Manush
Nearby media companies
Domkal
742226
Berhampore
742101
Murshidabad
742101
742101
742101
Murshidabad
742101
Berhampore
742101
742101
Baharampur Uttaran Samajer Mukhapatra, Phone No. 9800551372
নারী ও জল
✍️ কাবেরী বিশ্বাস
২০০ মিলিয়ন ঘন্টা = ৮.৩ মিলিয়ন দিন = ২২৮০০ বছর। সুকুমার রায় থাকলে বলতেন, কাক্কেশ্বর কুচকুচের মতো এসব আবোলতাবোল কিসের হিসাব লিখছ? না না, মোটেই আবোল তাবোল নয়। এ হল সময়ের হিসাব। কিসের সময়? মেয়েদের অপচয় হওয়া সময়। যে সময় পৃথিবীর এক বিরাট অংশের মেয়ে প্রতিদিন জল ভরতে, জল আনতে খরচ করে। তাদের সকলের একদিনের জল আনার সময় একত্রিত করে এই সময়ের হিসাব পাওয়া গেছে। ইউনিসেফ এই তথ্য দিয়েছে। একে বলছে ‘সময়ের বিপুল অপচয়।’ জল আনতে একটি মেয়ের প্রতিটি পদক্ষেপ তাকে ক্রমশঃ সরিয়ে নিয়ে যায় পড়াশোনা, খেলাধূলা আর নিরাপত্তা থেকে।
যুগে যুগে দেশে দেশে সংসারের জলের চাহিদা পূরণ যে শুধুমাত্র মেয়েদেরই কাজ।তাই তাদের জীবন থেকে বিপুল সময় জলে ভেসে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় শৈশব, কৈশোর, স্কুলজীবন, নানা বিষয়ে দক্ষতা কাজে লাগানোর সুযোগ, সোনালী ভবিষ্যৎ, সব। সব যায় জলে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের যৌথ কমিটি ২০২২ সালের রিপোর্টে জানিয়েছিল যে, পৃথিবীর ২.২ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানীয় জল পান না। এবছর বিশ্ব জল দিবসের থিম ‘শান্তির জন্য জল’। রাষ্ট্র সংঘ এই থিমের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রতিবেশী রাজ্যে রাজ্যে, দেশে দেশে জলের জন্য কত শত সংঘর্ষের কথা বলেছেন। কিন্তু আমি বলবো শুধু মেয়েদের কথা, বিশ্ব জুড়ে তাদের কাঁধেই সংসারের জল যোগানের গুরুভার। বাড়ীর মধ্যে, কাছে জল না থাকা তাদের কত অশান্তি, কত মানসিক, শারীরিক চাপে ফেলে দেয় সে কেবল ভুক্তভোগী মেয়েরাই জানে। ভারতের রাজস্থান, কর্ণাটক হোক বা আফ্রিকার ঘানা, সবাই একই অশান্তির শিকার। পূর্ণ বয়স্ক নারী আর বাড়ন্ত বালিকাদের উপর এর প্রভাব মারাত্বক। কারণ তারাই সংসারের জলের ভার বয়। তাদের শুধু হাঁটার কষ্ট বা সময় নষ্ট হয় তাই নয়, এই ভার আক্ষরিক অর্থে তাদের শরীর পঙ্গু করে দেয়। সাধারণ ভাবে জলের যে জেরিক্যান গুলো জল আনার জন্য ব্যবহৃত হয় তাতে ৫ গ্যালন জল ধরে, যার ওজন ভর্তি অবস্থায় ৪০ পাউন্ড (২০ কেজি)। বেশীর ভাগ সময় যা মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ভার তাদের ঘাড়, মেরুদণ্ড, কোমরের দফারফা করে দেয়। এছাড়াও বেশী ওজন তোলা, ভারী বোঝা নিয়ে উঁচু নীচু পথে হাঁটার ফলে জরায়ুর স্থানচ্যুতি বা জরায়ুর নেমে আসা খুব বেশী দেখা যায় এসব মহিলাদের মধ্যে (১৯%)। গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভস্থ সন্তানের বৃদ্ধি ও বিকাশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে, গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়ে। জরায়ূ নীচে নেমে আসলে মহিলারা অবর্ননীয় শারীরিক কষ্ট ভোগ করেন। এতে তাদের ওঠা-বসা, হাঁটা-চলা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। জল আনা, ঘরের কাজ করতে প্রচন্ড অসুবিধা হয়। সংসারের কাজে পরিবারের লোকরা সন্তুষ্ট না হলে জোটে লাঞ্ছনা গঞ্জনা। যারা অসুস্থ নয় তারাও তীব্র রোদে, গরমে হেঁটে, ঘেমে ঘেমে, শরীরে জলের অভাবে ধুঁকতে থাকে।তাতেও রেহাই পায় না। বাড়ী ফিরে সংসারের হাজারো কাজ সারতে সারতে রাত নামে। জলের যোগান কম থাকায় পরিবারের স্বামী সন্তানের প্রয়োজন মিটিয়ে অনেক সময় তারা তৃষ্ণা নিয়েই শুতে যায়।রাতে ঘুম হয় না। রাত তিনটে চারটেয় উঠে বেরিয়ে পড়তে হয় জল সংগ্রহে।
ঘানার একটি জায়গার একটি কমিউনিটিতে জলের লাইন বসেছে ২০১৮ সালে। তার আগে তাদের অভিজ্ঞতা তারা জানিয়েছে। আসুন দেখি –
প্রথম জন:- আমি ভোর সাড়ে চারটেয় উঠে জল আনতে যেতাম। দেরী হলে লম্বা লাইন পড়ে যেত, জল পেতাম না।
দ্বিতীয় জন:- কোন কোন দিন এত কম জল পেতাম যে বাড়ীতে রান্না হতো না।
তৃতীয় জন: আমাদের কেউ কেউ ছোট বাচ্চাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে যেতো। জলের ভারী পাত্র নিয়ে হাঁটার সময় বাচ্চা বেশী নড়াচড়া করলে সামলাতে গিয়ে জলের পাত্র পড়ে যেত। কষ্টে দুঃখে কেঁদে ফেলতো কেউ কেউ।
চতুর্থ জন:- দূর থেকে জল এনে ক্লান্ত হয়ে গেলেও সংসারের কাজ থেকে ছুটি মিলতো না। আমরা সবাই ঘাড়ে, কোমরের ব্যথায় অস্থির হয়ে থাকতাম।
