়ে মরার ভয়ে তার বুকের ভেতরটা আছাড়ি বিছাড়ি করে। ঠিক তখন, কেউ একজন খুব মিষ্টি সুরে কোরআন তেলাওয়াত শুরু করে মসজিদে। এমন মধুর সুর আগে কখনো শোনেনি তোবারক। হাওয়ায় দোলা ধানক্ষেতের মতো সুরের মিষ্টি ঢেউ তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সে তখন স্বস্তি পায়। ভাবে, মসজিদের পড়শি হওয়ার কারণে সে মৃত্যুর আগে আল্লাহর কালাম শুনে যেতে পারছে।

05/03/2023

গণ্ডগ্রাম বলেই আলোনগরে তাড়াতাড়ি রাত নামে। আটটা নয়টার ভেতরে খেয়েদেয়ে সবাই বিছানায় যায় আর সুনশান কবরের নীরবতা নেমে আসে জনপদে।

যাদের জীবনে রাত নামে তাড়াতাড়ি তাদের ভোরও আসে তাড়াতাড়ি। এটাই তো নিয়ম।

অন্তত আলোনগরের জীবনযাত্রা দেখলে তা-ই মনে হয়। খুব ভোরে সূর্য ওঠার আগেই এরা জেগে ওঠে।

চোখ ডলতে ডলতে নেমে পড়ে প্রতিদিনকার কাজে। মুরব্বিরা ওজু করে মাথার টুপি ঠিক করতে করতে মসজিদে যায়। ফিরে এসে গোয়াল থেকে গরু বার করে। চাড়িতে দানাপানি দেয়। মহিলারা রান্নার প্রস্তুতি নিতে চুলোর বাসি ছাই মালসায় তোলে। সেগুলো ছড়িয়ে দেয় ওলগাছের গোড়ায়। নতুন দম্পতির ফরজ গোসল করি করি করে আলসেমিতে আর করা হয়ে ওঠে না। সূর্য উঠে যায় গোসলের আগেই। উঠতি যুবক ছেলেরা গালের ভেতর ব্রাশ গুঁজে কোচিং সেন্টরের রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। যদি দু’একটা সুন্দরী মেয়ের দেখা মেলে!

