Sanatan Vidyarthi Samsad, University of Barishal

Sanatan Vidyarthi Samsad, University of Barishal

হিন্দুদের মানবাধিকার রক্ষা, ধর্মসচেত

22/10/2023

নারীর মাঝেই, দেবীর স্বয়ং প্রকাশ

শ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ে ইন্দ্র, অগ্নি প্রমুখ দেবতারা দেবী কাত্যায়নী দুর্গা কর্তৃক অসুররাজ শুম্ভ নিহত হলে প্রফুল্ল বদনে সকল দিক উদ্ভাসিত করে দেবীর স্তব করেন। সে স্তবে দেবীর বিভূতি প্রসঙ্গে বলা হয়, জগতের সকল জীবের মাঝেই তিনি আছেন; কিন্তু নারীর মাঝেই তাঁর স্বয়ং রূপের প্রকাশ।

বিদ্যাঃ সমস্তাস্তব দেবি ভেদাঃ।
স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু ।
ত্বয়ৈকয়া পূরিতমম্ য়ৈতৎ
কা তে স্তুতিঃ স্তব্যপরাপরোক্তিঃ ॥
(শ্রীচণ্ডী:১১.৬)

"হে দেবি, বেদাদি অষ্টাদশ বিদ্যা আপনারই অংশ। চতুঃষষ্টি-কলাযুক্তা এবং পাতিব্রত্য, সৌন্দর্য ও তারুণ্যাদি গুণান্বিতা সকল নারীই আপনার বিগ্রহ। আপনি জননীরূপা এবং একাকিনীই এই জগৎকে অন্তরে ও বাইরে পরিব্যাপ্ত করে আছেন। যখন আপনি স্বয়ং স্তবনীয় বিষয়ে মুখ্য ও গৌণ উক্তিরূপা, তখন আপনার এইরূপ স্তুতি আর কী হতে পারে?"

নারীর মাঝেই দেবীর স্বয়ং প্রকাশ। তাই দুর্গাপূজাসহ অধিকাংশ তন্ত্রোক্ত দেবীপূজায় দেবীকে প্রতিমায় আহ্বান করার সাথে সাথে নিষ্পাপ কুমারী রূপেও পূজা করা হয়। কুলাচার অনুসারে দুর্গাপূজায় কোথায় মহাঅষ্টমী তিথিতে, আবার কোথাও মহানবমী তিথিতে দেবী প্রতিমার সম্মুখে দেবীর জীবন্তবিগ্রহ হিসেবে একটি কুমারী নারী শিশুকে পূজা করা হয়। গণেশাদি পঞ্চদেবতার পূজা সম্পন্ন করে, পরবর্তীতে কুমারী পূজা করতে হয়। শাস্ত্রে বিভিন্ন বয়সের কুমারীর বিবিধ নামকরণ করা হয়েছে। তিন বছরের কুমারীর নাম ত্রিধামূর্তি; চার বছরের কুমারীর নাম কালিকা; পাঁচ বছরের কুমারীর নাম সুভগা; ছয় বছরের কুমারীর নাম উমা; সাত বছরের কুমারীর নাম মালিনী; আট বছরের কুমারীর নাম কুব্জিকা; নয় বছরের কুমারীর নাম কালসন্দর্ভা; দশ বছরের কুমারীর নাম অপরাজিতা; এগারো বছরের কুমারীর নাম রুদ্রাণী ; বারো বছরের কুমারীর নাম ভৈরবী এবং তেরো বছরের কুমারীর নাম মহালক্ষ্মী। তেরো বছরের ঊর্ধ্ববয়স্কা নারী শিশুকে কুমারীরূপে পূজা না করাই বিধেয়। কুমারীর ধ্যান হল:

ওঁ বালরূপাঞ্চ ত্রৈলোক্যসুন্দরীং বরবর্ণিনীম্।
নানালঙ্কারভূষাঙ্গীং ভদ্রবিদ্যাপ্রকাশিনীম্।।
চারুহাস্যাং মহানন্দহৃদয়াং শুভদাং শুভাম্।।
ধ্যায়েৎ কুমারীং জননীং পরমানন্দরূপিণীম্।।

"বালিকারূপিণী, ত্রিভুবনের মধ্যে সুন্দরী, শ্যামা, নানা অলঙ্কারে যাঁর অঙ্গ ভূষিত, যিনি শুভবিদ্যাদান করেন, সুস্মিতা, পরম আনন্দে যাঁর হৃদয় পরিপূর্ণ, মঙ্গলদায়িনী, নিজে মঙ্গলময়ী—সেই ব্রহ্মস্বরূপিণী জননী কুমারীকে চিন্তা করি।"