শারীরিক পরিশ্রম বা অসুস্থতা ছাড়াও জল সংগ্রহ করতে গিয়ে মহিলা এবং বালিকাদের অন্য বিপদও কম নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, রাস্তায় বন্য পশুর আক্রমণ বা পশুরও অধম মানুষের হাতে যৌন নির্যাতনের ভয়ও কম নয়। সব থেকে করুণ অবস্থা বোধহয় আমাদের দেশের মহারাষ্ট্রের ডেঙ্গানমাল গ্রামের পানি বাঈদের। তারা বুঝি মানুষও নয়, শুধু বাড়ীর ট্যাপ কলের মতো এক পণ্য বা পরিষেবা। যা তারা শুধু দুমুঠো খাবার আর আশ্রয়ের বিনিময়ে গৃহস্থকে দিয়ে থাকেন। তারা গৃহস্বামীর বিবাহিত স্ত্রী পরিচয়ে সমাজে বাস করেন। যদিও প্রথম বা আইনত বৈধ স্ত্রী নন। দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ স্ত্রী। স্বামীর শয্যার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার কোন কিছুই নেই তাদের। আছে শুধু কাকভোরে উঠে কলসী মাথায় মাইলের পর মাইল রুক্ষ, পাহাড়ি পথে হাঁটা। ভারী বোঝা নিয়ে উঁচু নীচু, বিপদজনক পথে বাড়ী ফেরা। পা পিছলে গেলে, পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙলে তাদের অবস্থা কি হয় তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। অসুস্থ হলে, পঙ্গু হয়ে গেলে আশ্রয়দাতা, অন্নদাতা স্বামী আর একটি সক্ষম পানি-বউ ঘরে আনে। পুরুষ মানুষটির যুক্তি হল, গ্রামে কোনো জলের পাইপলাইন নেই, নেই অন্য কোন জলের উৎস। বৈধ প্রথমা স্ত্রীর যদি সারাদিন জল আনতেই কেটে যায়, তাহলে সংসারের বাকী কাজ, রান্নাবান্না, শিশু ও বয়স্কদের দেখভাল কে করবে? তারা তো সকাল হতেই জন খাটতে যায় অন্য কোথাও। তাই বহু বছর ধরে এই বহু বিবাহ প্রথা তাদের সমাজে স্বীকৃত। মনে প্রশ্ন জেগেছিল, পানি বাঈরা কেন এ জীবন বেছে নেয়! উত্তর পেয়েছি বিভিন্ন লেখায়। তারাই পানিবাঈ হয় – পণের জন্য যাদের বিয়ে হয়নি, পরিবারে যাদের উপস্থিতি অবাঞ্ছিত, যারা বিধবা, যারা আশ্রয়হীন একা মহিলা। সমাজ তাদের অমুকের স্ত্রীর শূন্যগর্ভ পরিচয়ে ভুলিয়ে নিজেদের দায়িত্ব সেরে ফেলে। তারাও ভোলার ভান করে। নইলে যে আরো ক্লেদাক্ত জীবন বেছে নিতে হবে। এ যেন মন্দের ভালো। একটি NGO এর উদ্যোগে ঘানার মেয়েদের কাছে জলের লাইন পৌঁছে গেছে। এখন তাদের মনে নেই চাপ, সংসারে এসেছে শান্তি।
আজ বিশ্ব জল দিবসে, পৃথিবীর সেই সব মানুষ যাদের কাছে এখনও নেই নিরাপদ জল, তাদের জন্য চাই নিরাপদ জল। শান্তি আসুক সবার ঘরে।
[2024-03-22]
#উত্তরণ_সমাজের_গণভাষ্য ~
বাসন্তী নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আনন্দে থাকুন। আনন্দম।
424 ব্রুণাব্দ
উত্তরণের গান
- কমলেন্দু ভট্টাচার্য
তোরা আসবি কে রে আয় রে আয়,
উত্তরণের উৎসবের ঊষায়;
উত্তিষ্ঠিত ভাবনাতে আজ জাগতে জীবন সাধনায়।
বিশ্বমানব কল্যানে আজ,
জাগুক এ মনুষ্য সমাজ,
সম্মুখে তার অজস্র কাজ চরৈবেতির চেতনায়।
বিজ্ঞানেরই সওয়ারী হয়ে
সত্য যা তা যাবি কয়ে,
কুসংস্কার যাক না ক্ষয়ে দূর হোক যত অন্তরায়।
কার্য-কারণ তত্ব জেনে
মানুষকে আজ আন না টেনে
সত্যনিষ্ঠ যুক্তি মেনে স্বচ্ছ আলোর আঙিনায়।
বিজ্ঞান তো সত্যেরই সাধন,
অন্তরে তা করো নিবন্ধন,
বিজ্ঞান মনস্কতায় রে মন ওঠ না নেচে ভোরবেলায়।।
Abdul Halim Biswas লিখেছেন –
ঝ্যা ঝ্যা ঝ্যারা রা রা ঢিস ঢিস ফুস ফুস ঝ্যারার ঝ্যারার ঝ্যা ঝ্যা......।
শব্দটা কিসের? বিদ্যালয়ের পেছনে ফাঁকা জায়গা আছে। এবার পরীক্ষার্থীরা সম্ভবত ঠান্ডার কারণে গাড়িতে আসছে। গাড়িগুলো ঐ ফাঁকা জায়গায় পার্ক করে রেখেছে। প্রাচীরের উপর দিয়ে তাকিয়ে দেখি জনা পাঁচেক পরীক্ষার্থী মোবাইলে ফ্রী ফায়ার খেলছে। পরীক্ষার তখনও আধঘন্টা দেরি!
আপনি অবাক হচ্ছেন? না, অবাক হবেন না। এটা ঘটনা, এটা সত্য। মোবাইল আর নিছক মুঠোফোন নাই। মোবাইলের তরঙ্গেই এখন মানব জীবনের স্পন্দন। মুঠো ভরা ভালোবাসা। জীবনে যাপনে মানুষের পূজার ফুল। মোবাইল ছাড়া মনুষ্য জীবন সাহারার মতো রুক্ষ, শুষ্ক, ধু ধু মরুভূমি।
আপনার চারপাশে তাকান। রেল স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, অফিস আদালত, খেলার মাঠ, গাছতলা, স্কুল কলেজ, ফাঁকা জায়গা সর্বত্র মোবাইল হাতে চৌদ্দ থেকে চব্বিশ বছর এক ঝাঁক কিশোর যুবক তন্নিষ্ঠ মনে মোবাইলে নিমগ্ন। এটা মৌতাত। নেশা। এ নেশায় সুখানুভুতি অর্গাজমের থেকেও বেশি।
লোকে চিৎকার করে, মোবাইল ঘেঁটে সব রসাতলে গেল! একদমই না। আজকের স্কুল কলেজের ছাত্ররা তনু মন গভীর আবেগ ও আকর্ষণে মোবাইলে কেন্দ্রভূত করে এমন আত্মহারা হয়ে থাকে, সমাজ সংসারে তাদের দ্বারা কোনো অশান্তি কলহ ঘটে না। যারা অশান্তি কলহ করে না, তাঁরা পুণ্যবান। আর সবাই জানি, পুণ্যবান ব্যাক্তিরা জান্নাত পায়!
তরুণের স্বপ্ন। নেতাজি রচনা সমগ্র। না, না , আমাদের তরুণের স্বপ্ন হলো মাননীয়ার মোবাইল স্কিম। দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া হয়। প্রত্যেকে দশ হাজার টাকা করে পায়। না, এখন আর করোনা নাই। তাহলে টাকা দেয়া হয় কেন? আমি আর্বাণ নকশাল বা বামপন্থী ফিচেল নই যে, কারণে অকারণে প্রশ্ন করব। টাকা দেওয়া হয় ঐ জান্নাত লাভের জন্যই।
বিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রী ছিল একশো একত্রিশ জন। দশ হাজার করে টাকা পেয়েছে একশো একত্রিশ জন। টেষ্ট পরীক্ষায় বসেছে ও ফরম পূরণ করেছে মাত্র অষ্ট আশি জন। বাকি তেতাল্লিশ জন টাকা নিয়ে কেটে পড়েছে। তারা কি জান্নাত পায়নি!
জান্নাতের সুখ, আহা, শরাবনদীর তীরে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে আয়েশ আরাম। মেওয়া, নাশপাতি, আপেল, কমলা, হাতের ডগায় কত ফল। চোখের সামনে হুর গেলেমান। জান্নাতের এমন সুখ পেতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে কেন? ঠিকই তো! অপেক্ষা করতে হবে কেন? সেকারণেই মাননীয়া ঘোষণা করেছেন, এবার মোবাইল দেওয়া হবে একাদশ শ্রেণিতেই।
নজরুল এমনি এমনি বলেছিল, আয় বেহেস্তে কে যাবি আয়! আপনিও কি জান্নাত পেতে চান? লেটস্ গো। ঝ্যা ঝ্যা ঝ্যা ঝ্যারা রা রা ঢিস ঢিস ফুস ফুস ফটাস.....।
[2024-02-07]
17-ফেব্রুয়ারি #ব্রুণো_দিবস......