কিন্তু একবার এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে গেল। মুরব্বিরা ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখে, ঘোর অন্ধকার। এমন কখনওই হয় না। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব লম্বা মোনাজাত ধরে। রব্বিরহামহুমা কামা রব্বাইয়ানিস সগিরা। সুরে সুরে মোনাজাত। এই মোনাজাতের ফাঁকেই চরাচর ফর্সা হতে শুরু করে। মসজিদের ভেতরে কাপড়ের রঙ দেখেই বলে দেয়া যায়—কে ছলেহ আর কে আব্দুল কুদ্দুস। এইবার মসজিদের বাইরে এসেও ঘোর অন্ধকার দেখে মুসল্লিরা ভাবে, নির্ঘাত নামাজ আধঘণ্টা আগে পড়া হয়ে গেছে ভুলক্রমে। কিন্তু এই ভুলের জন্য কেউ কোনও কথা বলে না। বাড়ি গিয়ে বউয়ের পাশে আরও আধঘণ্টা শুয়ে থাকার সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায় না। কিন্তু বাড়ি গিয়ে তারা হতাশ হয়। কারণ তাদের বউরা ইতোমধ্যে বিছানা ছেড়েছে এবং কোমরে আঁচল গুঁজে উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে। বউদের এই কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্ম দেখে তারা বিরক্ত হয়। তাদের ভেতর যারা রাগী এবং বউকে ভয় পায় না—তারা তাদের বউদের ধমক মারে। বউরা জানায়, তারা ঠিক সময়েই বিছানা ছেড়ে কাজে লেগেছে। তাদের আন্দাজ ঘড়ির কাঁটার চেয়েও নিখুঁত। স্বামীরা তখন ধন্দে পড়ে যায়। তাদের চোখেমুখে বিস্ময়ের মানচিত্র দেখা দেয়। বউরা তাদের স্বামীদের আশ্বস্ত করতে বলে, ‘আকাশে হয়ত ম্যাগ করেছে তাই এমুন অন্দকার। ম্যাগ কাটে গেলি সপ ঠিক হয়ে যাবিনি। ’ কিন্তু স্বামীরা আশ্বস্ত হতে পারে না। তারা তাদের অভিজ্ঞ পুরনো চোখ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করে—‘ম্যাগের কুনু আলামতই নি আকাশে। তালি ঘটনা কী হতি পারে!’—তারা চিন্তিত হয়। এভাবে আরও খানিকটা সময় পার হয়। সূর্য ওঠে না। ইতোমধ্যে বেনামাজিরাও চোখ ডলতে ডলতে উঠে পড়ে। বাচ্চারা দুধ খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে। গোয়ালে গরু হাম্বা হাম্বা ডাক পাড়ে। মুরগির খোপে মোরগ-মুরগি পাখা ঝাপটায় আর কককক কককক করে। যাদের স্কুল আছে তারা বেশ আনন্দিত হয়। এমন ঘটনা প্রতি মাসে একবার কেন ঘটে না ভেবে আফসোস করে। দু’চারজন শিক্ষিত—যাদের বিজ্ঞানের ওপর আস্থা আছে—তারা মন্তব্য করে, ‘কোনও কারণে হয়ত পৃথিবীর ঘূর্ণন বন্ধ হয়ে গেছে, আর তাই ভূপৃষ্ঠের এই পার্শ্বটায় সূর্যের আলো পড়ছে না। ’ কিন্তু পৃথিবীতে এতবড় একটা ঘটনা ঘটবে আর বিজ্ঞান আগেভাগে কিছুই টের পেল না!—এ বিস্ময়ে তারা বিজ্ঞানকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে। হঠাৎ তাদের টেলিভিশনের কথা মনে পড়ে। টিভি নিউজে নিশ্চয়ই এহেন বিপর্যয়ের খবর এবং বিপর্যয়ের নেপথ্য কারণ ফলাও করে প্রকাশ করা হচ্ছে। যাদের ঘরে টিভি আছে তারা টিভির সুইচ অন করতে গিয়েই বুঝতে পারে, বিদ্যুৎ নেই। কখন থেকে নেই—কেউ বলতে পারে না। কারণ শীতের রাতে তাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়ে না। আলোনগরের বাইরে যাদের আত্মীয়স্বজন আছে—সেসব আত্মীয়দের খবর নেয়ার জন্য কেউ কেউ মোবাইল হাতে তুলে নেয়। নাম্বার ডায়ালও করে। কিন্তু রিং হয় না। পুচকে ছেলে—যারা মোবাইলের নাড়িনক্ষত্র সব বোঝে—তারা বিজ্ঞের মতো জানায়, ‘নেটওয়ার্ক নেই। নেটের একটা দাগও দেখা যাচ্ছে না। ’ কেউ কেউ তখনই পাশের গাঁয়ের খবর নিতে সাইকেলের সিটে পাছা লাগায়। প্যাডেল চাপে। কিন্তু আলোনগরের শেষসীমায় পৌঁছে তারা হতবাক হয়। গভীর এক জঙ্গলে পথ শেষ হয়ে গেছে। কাঁটাযুক্ত বৃক্ষে ভর্তি সেই জঙ্গল। তারা কাঁপতে কাঁপতে ফিরে আসে জনপদে। কেউ কেউ সাইকেল নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে যায় পানির ডোবায়। এইবার সবার দুশ্চিন্তা দ্বিগুণ হয়। একসাথে এত অস্বাভাবিক ঘটনায় তারা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। কার্যত তারা এখন অন্ধকার কবরের বাসিন্দা। সেখান থেকে বের হওয়ার, বাইরের পৃথিবীর খোঁজখবর নেয়ার কোনও অবলম্বন তাদের নেই।

ইমাম সাহেব এবং কতিপয় ধার্মিক লোক জানায়, এ হলো আল্লাহতায়ালার গজব। মানুষের হাতের কামায়। ইমাম সাহেব একটা আয়াতও শুনিয়ে দেয়, ‘যহারাল ফাসাদু ফিল বার্রি ওয়াল বাহরি বিমা কাসাবাত আইদিন নাস। ’ অর্থাৎ ‘জলে এবং স্থলে যা-কিছু বিপর্যয় ঘটে সব মানুষের হাতের কামায়। ’ ইমাম সাহেবের কথা সবাই খালেছ দিলে বিশ্বাস করে। এমনকি কলেজপড়া ইলিয়াস—যে কিনা মাঝেমাঝে আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে খতরনাক কথা বলে—সেও ইমাম সাহেবের হাত চেপে ধরে বলে, ‘এখন তাহলে উপায়!’