ধ্যানমন্ত্রে দেবীকে আহ্বান করে আসন, স্বাগত, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, পুনরাচমনীয়, গন্ধতৈল, স্নানীয়, বস্ত্র, আভরণ, সিন্দূর, অলতা, চোখের কাজল, আয়না, চিরুনী প্রভৃতি প্রাসাধনদ্রব্য, মাল্য, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, পানীয়, পুনরাচমনীয় এবং তাম্বুল ইত্যাদি ষোড়শোপচারে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দেবীর পূজা করতে হয়। বয়স অনুসারে কুমারীর নাম নিশ্চিত হয়ে- "এতৎ সম্প্রদানায় ঐং হ্রীং শ্রীং হূং হেঁসৌঃ কুমাৰ্য্যৈ নমঃ" মূলমন্ত্রে ক্রমানুসারে সকল উপচার নিবেদন করতে হয়।বঙ্গদেশে কুমারী পূজার প্রচলন নবীন নয়। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন শক্তিপূজায় কুমারীপূজার বিধান পাওয়া যায়। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে লিপিকৃত 'কুমারীপূজাপ্রয়োগ' নামক একটি হস্তলিখিত পুঁথি (সংগ্রহ-১৫৯) ঢাকার বাংলা একাডেমীর সংগ্রহশালায়। অবশ্য পুঁথিটি লিখিত হওয়ার তারিখ ১৮৫০ হলেও, পুঁথিটি নবীন নয়।

কুলসাধক সর্বদা কুমারীপূজনে ভক্তিমান হবে। কুব্জিকাতন্ত্রে কুমারীকে দেবীজ্ঞানে অন্ন, জল, বস্ত্র এবং পূজার বিবিধ প্রকারের উপকরণ প্রদানের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কুমারী পূজার কালে কুমারী কন্যাকে পূজার উপকরণ হিসেবে অন্ন, বস্ত্র, জলদান করতে হয়। কুমারী পূজায় কুমারীরূপ দেবীর সম্মুখে প্রদেয় অন্ন মেরুপর্বতের সমান হয়ে যায়। কুমারীকে প্রদত্ত জল সাগর সমান হয়ে, বস্ত্র অনন্ত কোটি সমান হয়ে এবং পূজার বিভিন্ন প্রকারের উপকরণ সহস্র কোটিগুণে বর্ধিত হয়ে শিবলোকে দেবীর সম্মুখে পৌঁছে যায়।

কুলাস্ত্রিয়ং মহাদেবি তন্ত্রমন্ত্রবিশারদাম্ ।
দূতীযাগ-রাতাঞ্চৈব বেশ্যাং বা পুংশ্চলীং তথা ।।
বৃদ্ধাং বা যুবতীং বাপি নমস্কুৰ্য্যাদ্ বরাননে।
কুমারীপূজনে চৈব সদা ভক্তিযুতো ভবেৎ।।
পঞ্চবর্ষং সমারভ্য যাবৎ দ্বাদশবার্ষিকী ।
কুমারী সা ভবেদ্দেবি নিজরূপ-প্রকাশিনী ।।
ষষ্ঠবর্ষং সমারভ্য যাবচ্চ নববার্ষিকী ।
তাবচ্চৈব মহেশানি সাধকাভীষ্টসিদ্ধিদা ।।
অষ্টবর্ষং সমারভ্য যাবৎ ত্রয়োদশবার্ষিকী।
কুলজাং তাং বিজানীয়াৎ তন্ত্র পূজাং সমাচরেং ।।
দশবর্ষং সমারভ্য যাবৎ ষোড়শবার্ষিকী ।
যুবতীং তাং বিজ্ঞানীয়াৎ দেবীতুল্যাং বিচিন্তয়েৎ।।
অন্নং বস্ত্রং তথা নীরং কুমার্য্যৈ যো দদাতি হি ।
অন্নং মেরুসমং দেবি জলঞ্চ সাগরোপমম্ ৷৷
বস্ত্ৰৈঃ কোটিসহস্রৈস্তু শিবলোকে মহীয়তে।
পূজোপকরণঞ্চৈব কুমাৰ্য্যৈ যো দদাতি হি।।
(কুব্জিকাতন্ত্র: ৭.৩৪-৪১)

"হে মহাদেবি । কুলস্ত্রী তন্ত্রমন্ত্র-রতা এবং দূতীযাগ-রতা হলে, সে বেশ্যা বা পুংশ্চলী, বৃদ্ধা বা যুবতী যে নারীই হোক না কেন তাঁকে নমস্কার করবে ।কুলসাধক সর্বদা কুমারীপূজনে ভক্তিমান হবে।