আজ জাতীয় কুষ্ঠ দিবস
― ডাঃ আনোয়ার হোসেন
এই ছবি ও বার্তা আপনি যদি শেয়ার করেন ও দশ জনকে ফরোয়ার্ড করেন তাহলে দুই দিনের মধ্যে ভাল কিছুই ঘটবে না। অবহেলা করলে খারাপ কিছুই ঘটবে না। কিন্তু এর ফলে শতাব্দীপ্রাচীন কুষ্ঠ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আপনিও পা মেলালেন। প্রমাণ করলেন, অবৈজ্ঞানিক কিছু প্রাপ্তি নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতাই আপনার চালিকাশক্তির অন্যতম উৎস।
১) শরীরের যে কোনও জায়গায় ফ্যাকাশে, তামাটে বা লালচে রঙের অসাড় দাগ কুষ্ঠ রোগের লক্ষণ হতে পারে। এই দাগে চুলকানি ও ব্যথা থাকে না। এছাড়া হাতে পায়ে ঝিনঝিন, অসাড় ভাব, চকচকে তেলতেলে ত্বক এবং ত্বকে গুটিও কুষ্ঠ রোগের লক্ষণ হতে পারে। দেরী না করে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান। কুষ্ঠ রোগ নির্ণয় হলে বিনামূল্যে চিকিৎসা করান।
২) কুষ্ঠ কোনও 'পাপের ফল' বা বংশগত রোগ নয়। এটি একটি জীবাণুঘটিত রোগ যা হাঁচি কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। ছোঁয়াছুঁয়ি দিয়ে নয়।
৩) রোগ নির্ণয় দেরী হলে অঙ্গবিকৃতি সহ অক্ষমতাও দেখা দিতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা শুরু হলে এই রোগ সম্পূর্ণ সেরে যায়।
৪) ঘৃণা নয়। এই রোগ দ্রুত নির্ণয় ও চিকিৎসা করতে সাহায্য করুন।
#প্রকৃত_শিক্ষক_দিবস
সাবিত্রীবাই ফুলের জন্মদিন 3-জানুয়ারিই কি #শিক্ষক_দিবস হবার প্রকৃত দাবিদার নয়?
সাবিত্রীবাই ফুলে
-- স্বাতী ভট্টাচার্য
০৩-ই জানুয়ারি ১৮৩১ সালে, ১৮৯ বছর আগে এই দিনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি, যে ছিলেন সাবিত্রীবাই ফুলে।
সে এক মেয়ে ছিল, যে ভারতে প্রথম গার্লস স্কুল তৈরি করেছিল। তাও আবার ছোট জাতের মেয়েদের জন্য, যাদের পড়াশোনার কথা কেউ ভাবতে পারত না।
আঠেরো বছরের হেড-দিদিমণি ঘর থেকে বেরনোর সময়ে ব্যাগে রাখত বাড়তি শাড়ি। রাস্তায় এত লোক কাদা ছুড়ত, যে ইস্কুলে গিয়েই শাড়ি বদলাতে হত।
তাতেও শিক্ষা হয়নি মেয়ের। গর্ভবতী হয়ে-পড়া ব্রাহ্মণ ঘরের বিধবাদের ডেকে এনে ঠাঁই দিত ঘরে। যাদের কথা শুনলে আজও লোকে আঙুল দেয় কানে।
কিন্তু রোহিত ভেমুলার এই যুগে তাঁর মতো জ্যান্ত আর কে আছে? সনাতন হিন্দুত্বের যখন জয়জয়কার, ভ্যালেন্টাইন্স ডে শুনলে খেপে মারতে আসে লোক, দলিত লেখককে কুপিয়ে খুন করা হয়, তখন সাবিত্রীর জীবনকথা— এমনকী তার মৃত্যুর কথাও - চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় জাতীয়তা মানে কী, দেশপ্রেম কাকে বলে। কাকে বলে নারীর অধিকার, সমমর্যাদা। তাঁরই উদ্যোগে পুণে শহরে সব নাপিত হরতাল করে এক দিন। বিধবা হলেই মাথা কামাতে হবে মেয়েদের? মানব না।
সাবিত্রীবাইয়ের জীবন থেকে গোটা পাঁচেক সিরিয়াল, গোটা দুয়েক হিন্দি সিনেমা, আর কয়েক ডজন নাটক-উপন্যাস নামিয়ে ফেলা যায়।
ধরা যাক রাস্তায় হেনস্থার এপিসোডটা। শুধু কাদা নয়, পাথরও ছুড়ত লোকে। আটকাতে রাখা হল এক বডিগার্ড, বলবন্ত সখারাম কোলে। স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, সাবিত্রীবাই বলতেন, ‘তোমাদের গোবর, পাথর — আমার কাছে ফুল।’
যখন শুরু এ গল্পের, কোম্পানির সেপাইরা বিদ্রোহ করেনি। কলকাতায় বেথুন সাহেবের ইস্কুল তৈরি হয়নি। জেলায় জেলায় বালিকা পাঠশালা বিদ্যাসাগরের মাথায় একটা আইডিয়া মাত্র। সেই ১৮৪৮ সালে একটা একুশ বছরের ছেলে তার আঠেরো বছরের বউকে নিয়ে মেয়ে-ইস্কুল খুলে ফেলল পুণেতে।
ফল মিলল হাতে হাতে। বাবা বাড়ি থেকে বার করে দিলেন ছেলে-বউকে। জ্যোতিরাও ফুলে আর তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীবাই। ফুল থেকে ‘ফুলে’, মালির জাত। সোজা কথায়, দলিত। একে মালি হয়ে মাস্টারি, তা-ও দলিত আর মুসলিম মেয়েদের স্কুল?
টাকা-পয়সা জোগাড়ে বেরোলেন জ্যোতিরাও, দুই বন্ধুর তত্ত্বাবধানে চলল সাবিত্রীর তালিম। ফের ১৮৫১ সালে স্কুল খুলল। সাবিত্রী প্রধান শিক্ষিকা, স্কুলের প্রাণকেন্দ্র। বছর দুয়েক না যেতে ‘পুনে অবজার্ভার’ কাগজ লিখছে, ‘মেয়েদের ইস্কুলে ছাত্রীরা অনেক ভাল শিখছে সরকারি ইস্কুলের ছেলেদের চাইতে। সরকার কিছু করুন, নইলে মেয়েরা বেশি ভাল ফল করলে আমাদের মাথা নিচু হয়ে যাবে।’
তত দিনে ঈশ্বরচন্দ্র বেথুন স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাঁর নির্দেশে ছাত্রীদের গাড়ির পাশে লেখা হয়েছে মহানির্বাণতন্ত্রের বাণী, ‘কন্যারাও সমান যত্নে পালনীয়, শিক্ষণীয়।’ কিন্তু মেয়ে শিক্ষক তৈরির প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র। মেয়েরা বাড়ির বাইরে কাজ করবে, এটা মানার জন্য সমাজ তৈরি নয়, ছোটলাটকে চিঠিকে লিখেছিলেন। তিনি নিজেই কি রাজি ছিলেন? নিজের স্ত্রী, দুই কন্যাকে লেখাপড়া শেখাননি তিনি।