কাউকে বলে দিতে হয় না, ধীরে ধীরে গ্রামবাসী ইস্কুলমাঠে জড়ো হয়। তারা আজ ঘোরতর বিপদে নিমজ্জিত। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে প্রয়োজন সম্মিলিত পরামর্শ। ইস্কুলমাঠে সবাই এসেছে। আসেনি শুধু আলোনগরের দুই মাতব্বর—ফরহাদ গাজি আর টিপু সুলতান। অথচ আজকের এই দুর্দিনে গাজি আর সুলতানকেই পাশে দরকার তাদের। কিছু কথা কাটাকাটির পর গ্রামবাসী দু’ভাগে ভাগ হয়ে একভাগ যায় গাজির বাড়ি, আরেক ভাগ যায় সুলতানের বাড়ি। গাজির একতলা বাড়ি। তেলের ব্যবসায়ী। বাড়ির সাথেই তার তেলের গোডাউন। আলোনগরে সে-ই বেশি পয়সার মালিক। সুলতানের অবস্থাও খারাপ না। মাঠে তার অনেক জমি। জমির ফসলে দিন চলে যায় রাজারহালে।

গ্রামের অর্ধেক মানুষ যখন গাজির কাছে বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে সাহায্য চায়, গাজির ভেতর প্রভুসুলভ আত্মগরিমা উদ্ভাসিত হয়। সে গদিআঁটা চেয়ারে বসে পা নাচায় আর সিগারেট টানে। লোকেরা তার সামনে নতজানু হয়ে বসে পড়ে। গাজির কাজের ছ্যামড়া লোকদের মাঝখানে মাঝখানে কেরোসিনের বড় বড় বাতি রেখে যায়। গাজি সবার দিকে নজর বুলায় আর সিগারেট টানে। সে বুঝতে পারে, গ্রামের সব লোক উপস্থিত হয়নি। বাকিরা কোথায়? ভরাট স্বরে সে জিজ্ঞেস করে, ‘আর সব কোনো?’ উপস্থিতদের একজন নেতৃত্বসুলভ ভঙ্গিতে বলে, ‘আর সবাই সুলতানের কাছে গেছে। ’ গাজির মোটা ভুরুতে এবার গিঁট পড়ে। সে চড়া গলায় বলে, ‘সুলতানের কাছে তাদের কী?’ আগের জন উত্তর দেয়, ‘আমরা যেজন্য আপনের কাছে আইছি তারাও সেজন্য সুলতানের কাছ গেছে। ’ গাজি এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ক্রুদ্ধ চেহারায় পায়চারি করে। বাতির লকলকে আগুনের ছায়া তার মুখে পড়ে। গ্রামবাসী গাজির এই আকস্মিক পরিবর্তিত মুখচ্ছবির শানেনুজুল খুঁজে পায় না। তারা ভয় আর কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে গাজির দিকে। গাজি হঠাৎ হুঙ্কারই যেন ছাড়ে, ‘এই বিপদে আমি তুমাদের সাহায্য কত্তি পারব না। তুমরা সুলতানের কাছে যাও। আমার কাছে কেন আইছ?’ গ্রামবাসী এবার গাজির ক্রুদ্ধতার শিকড়ের সন্ধান পেয়ে যায়। তারা কাঁচুমাচু আর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ওদিকে সুলতানের বাড়িতেও একই ঘটনা ঘটে। সুলতান অভিমানী কণ্ঠে বলে, ‘তুমাদের আমার কাছে কিডা আসতি বলছে। তুমরা গাজির কাছে যাও। এই বিপদে গাজিই তুমাদের ভরসা। গ্রামবাসী অশিক্ষিত হলেও বুঝতে পারে, এই বিভক্তি অনুচিত কাজ হয়েছে। অতঃপর দু’দলই গাজি আর সুলতানের সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকে। তাদের নিচু মাথা দুই মাতব্বরের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেয় যে, তারা অনুতপ্ত। দুইদলে বিভক্ত হয়ে দুই নেতার কাছে যাওয়াটা তাদের ঘোরতর অন্যায় হয়েছে। গাজির সামনের লোকেরা তাদের শরীরী ভাষা দিয়ে বোঝায়, সবার একসাথে গাজির কাছে আসা উচিত ছিল। সুলতানের সামনের লোকেরা বোঝায়, যারা গাজির কাছে গেছে তারা বিরাট অন্যায় করেছে। সবার একত্রে সুলতানের কাছে আসাটাই ছিল কল্যাণকর। এরপর স্পষ্টতই গ্রামবাসী দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একদল গাজির আরেক দল সুলতানের। গাজি এবং সুলতান দু’জনই আনুগত্যশীল দুটি গোষ্ঠী পেয়ে সন্তুষ্ট হয় এবং যে যার গোষ্ঠীকে সাধ্যের মধ্যে সকল প্রকার সুবিধা দেয়ার আশ্বাস দেয়। গ্রামবাসী ঘরে ফিরে আসে।