জ্যোতিরাও ঈশ্বরচন্দ্রের চাইতে সাত বছরের ছোট, সাবিত্রী এগারো বছর। তাঁদের কাজের গোড়া থেকেই ছাত্রী তৈরি আর শিক্ষিকা তৈরি চলেছে পাশাপাশি। বিদ্যাসাগর যখন অতি কষ্টে কায়স্থদের ঢোকাতে পারছেন সংস্কৃত কলেজে, সুবর্ণ বণিক ছাত্রকে ঢোকাতে না পেরে আক্ষেপ করছেন, তখন একেবারে ‘অস্পৃশ্য’ মাং, মাহার, মাতং পড়তে আসছে সাবিত্রীবাইয়ের নেটিভ ফিমেল স্কুলে।
আজকের ইতিহাস বইতে দলিত আন্দোলনের চ্যাপ্টারে সাধারণত লেখা হয় জ্যোতিরাও ফুলে-র কথা। সাবিত্রী তার ফুটনোট। অথচ আশ্চর্য, ব্রাহ্মণ বিধবাদের দুঃখ নিজের মধ্যে অনুভব করেছেন সাবিত্রী। সময়টা ১৮৬৩। কাশীবাই নামে এক ব্রাহ্মণ বিধবাকে গর্ভবতী করে কেটে পড়ে এক শাস্ত্রীজি। কাশীবাই জন্ম দিয়ে গলা কেটে মারে শিশুকে। ‘খুনি’ কাশীবাইকে ইংরেজ সরকার আন্দামানে পাঠায়। আহত ফুলে দম্পতি গোটা শহরে পোস্টার সাঁটেন, শিশুহত্যা না করে আমাদের আশ্রমে আসুন। পরের কুড়ি বছরে প্রায় ৩৫ জন ব্রাহ্মণ বিধবাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন সাবিত্রী।
মেয়েদের জন্য রামমোহন, বিদ্যাসাগর অনেক লড়াই করেছেন, কিন্তু ভালবেসেছেন কি? রামমোহনের তিন স্ত্রী ছিল, কারও সঙ্গেই মনের ঘনিষ্ঠতার কথা জানা যায় না। শোনা যায়, তাঁর দত্তক নেওয়া সন্তান রাজারাম নাকি মুসলিম উপপত্নীর গর্ভজাত। বিদ্যাসাগরের বিপুল কর্মকাণ্ডে স্ত্রী দয়াময়ী কই? অথচ একই প্রজন্মের মানুষ জ্যোতিরাও-এর মেয়েদের স্কুলে সাবিত্রী চালিকাশক্তি, তাঁর সত্যশোধক সমাজে সাবিত্রী ৯০ জন মেয়ে নিয়ে শামিল, সম্মেলনে তিনি সভানেত্রী। ১৮৬৮ সালে স্বামীকে সাবিত্রী চিঠি লিখছেন, ‘এক ঘটনা হয়ে গেল। এই গণেশ ছেলেটি ব্রাহ্মণ, মেয়েটি মাহার। মেয়েটি গর্ভবতী জেনে সবাই ওদের পিটিয়ে মারার চেষ্টায় ছিল। আইনের ভয় দেখিয়ে আমি অনেক কষ্টে বাঁচিয়েছি। তোমার কাছে পাঠালাম।’ ওই যুগলের কী হয়েছিল, জানা যায় না। তবে এক বিধবার গর্ভজাত পুত্রকে দত্তক নেন ফুলে দম্পতি। সেই ছেলে যশোবন্তের বিয়ে সম্ভবত আধুনিক ভারতের প্রথম অসবর্ণ বিবাহ।
তবে তার চাইতেও যা চমকে দেয় তা হল, বিয়ের আগে পুত্রবধূ লক্ষ্মীকে বাড়িতে এনে রেখেছিলেন সাবিত্রী। যাতে ছেলে-বউ এ-ওর মন বুঝতে পারে। সিরিয়ালের শাশুড়িদের দেখলে মালুম হয়, আজও এমন মেয়েকে চিত্রনাট্যে ফিট করা সোজা হবে না। মঞ্চে নারীবাদী বিস্তর, সংসারে বিরল।
আশ্চর্য এই মহিলা প্রায় আড়ালে রয়ে গেলেন। দাবি উঠেছে, ৩ জানুয়ারি, তাঁর জন্মদিনটি ‘শিক্ষক দিবস’ বলে পালন করা হোক। সর্বেপল্লি রাধাকৃষ্ণণ বরেণ্য দর্শনবিদ, আদর্শ শিক্ষক। শিক্ষার উৎকর্ষ তাঁকে দেখে শিখতে হয়। কিন্তু যে শিক্ষক সব শিশুকে সমান শিক্ষা না দেওয়ার অপরাধে গোটা দেশকে বেঞ্চে দাঁড় করাতে পারেন, প্রথম পাঠ নিতে হবে তাঁর থেকেই। ‘শিক্ষার অধিকার’ মানে কী, জানতে হলে সাবিত্রীর জীবনটা জানতে হবে। শেষ অবধি তাঁর জন্মদিনে তেমন কিছুই হয়নি, তবে গুগল তাঁকে নিয়ে ডুড্ল করেছিল সে দিন। তাঁর দুই বাহুর মধ্যে মেয়েরা, সবাইকে যেন তিনি টেনে নিচ্ছেন কাছে। গত তিন দশকে তাঁর উপর তেমন কোনও বইও লেখা হয়নি। পেশোয়া বাজিরাওকে ভালবাসার টানে বুন্দেলখন্ডের রাজকুমারী মস্তানির লড়াইটা নতুন করে চিনল সবাই। কিন্তু মেয়েদের স্কুলে আনার লড়াইটা স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে যে মরাঠি মেয়েটি লড়ে গেল সবার আগে, বিস্মৃতির বাঘ তাকে খেয়ে গিয়েছে।
বেঁচে থাকতে সম্মান কম পাননি সাবিত্রী। পণ্ডিতা রমাবাই, আনন্দীবেন জোশি, রমাবাই রণদে, সে কালের শিক্ষিতা মেয়েরা এসে দেখা করে গিয়েছেন। সাবিত্রী ছিলেন মাঝারি গড়নের, সুমুখশ্রী, শান্ত মানুষ। তাঁকে কেউ নাকি রাগতে দেখেনি। যা করার, হাসিমুখে করে গিয়েছেন।
জীবনের শেষ দিন অবধি ব্যতিক্রমী সাবিত্রী। প্লেগ তখন মহামারী। মায়ের কথায় যশোবন্ত সেনাবাহিনীতে ডাক্তারির চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে পুণেতে প্লেগের ক্লিনিক খুলে বসলেন। সাবিত্রী নিজে রোগীদের সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। রোগ ছোঁয়াচে, তা জেনেও। শেষে একদিন পরিচিত এক মাহার পরিবারের বালক সন্তানকে পিঠে করে নিয়ে এলেন ক্লিনিকে। ছোঁয়াচে রোগ বাসা বাঁধল তাঁরও শরীরে। তাতেই মারা গেলেন ১৮৯৭ সালে।
এত নির্ভয় কোনও মেয়ে হতে পারে, ভাবলেও ভয় করে।
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
সাবিত্রীবাই ফুলের জন্মদিন 3-জানুয়ারিই কি #শিক্ষক_দিবস হবার প্রকৃত দাবিদার নয়?