সূর্য ওঠা বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে আলো এবং খাদ্যের। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ কৃষক। নিজেদের জমি চাষ করে খাবার জোটায়। কিন্তু জনপদ অন্ধকারে ডুবে থাকায় তাদের ক্ষেতের কাজ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে তাদের আয় রোজগার, খাবারদাবারও বন্ধ হয়ে গেছে। আলোনগরের প্রতিটি মানুষই বিপর্যয়ের শিকার। এমতাবস্থায় নিজ নিজ আনুগত্যশীল গোষ্ঠীর দিকে এগিয়ে আসে গাজি আর সুলতান। অন্ধকার দূর করতে গাজি তার লোকদের বিনামূল্যে কেরোসিন তেল বিতরণ করে। সবার বাড়ি বাড়ি মশাল জ্বালিয়ে দেয়। বন্ধ হয়ে যাওয়া গেদুর চায়ের দোকান ফের চালু হয় গাজির উদ্যোগে। দোকানে দুটো মশালের ব্যবস্থা করা হয়। এই দোকানে বসে চা খেতে পারবে শুধু গাজির আনুগত্যশীল লোকেরা। তারা চা খাবে আর গাজির সুনাম করবে। সুনাম বয়ে নেয়ার জন্য লোকও ঠিক করে রেখেছে গাজি। কেউ গাজির দুর্নাম করলে তাকে দোকান থেকে খেদিয়ে দেয়া হবে। সূর্য না-ওঠায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে আছে। গাজির উদ্যোগে বন্ধ হওয়া ইস্কুল আবার চালু হয়। ইস্কুলে ক্লাশটাইমে মশাল জ্বালানো হয়। এই ইস্কুলে পড়বে শুধু গাজির অনুগত লোকদের সন্তান।

ওদিকে সুলতানও বসে নেই। সে তার লোকদের খাদ্যাভাব দূর করতে গোলার ধান বিতরণ করে। বাড়ির সাথে একটা হোটেল খোলে। সেখানে স্বল্পমূল্যে ডালভাত পাওয়া যায়। যারা একেবারেই গরীব তাদের কোনও পয়সাই লাগে না। শর্ত শুধু একটা, লোকদের মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে—সুলতান তাদের সুখে রেখেছে। সুলতান তার আনুগত্যশীল গোষ্ঠীর সন্তানদের পড়াশোনার জন্য বাড়ির সাথে একটা ইস্কুল খোলে। সবাই মারহাবা দেয়। সুলতান শিক্ষানুরাগী। ইস্কুলের অবকাঠামোগত উন্নতি সাধিত হলেও পড়াশোনা শুরু করা যায় না। কারণ সুলতানের ভাণ্ডারে কেরোসিন নেই। আলোর অভাবে পাঠদান ব্যাহত হয়।

কিছুদিন যেতেই গাজির লোকদের ভেতর অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। গাজি পথ দেখার জন্য আলো দিয়েছে কিন্তু পেট চালানোর জন্য খাবার দেয়নি। শুধু আলো দিয়ে তারা কী করবে? কেরোসিন খাওয়া গেলেও না হয় কথা ছিল। দলের মধ্যে ভাঙনের সুর শোনা যায়। কেউ কেউ খাবারের লোভে সুলতানের দলে ভেড়ার চিন্তাভাবনা শুরু করে। সুলতানের লোকদের ভেতরেও সমস্যা। শুধু খেয়ে মানুষ বাঁচে না। অন্ধকারে তারা বউয়ের মুখটাও দেখতে পায় না। বাচ্চাদের পড়াশোনা বন্ধ। সুলতানের দলের ভেতরেও ভাঙনের আভাস। সুযোগ পেলেই কেউ কেউ ভিড়ে যেতে পারে গাজির ঘাটে।

এইসব গুজবের ভেতরেই একরাতে গাজির তেলের গোডাউন আক্রান্ত হয়। কারা যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তেলের ড্রামে। সেই আগুনে পুড়ে যায় গাজির একতলা বাড়ির একাংশ। গাজির ইস্কুলঘর, গেদুর চায়ের দোকানেরও একই পরিণতি বরণ করতে হয়। পুড়ে সব কয়লা। এর পরের রাতে আক্রান্ত হয় সুলতানের খাদ্যের গোলা, খাবার হোটেল। বাতাসে ধান আর সবজি পোড়ার গন্ধ ভাসে। ঠাস ঠাস করে ফোটে বাঁশের তৈরি ইস্কুলবেঞ্চ। সুলতান দোষ দেয় গাজির। গাজি দোষারোপ করে সুলতানের। কে বা কারা এসব করছে সাধারণ মানুষ ঘেঁটে দেখে না। তারা শুধু টের পায়, আবার তারা বঞ্চিত হলো সকল সুযোগ সুবিধা থেকে। তারা আবার ইস্কুলমাঠে একত্রিত হয়। তাদের চেহারায় হতাশা খেলা করে। সবাইকেই নিজ নিজ বয়সের চেয়ে বেশি বয়স্ক লাগে। বুড়োরা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তারা ঘাসের উপর কুঁজো হয়ে ঠেসে বসে। যুবকরা কী নিয়ে যেন উত্তেজিত। তাদের কথা ভেসে আসে। কিন্তু তারা কী বলে বুড়োদের কান পর্যন্ত স্পষ্ট পৌঁছে না। হঠাৎ এক আগন্তুকের আবির্ভাব ঘটে ইস্কুলমাঠে। এর আগে কখনওই দেখা যায়নি তাকে। আগন্তুকের আগমনে কোলাহল থেমে যায়। আগন্তুক সবার সামনে এসে সটান হয়ে দাঁড়ায়। তার পিঠের ঝোলা দেখে ফকির ফকির লাগে। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হয় সে বড়মাপের সাহেব। লাল-ফর্সা গায়ের রঙ। চামড়ার নিচেই যেন বেদানার রস। ছুঁয়ে দিলে চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসবে রক্ত। গায়ের চামড়ার মতো মাথার চুলও লালচে সাদা। কাপালের ওপর বেশ কয়েকটা ভাঁজ। এমন চেহারার মানুষ আলোনগরের কেউ কোনওদিন দেখেনি। চরম হতাশার সময়ও তারা আগন্তুকের ব্যাপারে যথেষ্ট কৌতূহল দেখায়। আগন্তুক ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, ‘আমি জানি তোমরা চরম বিপদের ভেতর আছো। আমি এসেছি তোমাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে। আমি তোমাদের জনপদে ফের সূর্য ওঠাব। তোমরা আবার নির্বিঘ্নে চাষ করতে পারবে। তোমাদের বাচ্চাদের পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি হবে। তোমরা খাদ্যের অভাব দূর করতে সক্ষম হবে। ’

আগন্তুকের কথায় মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফিঁসফিঁসানি ক্রমেই কোলাহলে রূপ নেয়। বুড়োরা বলে, ‘আমরা শান্তি চাই, সূর্যোর আলো চাই, খাবার চাই, ক্ষ্যাতে কাম করার সুযোগ চাই। হে আগুন্তুক আমরা বিরাট বিপদের মুদি আছি। আপনে আমারে রক্ষা করেন। ’

বুড়োদের কথা শুনে আগন্তুকের মুখে হাসি ফোটে। সে তৃপ্তি আর অহঙ্কার নিয়ে বলে, ‘আমিই তোমাদের রক্ষক। ’