পরিবর্তনের একটা দিক
– নীলাঞ্জন সৈয়দ
আমি বহু গ্রাম গিয়েছি। সেখানে প্রাইভেট পড়িয়েছি। সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সেই গ্রামগুলোর ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সম্পর্ক হয়েছে। সেই ছাত্র ছাত্রীদের মা বাবার সঙ্গে পরিচয় হয়েছ। এই গ্রামগুলো মুসলমান অধ্যুষিত। ছাত্র ছাত্রীর নিরানব্বই শতাংশ মুসলিম। পড়ানোর সুবাদেই এই গ্রামগুলোর মানুষজন সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা বাড়িতে বা বাইরে থাকলে হতো না। যখন হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে কেউ লেখে, সেই লেখায় সারবত্তা আছে বা নেই, বা কতটুকু আছে সেটা বুঝতে ওই অভিজ্ঞতা আমায় খুব সাহায্য করে।
ফেসবুকে অনেকেই হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে কাল্পনিক ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকতে চান। তার বাইরে বেরোতে চান না। তাঁকে বাস্তব চেহারাটা ধরিয়ে দিলেও কাল্পনিক ধারণাটাকেই যথার্থ বিবেচনা করে থাকতে চান। এতে আমার কোন অসুবিধে নেই। আমার সমস্যাও নেই। কাল্পনিক জগৎ রচনা করে সেটাকেই সত্যি ভেবে তার মধ্যে বাস করা আমার কাছে কৌতুকের। কেউ কেউ মানুষের মাঝে একটা ইউটোপিয়া রাজ্য গড়ে তুলতে সাহায্য করছেন।
মূল প্রসঙ্গে আসি। বোরখা হিজাব প্রসঙ্গে আসি। আমার কাছে যে প্রচুর মুসলিম মেয়ে পড়েছে। তাদের একজনও বোরখা হিজাব পরত না। এই মেয়েদের কারো কারো মায়েরা বাইরে গেলে বোরখা পরেন। আবার সেই মা আমার সঙ্গে যখন কথা বলছেন তখন বোরখা নেই। কথা বলার মধ্যে জড়তা নেই। এই মায়েদের মধ্যে দৃঢ়তা দেখেছি। তাঁরা কতটুকু একজন প্রাইভেট মাস্টারের সঙ্গে কথা বলবেন সেই সম্পর্কে সচেতন। এই মায়েরা রাতেও ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁর মেয়ের পড়াশুনোর ব্যাপারে। এই মায়েরা কেউ মাধ্যমিক পাস। কেউ উচ্চমাধ্যমিক। আবার বিএ এমএ পড়া মায়েরাও আছে। উচ্চমাধ্যমিকে বিয়ে হয়ে গেছে, বিয়ের পরে বিএ ও এমএ পাস করেছেন। রেগুলার বিএ, প্রাইভেটে এমএ। এই মায়েরা কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ, পড়াশুনো সমস্ত ব্যাপারে এই মায়েদেরই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত দেখতাম। বেশির ভাগ বাবাদের এই বিষয়ে নাক গলাতে দেখিনি।
এই মায়েদের একটা অংশ বাইরে বেরোন, কাজ করেন। অর্থ রোজগার করেন। এঁদের কেউ প্যারা টিচার, প্রাইমারি স্কুলের টিচার, আর বড় অংশ বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত।
আগের চেয়ে বোরখা অনেক বেশি বেড়েছে, তেমনি মেয়েরা আগের চেয়ে অনেক বেশি বাইরে বেরোয়। এটাও দেখেছি বোরখা পরিহিতা মেয়েরা একসঙ্গে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে খেতে খেতে আড্ডা মারছে। আশে পাশে প্রচুর পুরুষ।
আমার ছাত্রীদের প্রায়ই সবাই প্রত্যন্ত অঞ্চলের। সেই ছাত্রীদের বাবাদের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁদের কেউ কেউ বলেন - আমার মেয়ে ইংলিশে অনার্স নিয়ে পাস করল। একটা চাকরির চেষ্টা করছে। শুনে ভাল লাগে। আমার দুই ছাত্রী রয়েছে যারা ইংরেজিতে অনার্স সহ বিএ পাস করে কলকাতায় থেকে রেগুলার এমএ পাস করেছে। এরা কেউ বোরখা হিজাব পরে না। এরা বহরমপুরে থেকে চাকরীর চেষ্টা করছে। এই ছাত্রীদের একজন কবিতা লেখে। কবিতার বই বের করেছে। আমায় এক কপি দিয়েছে। আর একজন ছাত্রী ইউটিউবে চ্যানেল খুলেছে। সে ওখানে কীভাবে বাচ্চা ছেলে মেয়েরা ইংরেজি সহজে শিখতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা করে। চ্যানেলটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে গেছে। এক লাখের উপর সাবস্কাইবার। দুই লাখ তিন লাখ ভিউ। পঞ্চাশ হাজার টাকা রোজগার করে এই চ্যানেল থেকেই।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল একদা আমার ছাত্র ছিল, সে ও তার বৌ মিলে একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলেছে। সেটাও খুব জনপ্রিয়। সেই ছাত্রের বৌ অ্যাঙ্করিং করে। ঐ আসলে চ্যানেলটি চালায়।
আমার এক ছাত্রী ইউক্রেনে পড়াশুনো করে। ডাক্তারি পড়ে। আমি যাদের নিয়ে আলোচনা করছি তারা সবাই সাধারণ পরিবারের। এই পরিবার গুলোর প্রথম প্রজন্ম অথবা আগের প্রজন্ম থেকে লেখাপড়া শুরু হয়েছে। এদের প্রধান জীবিকা চাষবাস।
গ্রামগঞ্জের জীবন যাপনে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। নিম্নবর্গের হিন্দু মুসলমান ব্যাপক ভাবে আরবে যাওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে। হিন্দু তুলনায় কম হলেও তারা যথেষ্ট পরিবারে যাচ্ছে।
গ্রাম মানেই মাটির ঘর এই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। বেশির ভাগ মানুষের বাড়ি পাকা। বাড়িতে সাবেক কালের উনুনের পাট চুকে গেছে। প্রায়ই প্রতিটা বাড়িতে গ্যাস উনুন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এসেছে। স্বাস্থ্য সচেতনাও দেখি। সৌন্দর্যবোধও এসেছে।
মুসলিম পরিবারে মেয়েদের পড়াশুনোর প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। ভবানীপুর বলে একটি গ্রাম রয়েছে সেখানে একটি মেয়ে ডাক্তারি পড়ছে। সম্ভবত চতুর্থ বর্ষ হল। আমাদের গ্রামে দুটো ছেলের একটি আরজিকর মেডিকেল কলেজে পড়ে। সে তৃতীয় বর্ষে পড়ে।
আবার স্মরণ করিয়ে দিই এই লেখা নিম্নবর্গের মানুষজন ও তাদের ছেলে মেয়ে সম্পর্কে। এখানে বাবু সমাজের কোন ভূমিকা নেই। মোটামুটি গ্রামের যে চিত্র দিলাম তাতে একটা জিনিস স্পষ্ট মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। যে ছেলে মেয়ে ডাক্তারি কিংবা উচ্চশিক্ষা করছে তারা শুধু নিজেদের শিক্ষিত করেনি তার পাড়া, তার আশে পাশের এলাকাকেও প্রভাবিত করছে। একটা বিশ্বাস এনে দিতে পারছে - গ্রামের ছেলে মেয়েরাও পারে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারে না। এছাড়া সরকার রাষ্ট থেকে বার বার শিক্ষার প্রতি সচেতনতা বাড়ান, স্কুলের শিক্ষকদের একাংশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝানো পড়াশুনো জরুরী। গ্রামে গ্রামে রয়েছে স্বাস্থ্য কেন্দ্র। সেখান থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের টিকা নেওয়া ও প্রচার চালানো একটি সন্তান বা দুটি সন্তান নেওয়া ইত্যাদির একটা প্রভাব রয়েছে। এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্থানীয় হিন্দু মুসলিম মেয়েরা কাজ করে। তাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝায়।
বিশাল ক্যানভাসে বিশাল প্রেক্ষাপটে এই চিত্রটা তুলে ধরলে বোঝা যাবে ধর্মের প্রভাব কতটা বা আদৌ প্রভাব এসেছে কী না।
আমি যা বললাম সেগুলো ধর্মের পরিপন্থী হলে বলতে হবে ধর্মের প্রভাব এখানে শূন্য। ধর্মের কোন জিনিস বেড়েছে? হিজাব বোরখা বেড়েছে। নিয়মিত নামাজ পড়া বেড়েছে। রোজা রাখা বেড়েছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও রাখে। তাদের কাছে উৎসব। বেড়েছে ধর্মের নামে ব্যবসা। ব্যবসায় প্রচুর টাকা রোজগার। কিন্তু মানব উন্নয়নে রাষ্ট্রের সরকারের প্রভাব বেশি।
মুসলিম সমাজে আগের তুলনায় জন্মের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। আমি বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে টের পেতাম। অনেক বাড়িতে দেখেছি একটা কিংবা দুটো সন্তান। কিন্তু এখানে একটা জিনিস পরিষ্কার করা প্রয়োজন জন্মহার কমে আসার তুলনা হিন্দুদের সঙ্গে নয়। এই তুলনা নিজের সঙ্গে। কেউ কেউ হিন্দুর সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে মুসলমানদের আগের তুলনাটা উল্লেখ করছেন না। কেবল হিন্দুদের জন্মহারের সঙ্গে তুলনা করলে ভুল রিপোর্ট, ভুল ধারণা হবে। এটা ক্ষতিকর। বিদ্বেষ বাড়বে।
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি বোরখা হিজাব তারাই বেশি পরছে যাদের বাড়িতে অর্থ এসেছে। আগে সমাজে প্রতিপত্তি সম্মান আভিজাত্য ছিল না, সেই সব পরিবারে বোরখা হিজাব বেড়েছে। গরীব পরিবারে ততটা নেই।
গরীব পরিবারে জন্ম নেওয়ার হার বেশি। ঐ পরিবার গুলোতে এর যুক্তি লক্ষ্য করেছি। যত বেশি সন্তান তত শ্রমিক তৈরি হবে। বাড়িতে অর্থ আসবে।
আমার মনে হয়, ইতিবাচক নেতিবাচক দুই দিক ধরে আলোচনা করলে তবেই সেটি যথার্থ আলোচনা হবে। একদিক ধরে আলোচনা করলে ভুল ধারণা জন্মাবে। বিদ্বেষ বাড়বে।
যারা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আড়াল করে সেটা তাদের সমস্যা। চিহ্নিত করাও উচিত। তার মানে এই নয় যে সব ষটুকু তুলে ধরব না...