তার কথা শেষ হওয়া মাত্র চিৎকার করে ওঠে যুবকেরা। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, ‘আমরা তোকে চিনিনে। তোর সাহায্যোর কুনু দরকার নি আমারে। আমরা মল্লি নিজিরা মরব, বাঁচলি নিজিরাই বাঁচপ। তুই কোন চ্যাটের বাল। তুই এখেনতে বিদায় হ। ’

13/02/2023
05/11/2022

আবু সুফিয়ান কালিমা পড়েছেন বটে, তবে তখনো তার চেহারায় সংশয়ের ঘোলাটে মেঘ দেখতে পেলেন নবিজি। তিনি বুঝতে পারলেন, হৃদয় থেকে অবিশ্বাসের পর্দা এখনো পুরোপুরি সরেনি তার। এই সংশয় দূর করতে পারে কেবল ইসলামের আভিজাত্য ও প্রতিপত্তি।

যে আভিজাত্য ও প্রতিপত্তি ধরে রাখতে লোকটা জীবনভর অন্ধের মতো বিরোধিতা করে গেছে ইসলামের। সেই তিনি যখন স্বচক্ষে দেখবেন, ইসলামের শক্তিমত্তা ও গৌরবগাথা কোরাইশদের গৌরবগাথাকে ছাড়িয়ে গেছে, তখন ইসলামের ওপর তিনি পূর্ণ আস্থাশীল হয়ে উঠবেন। আর একারণে চাচা আব্বাসকে বললেন, মুসলিম সেনাবাহিনী যখন মক্কায় প্রবেশ করবে, আবু সুফিয়ানকে যেন উঁচু কোনো টিলার ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ইসলামের এই বর্ণিল প্রত্যাবর্তনের দৃশ্য দেখার তার দরকার আছে।

একটু পর মক্কায় প্রবেশের উদ্দেশে মুসলিম কাফেলা তাঁবু গোটানো শুরু করল। আজ মুহাজির মুসলিমদের হৃদয়ে থইথই করছে আনন্দ। আকাশ থেকে চাঁদ নেমে এসে পায়ে লুটিয়ে পড়লেও এমন আনন্দ হতো না তাদের। যে মক্কার ধুলোবালির সাথে মিশে আছে তাদের বেড়ে ওঠার স্মৃতি, সেই স্মৃতির কাছে ফেরার দিন অবশেষে এল! এই দিনটির জন্যই তো তাদের সারা জনমের প্রতীক্ষা।

মক্কার পরিচিত একেকটি টিলা, একেকটি উপত্যকা, একেকটি কুয়া যেইনা ভেসে উঠছে সামনে, অমনি উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে সাহাবিরা। তাকবির ধ্বনিতে তারা মুখর করে তুলছেন চারপাশ। এই আনন্দঘন মুহূর্তে, বেলালের মতো সাহাবিরা, মক্কায় যারা সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত হয়েছিলেন, তাদের মানসপটে কি ভেসে উঠছে না নাভিশ্বাস তোলা সেই দুঃখের দিনের ছবি? হয়তো উঠছে। কিন্তু আজ তারা প্রতিশোধের কথা ভুলে থাকতে চায়। আজ ক্ষমার দিন। আজ ভালোবাসার দিন। আজ সবাইকে বুকে জড়িয়ে নেয়ার দিন।

মাতৃভূমি ফিরে পাওয়ার এই ঐতিহাসিক জমকালো মুহূর্তে সকলে যখন উৎফুল্ল, উদ্বেলিত; তখন আশ্চর্য ব্যতিক্রম আমাদের নবিজি। বিনয়ের আধার নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজ এতটাই শান্ত-স্নিগ্ধ-সৌম্য এবং অবনত মস্তক যে, তার দাড়ির প্রান্ত ছুঁয়ে যাচ্ছে উটনীর কুঁজ। যেন মক্কার স্বত্ব বুঝে নিতে এসে তিনি সীমাহীন লজ্জায় পড়ে গেছেন।