আর আরেকটা ব্যাপার মনে হয় সমাজকে বিশ্লেষণ করতে হবে। মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার কেন বেশি তার পেছনে কী কেবল ধর্ম না আর্থ সামাজিক অবস্থা এর পিছনে দায়ী?
কেবল মাত্র ধর্ম যদি হয় তাহলে বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার কমছে কেন?কেন তারাও সচেতন হচ্ছে? সচেতন হওয়া মানে তো ধর্মবিরোধী হওয়াও। সেই ধর্মবিরোধী হতে তাদের মধ্যে বাধা আসছে না কেন? এগুলোও আলোচনা করা উচিত। কেবল মোটা মোটা হেডিং গুলো থেকে সিদ্ধান্তে এসে গেলাম সেটা কখনই উচিত নয়।
[2023-12-27]
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
শীতকালের মেঘলা সকাল
✍️ লক্ষ্মণ সরকার
শীতকালের এই মেঘলা সকাল বড্ড বিরক্তিকর মন খারাপ করা সকাল। কী করি কাজ তো কিছু নেই। এই খাদ্যরসিক কমলাকান্তকে কেউ বলবে না চলো আজ তোমাকে মন ভাল করা নতুন কিছু খাদ্যের পদ পরিবেশন করব। সকালে পাঁচ রকম কাজের ফিরিস্তি শুনিয়েছে - আজ এই করতে হবে ঐ করতে হবে ইত্যাদি। অতএব যা ভাবছিলাম সে গুড়ে বালি। মনে পড়ে গেল দীপ্তেন্দুর লেখার অনুকরণে "কাজ নাই তাই কাঁথা সেলাই "।
দেখতে দেখতে তো চোখে ছানি পড়ে গেল তবু দেখার বিরাম নেই। মনোরমা তো বলতেই থাকে "ছানি পড়বে না সেই কোন বেলা থেকে এদিক ওদিক দেখা শুরু করেছো কেবল আমাকেই চোখে ধরল না। কি বলব, বলতে তো ইচ্ছে করে, "ওগো প্রিয়তমা করিও ক্ষমা তোমাকে আমার----- করিতে পারিলাম না।"
থাক ওসব কথা। কথা হচ্ছিল চোখে ছানি পরার কথা। বললে তো লোকে বলবে আপনার অত দেখার দরকার কি? কই আমি তো দেখি না। আপনি মশাই এখনও Back dated ই রয়ে গেলেন। আমি তো দেখিনা -- খেলার মাঠে ঐ মহিলা ইন্টারভিউ নিচ্ছে তার হাঁটুর উপর পর্যন্ত অনাবৃত। পাশের পুরুষটার তো সম্পূর্ণ দেহ আবৃত। দেখিনা তো এই বয়সে শাশুড়ি নতুন বোমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টাইট চূড়িদার পরে থপাস থপাস করে চলে বেড়াচ্ছে। কী দরকার দেখার, শ্বশুর মশাই বারমুন্ডা পরে মস্ত ভুঁড়ি বের করে হেঁটে চলেছে। দেখি না তো ছেঁড়া ফাটা প্যান্টের স্টাইলে কি ক্যাবলা ক্যাবলা লাগে। কেন তাকাবো ঐ মুখের দিকে যাদের সবার মুখেই কোহলি মার্কা দাড়ি? চেনা দায় কে রাম কে রহিম।
আপনি দেখেন কেন – টাকা উড়ছে সবাই ধরছে মারামারি করছে করুক। রাজনীতি করে খাওয়ার কারবার ভালো চলুক। চাকরি চুরির দেশে আছেন, থাকেন, তাকাবেন না। মুখও বন্ধ রাখতে হবে দেশদ্রোহী হবেন নাকি?
আরো অনেক আছে যেটুকু ভরসা ছিল বিচারপতি ও নির্বাচন কমিশন তাও তাঁর পছন্দ মতন হবে। ওসব দেখবেন না, শুনবেন না। থাক ওসব বড় বড় ব্যাপার বরং বাড়িতে চলুন পাড়ায় চলুন। শিশু থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত সব করবেন
কিন্ত বিয়ের ব্যাপারে আপনি বলার কে?
বাড়ি লিখে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে, কেউ কিছু বলছে না। হলেন বা মাস্টারমশাই, তাই বলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে হবে?
– রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন বয়স্ক নাগরিক আপনি, ছেলেপিলেরা একটু চ্যাংড়ামি করবে না? তাকাবেন না আপনর দলে এলেই সব শুদ্ধ হয়ে যাবে। একটা কথা মনে রাখবেন যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। আর কত দিন ব্যাকডেটেড থাকবেন মশাই এবার অন্তত মডার্ন হন।
[2023-12-24]
গয়ায় পিন্ডদান
✍️ শম্ভুনাথ চার্বাক
গতকাল আমার এক ছাত্রের বাবা আমাকে এই প্রশ্ন করেছিলেন – আপনি গয়াতে আপনার বাবা মায়ের পিণ্ড দিয়ে এসেছেন? আমি কি উত্তর দেবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। কারণ আমি বিশ্বাস করি বেঁচে থাকতে বাবা মাকে ক্ষমতানুযায়ী পরিচর্যা করলেই আর কিছু লাগে না। মৃত্যুর পরে মানুষ প্রকৃতির অংশ হয়ে যায়। আত্মার ঢপ আমি কোনোদিন বিশ্বাস করিনি। আমার বাবামাও বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। তাঁরা বলতেন, থাকতে দেয় না দু আঙুল মাটি, মরলে দেবে শীতল পাটি। জীবিত অবস্থায় যা দিবি তাই পাবো, মৃত্যুর পর কত বড় করে শ্রাদ্ধ করলি, গয়াতে গিয়ে পিণ্ডি দিয়ে এলি সেটা আমরা দেখতে আসবো না। আমি সেই শিক্ষায় নিজেকে বড় করেছি। আমার সাধ্যানুযায়ী আবা মায়ের পরিচর্যা করেছি। তবে গয়া বেড়াতে গিয়ে ফাজলামো করে বন্ধুদের সামনেই ছেলের হাতে লজেন্স দিয়ে নৈরঞ্জনা নদীতে দিয়ে বলেছিলাম--- আর এই নোংরা শহরে আসবিনা। তুই এখনই মনে কর তোর বাবার এডভান্স পিণ্ডি দিচ্ছিস। সেদিন সব বন্ধুদের সে কী হাসি ঠাট্টা হয়েছিল এটা নিয়ে। এখনও অনেকের সেকথা মনে আছে।
আমি মা বাবা মারা যেতে সাদা কাপড়ও পরিনি আর শ্রাদ্ধও করিনি। শুধুই স্মরণসভা করেছিলাম। আর বেশ কিছু টাকা আদিবাসী অঞ্চলে দিয়েছিলাম। এখনও অবশ্য আদিবাসীদের প্রতি বছর কিছু সাহায্য পাঠাই। আমার শ্রাদ্ধ করার থেকে জীবিত মানুষদের সেবা করা অনেক বেশী ভালো মনে হয়।
রক্তে ভেজা মাটি
✍️ Krishnajit Sengupta
আজ থেকে একশো তিন বছর আগে জলরঙে আঁকা ছবি। রক্তে ভেজা মাটিতে দাঁড়িয়ে দুটি মানুষ। একজন পুরুষ, দ্বিতীয়জন নারী। পুরুষের অবলম্বন লাঠি, দৃষ্টিহীন প্রতিবন্ধী। নারীর পায়ের আঙুল ঈষৎ সন্ত্রস্ত ভাঙা তীরের স্পর্শে।
এ ছবির স্রষ্টা শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু। আজ ৩ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন। ছবিটির নাম 'কুরুক্ষেত্রে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী।'
ধর্মযুদ্ধের রক্তে রাঙা মাটি। সেখানে মিশে আছে শতপুত্র ও সহস্র সেনানীর শেষ আর্তনাদ। মিশে আছে বহু প্রিয় ধার্মিকেরও শোণিতধারা। অন্ধপিতা ও মাতা দাঁড়িয়ে আছেন, চোখে দেখার শক্তি নেই তাঁদের। শুধু শরীর দিয়ে অনুভব করেন মানুষের অ-সভ্যতা।
যুদ্ধবিক্ষুব্ধ আজকের পৃথিবীতেও এ ছবি কত না প্রাসঙ্গিক। আচার্য নন্দলাল আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন অন্যায়ের ছুরির কোনো বাঁট হয় না, যে মারে সে নিজেও রক্তাক্ত হয়। আত্মজের রক্তে স্নান করে অভিশপ্ত মানুষ।
[2023-12-03]
#আজিমগঞ্জ_জিয়াগঞ্জ_সেতু_চাই 🤝
বুদ্ধদেব বসুর চেতনায় রাজনীতি
– ✍️ শিবাশীষ বসু
রবীন্দ্রনাথের অন্যতম সমালোচক বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে পাঠকমহলে একটি পরিচিত অভিযোগ যে, তিনি কলাকৈবল্যবাদী। কলাকৈবল্যবাদীরা মনে করেন, শিল্পের সঙ্গে সমাজের কোনো বিষয়ভিত্তিক উপযোগিতার দরকার নেই। শিল্প শুধু শিল্পের জন্যই। অর্থাৎ Art for art's sake. সমসাময়িক সাহিত্যিকরা যখন মন্বন্তর, যুদ্ধ, দেশভাগ বা দাঙ্গার মতো সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সংকট দেখে আকুল হয়েছেন, বুদ্ধদেব মোটামুটিভাবে তখনও ব্যক্তিগত শিল্পচর্চায় বিশ্বাসী থেকেছেন। উপযোগিতামূলক সাহিত্য রচনার বিরোধী ছিলেন বলে বুদ্ধদেব একসময়ে অভিহিত হয়েছিলেন ‘পলায়নবাদী’ হিসেবে। তাঁর রাজনীতি-বিরূপতার কারণ জানাতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু একসময় লিখেছিলেন, “রাজনীতি বলতে বুঝেছি কপটাচরণ, ক্রূরতা, ধূর্ততা, ক্ষণিকের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধ্রুব আদর্শের অবমাননা। শিল্পীমনের পক্ষে ও বস্তু বিশেষ লোভনীয় হতে পারে না।”
সেই হেন বুদ্ধদেবই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আট-দশ মাস পরে ‘সভ্যতা ও ফ্যাসিজম: সাহিত্যিকের জবানবন্দী’ শীর্ষক একটি অবিস্মরণীয় পুস্তিকার সৃষ্টি করলেন যাতে তিনি লিখলেন, “একদিকে জার্মান-ইতালিতে মনুষ্যত্বের অবমাননা ও সভ্যতার বিনাশ; অন্যদিকে রাশিয়াতে মনুষ্যত্বের পূর্ণ মর্যাদা দান ও সভ্যতার পূর্ণবিকাশের সাধনা। এই জুড়ি দৃশ্য যখন দেখলুম তখন রাজনীতির বড় রকমের একটা অর্থ মনে ধরা দিল। তখন বুঝলুম রাজনীতি শুধু অ্যাসেমব্লি হলের বক্তৃতা নয়, মাছ ও পাঁউরুটি বিতরণ নিয়ে নোংরা কলহ নয়, আমাদের প্রত্যেকের জীবনযাপন, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ রাজনীতির উপর নির্ভরশীল, এবং সেইজন্য তার আলোচনায় আমাদের সকলেরই প্রয়োজন। শান্তির সময়, সুখের সময় নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব, হয়তো সে-অবস্থাই স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল, কিন্তু চারিদিকে যখন অশান্তির আগুন লেলিহান হয়ে জ্বলে ওঠে তখন কবি বলো, শিল্পী বলো ভাবুক বলো কারো পক্ষেই মনের মধুর প্রশান্তি অক্ষুণ্ণ রাখা আর সম্ভব হয় না, যার প্রাণ আছে তার প্রাণেই ঘা লাগে। রবীন্দ্রনাথের জীবনেও আমরা দেখেছি তাঁর জ্ঞানী আত্মস্থতাকে বহির্জগতের পীড়ন বার-বার ভেঙে ভেঙ্গে দিয়েছে, তীব্রস্বরে তিনি অভিশাপ দিয়েছেন হত্যাকারী অত্যাচারীকে, জাপান যখন চীনকে গ্রাস করতে উদ্যত হল, জাপানের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র বিক্ষোভের প্রমাণ রয়েছে অনেক কবিতায় আর নোগুচিকে লেখা চিরস্মরণীয় পত্রাবলীতে। লোভ জিনিসটা অতি কুৎসিত এবং কবি কুৎসিতকে সইতে পারেন না। তাই আজ পৃথিবী ভরে লোভ যখন তার বীভৎসতম মূর্তিতে প্রকট তখন আমরা কবিরা, শিল্পীরা স্বভাবতই, নিজের প্রকৃতির অদম্য টানেই, ঐ বীভৎসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবো — এর মধ্যে রাজনীতির কোনো গূঢ়তত্ত্ব নেই, আমাদের মনুষ্যত্বের, কবিচরিত্রের এটা নূন্যতম দাবি। … বর্বরতার বিরুদ্ধাচরণ মনুষ্যধর্ম মাত্র, কিন্তু লেখকদের পক্ষে এর বিশেষ একটু তাৎপর্য আছে। পশুত্বের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতেই হবে, নয়তো আমাদের অস্তিত্বই যে থাকে না। জার্মানি থেকে মনীষীরা যখন একে একে বিতাড়িত হতে লাগলেন, জাপানের বোমাবর্ষণে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যখন বিধ্বস্ত হতে লাগলো, তখন ঘৃণায় শিহরিত হয়ে এ-কথাই ভাবলুম যে দুদিন পরে এইরকম পৈশাচিক শক্তি যদি ভারতবর্ষের দিকে বিষাক্ত ফণা উদ্যত করে তাহলে আমরা যারা কবি শিল্পী বিদ্যানুরাগী আমরা আমাদের স্বাধীকার থেকে সকলের আগে বঞ্চিত হব, এই দুর্গত পরাধীন দেশেও চিন্তার ও আত্মপ্রকাশের যেটুকু স্বাধীনতা আমাদের আছে সেটুকুও আর থাকবে না, শুধু যা আমাদের জীবিকা কিংবা জীবন যাবে তা নয়, যা-কিছু আমাদের কাছে মূল্যবান, যে-সব জিনিস আছে বলে আমরা বাঁচতে চাই এবং যা না-থাকলে আমাদের জীবনের কোনো মানে থাকে না সব একেবারে ছারখার হয়ে যাবে। স্প্যানিশ যুদ্ধে, চীন-জাপানের যুদ্ধে এটুকু আমাদের শিক্ষা, বৃহত্তর রাজনীতিতে সেই প্রথম দীক্ষা। … তারপর সেদিন যুদ্ধ বাঁধলো। বর্বরতার শেষ সূক্ষ্ণ মুখোশ খসে পড়ল, ভণ্ডামির ভদ্রতা পর্যন্ত কোনোখানে আর রইলো না। জলে, স্থলে, আকাশে হত্যা আজ স্বেচ্ছাচারী, শুধু যোদ্ধৃহত্যা নয়, নারীহত্যা, শিশুহত্যা, জনতার সামগ্রিক বিনাশ, তাছাড়া সত্যের, সুন্দরের, সমস্ত আদর্শের হত্যা। এই হত্যার ঢেউ আজ ভারতের উপকুলে এসে পৌঁচেছে। … যে-কোনো অতর্কিত মুহূর্তে আমার বাসস্থান, প্রিয়জন, আমার সমস্ত আশা ভালোবাসা সুদ্ধু আমি একেবারে লোপাট হয়ে যেতে পারি। কিংবা কোনো