আজ বিনয় শুধু তার দেহ-সৌষ্ঠবেই নয়, বিনয় তার বচনেও। অপরিচিত এক লোক এই বিজয়ী সেনাপতির সামনে এসে যখন গলায় আটকে যাওয়া শব্দ নিয়ে থরথর করে কাঁপছিল, নবিজি তখন বললেন, ভয় পেয়ো না। শান্ত হও। আমি কোনো সম্রাট নই। আমি এমন এক কোরাইশ মায়ের সন্তান, যিনি মাংসের শুকনো টুকরো খেয়ে জীবন ধারণ করতেন।

ওদিকে আবু সুফিয়ান, যার বিশ্বাসের সংশয় দূর করবার নিমিত্তে বিশেষ এক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন নবিজি, তিনি আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে টিলার ওপর দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাসে দেখছিলেন ইসলামের অবিশ্বাস্য গৌরবযাত্রা। মক্কা যেন আজ নিরীহ বেলাভূমি, যার বুকে আছড়ে পড়ছে মুসলিম সেনাদের উত্তাল ঢেউ।

যখনই তার সামনে দিয়ে অতিক্রম করছে কোনো গোত্র, তিনি জিজ্ঞেস করছেন, এরা কারা?

আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু মুচকি হেসে বলছেন, এরা বনু সোলাইম গোত্র।

আবু সুফিয়ান বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলছেন, বনু সোলাইম মুসলমান হয়ে গেছে! ওই যে ওরা কারা?

ওরা তো বনু মুজাইনা।

ওরাও মুসলমান হয়ে গেছে!

একটু পর আনসার মুহাজিরদের পরিবেষ্টনের ভেতর দিয়ে নবিজি যখন অতিক্রম করলেন উপত্যকার পথ, আবু সুফিয়ান অবাক কণ্ঠে বললেন, আব্বাস, এরা কোন দল?

আব্বাস বললেন, ওই তো আমাদের রসুল চলেছেন।

ওহে আব্বাস, আল্লাহ তোমার ভাতিজার রাজত্ব বড় মজবুত করে দিয়েছেন।

এ রাজত্ব নয়। এ নবুওয়াতের সম্মান। তুমিও এখন মুসলিমদের এই সম্মানের ভাগিদার।

প্রিয় পাঠক, মক্কার এই শানদার বিজয়ের পূর্ণ গল্প আমরা অন্য কোনোদিন বলব। এই বইয়ে আমরা শুধু নবিজির মেধা ও বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে আলাপ করতে চাই। দেখুন, যুদ্ধের প্রচণ্ড ব্যস্ততার ভেতরও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ানের জন্য আলাদা ছক কষেছেন। তিনি ইসলামের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে আবু সুফিয়ানকে প্রভাবিত করতে চেয়েছেন। যেন হৃদয় থেকে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের সকল দুর্গন্ধ দূর হয়ে যায়।

আবু সুফিয়ানের জন্য নবিজির ব্যস্ত হয়ে ওঠার কারণ এটাই যে, আবু সুফিয়ান মক্কার সাধারণ কোনো নাগরিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন তৎকালীন মক্কার সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। আর নবিজি ভালো করেই জানতেন, নেতা যদি ইসলামের পথে এসে যায়, কর্মীরা আপনা আপনি প্রবেশ করবে ইসলামে। এই জন্যই নবিজি আবু সুফিয়ানকে এতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

Want your public figure to be the top-listed Public Figure in Kushtia?
Click here to claim your Sponsored Listing.

Videos (show all)

কীভাবে আপনার সন্তানকে মাদক থেকে ফেরাবেন? সাব্বির জাদিদ
বিদায়ী কথামালা।
বিদায়ী কথামালা।
রাগের মাথায় তালাক দিলে কি তালাক হবে?
তালাক প্রদানের সুন্নত পদ্ধতি কী?
হিলা বিয়ে অভিশপ্ত বিয়ে।
তিন তালাকের বিধানের ক্ষেত্রে ইসলাম কি কঠোরতা করেছে? এর পেছনে কারণ কী?
সাহাবিদের আবিসিনিয়া হিজরত।
১২ টি মাসনুন দোয়া।
সালামের সৌন্দর্য।
দুঃসংবাদে এবং বিপদে কোন দোয়া পড়তে হয়? এর মাধ্যমে আপনি কোন গুণ অর্জন করেন? জানা যাবে এই ভিডিও থেকে।
কওমে লুতের শাস্তি।

Category

Telephone

Address

Kushtia
700