আসুরিক শক্তি হয়তো কেড়ে নেবে আমার কলম, থামিয়ে দেবে আমার সমস্ত কর্মোদ্যম, পাথর চাপা দেবে আত্মপ্রকাশের আবেগে — তাহলেই বা আমার অস্তিত্ব থাকে কোথায়? … এরই নাম ফ্যাসিবাদ। অর্থনীতি ও রাজনীতির দিক থেকে ফ্যাসিজম-এর ব্যাখ্যার মধ্যে আমি যাবো না, আমি দেখতে পাচ্ছি এটা সংস্কৃতির প্রতিশ্রুত শত্রু, সভ্যতার ইতিহাসে এ একটা তীব্র বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া। সেইজন্যে আমরা যারা সংস্কৃতিতে, বিশ্বমানবের ঐতিহাসিক প্রগতিতে আস্থাবান, আমাদের এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে। … তাছাড়াও ভেবে দেখতে হবে যে ফ্যাসিজম শুধু একটা সামরিক নীতি কিংবা রাজনৈতিক পদ্ধতি নয়, ফ্যাসিজম একটা মনোভাব। মনোভাব মাত্রই অত্যন্ত ব্যাপক, জীবনের সমস্ত ছোটখাটো ব্যাপারে তার পরিচয় পাওয়া যায়। এটা আজকের দিনে অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে উপলব্ধি করেছি যে কোনো ব্যক্তির যদি রবীন্দ্রনাথের গান কি যামিনী রায়ের ছবি ভালো না লাগে, সেই রুচির কিংবা রুচির অভাবের সঙ্গে জড়িত আছে তার রাজনৈতিক মতামত। হয়তো সে-মতামত সম্বন্ধে সে নিজে খুব বেশি সচেতন নয়, কিন্তু খোঁচা দিলেই মনের কথা বেরিয়ে পড়ে, এবং যে সব কথা সে অবলীলাক্রমে বলে যায় তার ভয়াবহ তাৎপর্য সে নিজেও বোঝে না। স্ত্রী-পুত্রের প্রতি, বন্ধুর প্রতি, একদিকে ভৃত্য ও অন্যদিকে বড়ো সাহেবের প্রতি ব্যবহারে, বিদেশি ও বিধর্মী সম্বন্ধে ভঙ্গিতে তার প্রতিদিনের তুচ্ছতম আচরণে ও আলোচনায় তার মূল মনোভাব নানাভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। আমাদের দেশেও আজকের দিনে এমন লোকের অভাব নেই যারা যা-কিছু প্রগতিশীল তারই বিরোধী, যা-কিছু নতুন সে সম্বন্ধে সন্দিগ্ধ, যারা স্ত্রীজাতিকে সন্তানবাহী ক্রীতদাসী বানিয়ে রাখবার পক্ষপাতী, নিজের স্ত্রীকে প্রহার করতে ও পরস্ত্রীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাতে যারা নিয়ত উৎসুক, এদিকে সামাজিক জীবনে স্ত্রী-পুরুষের স্বাধীন মেলামেশার কথা শুনলে যারা মুর্ছা যায়, যারা যে-কোনোরকম বিদেশি বা অন্য ধর্মাবলম্বী সম্বন্ধে বিদ্বেষের ভাব পোষণ করে, অথচ পরস্পরের কুৎসা রটনায় যাদের জিহ্বা চির চঞ্চল, যারা নিছক গুণ্ডামির একান্ত ভক্ত — অবশ্য সে-গুণ্ডামির যতক্ষণ জিৎ হতে থাকে। … এ-সব লোক বাইরে থেকে দেখতে দিব্যি লেখাপড়া-জানা ভদ্রলোক, কিন্তু যে-কোনো বিষয়ে দুএকটা কথা বললেই বোঝা যায় তাদের মনোভাবটা কি। চোখ বুজে বলে দেওয়া যায় যে এটাই ফ্যাসিস্ট মনোবৃত্তি …। আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকের মনেই এই প্রতিক্রিয়া আজ বন্দী সর্পের মতো ফোঁসফোঁস করছে, একবার ছাড়া পেলে তার বিষ সমস্ত জাতির দেহে সঞ্চারিত হবে এমন আশঙ্কা আছে বলেই আজ আমরা যারা প্রগতিতে বিশ্বাসী তাদের একত্র হয়ে দাঁড়াতে হবে, জোর করে বলতে হবে যে এই কুৎসিত মনোবৃত্তির আমরা বিরোধী, এর বিরুদ্ধে যা-কিছু করবার সব করবো, তার জন্য যত নির্যাতন সইবার সব সইবো। … একবার একটি কলেজের ছাত্র আমাকে বলছিল, ‘হিটলারের আমলে জার্মানির কি আশ্চর্য উন্নতি হয়েছে তা তো দেখেছেন। আমাদের দেশে এইরকমই দরকার।’ আমি তাকে বললুম, ‘ওরা আইনস্টাইনকে তাড়িয়েছে —’ সে বাধা দিয়ে বললে, ‘জ্যু-রা ভয়ানক খারাপ লোক, তাদের তাড়ানোই উচিত।’ আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আচ্ছা ধরো যদি আমাদের স্বদেশী হিটলার যদি রবীন্দ্রনাথকে তাড়াতে চান তুমি তাতে রাজি আছো?’ সে একটু চুপ করে থেকে বললে, ‘দেশের উন্নতির জন্য রবীন্দ্রনাথকে যদি তাড়াতে হয় তবে তাড়াতেই হবে।’ আমি বললুম, ‘যে উন্নতির জন্য রবীন্দ্রনাথকে তাড়াতে হয় সে উন্নতি আমি চাই না কারণ মনেমনে আমি নিশ্চয়ই জানি যে সেটা উন্নতি নয়, ঘোর অবনতি।’ এই কথাই আমার শেষ কথা।”
লক্ষণীয়, বুদ্ধদেব বসু এখানে ফ্যাসিবাদের তাৎপর্যটি উপলব্ধি করবার পাশাপাশি দেশ বা জগতের প্রবল রাজনৈতিক সংকটকালে বিবেকি কবি ও সাহিত্যিকেরা সেই রাজনৈতিক সংগ্রামের সক্রিয় শরিক না হয়ে পারেন না, তা অতি স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন। আর একইসঙ্গে এই চেতনার আলোকে রবীন্দ্রনাথের সংগ্রামী সত্ত্বাটিকে যেন তিনি নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। বুদ্ধদেবের এই পুস্তিকাটির প্রশংসা করে ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকা ১৯৪২ সালের ১৬ই আগস্ট লিখেছিল, “Mr. Buddhadev Bose, we believe, has been the first among the younger writers after Tagore to enter his protest against Fascism on behalf of what might be called civilization and decency of life.” জাস্ট সময়কালটা পালটে নিন এবং দেখুন আজ ৮০ বছর পরেও চারিদিকে তাকিয়ে দেখলে দেখতে পাবেন বুদ্ধদেবের কথাগুলি কেমন মিলে যাচ্ছে।
Click here to claim your Sponsored Listing.
Videos (show all)
Category
Contact the business
Telephone
Website
Address
Berhampore
742101
অমর চক্রবর্তী রোড ইন্দ্রপ্রস্ত, , বরিশাল কলোনি, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ , পিন-৭৪২১০৩
Berhampore, 742103
Berhampore
তুমি বলেলই আমি মরে যাবো কিন্তু একটি শর্তে শুধু কাফনের কাপড়ের জন্য তোমার আঁচল টুকু চাই।
Jhowbona
Berhampore, 742175
কৃষ্টিগত সাময়িকী, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা। প্রারম্ভ বর্ষ (মুদ্রিত) : ২০১৯