পঞ্চম বর্ষ হতে আরম্ভ করে দ্বাদশ বর্ষ বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত কন্যাকে কুমারী বলা হয়। এই সময় সে নিজরূপ প্রকাশ করে ।
হে মহেশানি। ষষ্ঠ বছর হতে নবম বছরের বয়স্কা কুমারী সাধকের অভীষ্টদায়িকা হয়ে থাকে।
অষ্টমবছর হতে আরম্ভ করে ত্রয়োদশ বছরের কন্যাকে কুলজা জ্ঞানে পূজা করবে।
দশবছর হতে ষোড়শবর্ষী যুবতী কুমারী কন্যাকে দেবীতুল্য চিন্তা করবে।
কুমারী পূজার কালে কুমারী কন্যাকে পূজার উপকরণ হিসেবে অন্ন, বস্ত্র, জলদান করা হয়। সেই অন্ন মেরুপর্বত সমান হয়ে, সেই জল সাগর সমান হয়ে, সেই দানকৃত বস্ত্র অনন্ত কোটি সমান হয়ে এবং পূজার বিভিন্ন প্রকারের উপকরণ সহস্র কোটিগুণে গুণিত হয়ে শিবলোকে দেবীসমীপে গমন করে।"

মনুসংহিতায় মহর্ষি মনু বলেছেন, নারী পূজ্যা, সমাদরনীয়া, ভূষনীয়া, সম্মাণীয়া ও বংশের শ্রীবৃদ্ধির প্রধান কারণ। যদি কেউ বহু কল্যাণের আকাঙ্ক্ষা করে, তবে গৃহের কন্যাদিগকে ভোজনাদির দ্বারা পূজা বা সন্তুষ্ট করবে এবং বস্ত্র অলঙ্কারাদির দ্বারা ভূষিত করবে।যে বংশে নারীরা বস্ত্রালঙ্করাদি দ্বারা পূজা বা সমাদর প্রাপ্ত হয়, সেখানে দেবগণ প্রসন্ন হয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে যে বংশে স্ত্রীলোকেরা সন্তুষ্ট থাকে, সেই বংশ নিশ্চিতভাবেই শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। এবং দেবতারাও সেই বংশের প্রতি প্রসন্ন হয়। কিন্তু ভগিনী, পত্নী, পুত্রবধূ প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা যে বংশে অনাদৃত, অপমানিত সেই বংশ বিষপান করা ব্যক্তির ন্যায় ধন-পশু প্রভৃতিসহ সর্বতোভাবে বিনাশপ্রাপ্ত হয়।দেবতারাও সেই বংশের প্রতি রুষ্ট হন।

পিতৃভির্ভ্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভির্দেবরৈস্তথা।
পূজ্যা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহুকল্যাণমীপ্সুভিঃ।।
যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।
শোচন্তি জাময়ো যত্র বিনশ্যন্ত্যাশু তৎ কুলম্।
ন শোচন্তি তু যত্রৈতা বর্দ্ধতে তদ্ধি সর্বদা।।
জাময়ো যানি গেহানি শপন্ত্যপ্রতিপূজিতাঃ।।
তানি কৃত্যাহতানীব বিনশ্যন্তি সমন্ততঃ।।
তস্মাদেতাঃ সদা পূজ্যা ভূষণাচ্ছাদনাশনৈঃ।
ভূতিকামৈর্নরৈর্নিত্যং সত্কারেষূৎসবেষু চ।।
(মনুসংহিতা:৩.৫৫-৫৯)

"বিবাহসময়ে পতিই কেবল কন্যাকে ধনাদি দিবেন এমন নয়, বিবাহোত্তর কালেও পিতা, ভ্রাতা, পতি, দেবর ইহারা সকলেই যদি বহুকল্যাণরাশির অভিলাষী হয়, তবে ঐ কন্যাদিগকে ভোজনাদির দ্বারা পূজা করবে ও বস্ত্র অলঙ্কারাদির দ্বারা ভূষিত করবে।
যে বংশে নারীরা বস্ত্রালঙ্করাদি দ্বারা পূজা বা সমাদর প্রাপ্ত হন, সেখানে দেবগণ প্রসন্ন হয়ে থাকেন এবং দেবতারা প্রসন্ন হলে পরিবারের সবাই অভীষ্ট ফল প্রাপ্ত হয়। অন্যথা যে বংশে নারীরা সমাদরনীয় নয়, সে গৃহে যাগ,হোম, দেব আরাধনাদি সমস্ত ক্রিয়াই নিষ্ফল হয়ে যায়।

যে বংশে ভগিনী ও গৃহস্থের সপিণ্ড স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধূ প্রভৃতি নারীরা ভূষণ-আচ্ছাদন-অন্নাদির অভাবে দুঃখিনী হয়, সেই বংশ অতিশীঘ্র ধ্বংস প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ দৈব ও রাজাদের দ্বারা পীড়িত হয়।পক্ষান্তরে যে বংশে নারীরা ভোজন-আচ্ছাদনাদিতে দুঃখী না থেকে সন্তুষ্ট থাকে সেই বংশের নিশ্চিতভাবে শ্রীবৃদ্ধি হয়।

ভগিনী, পত্নী, পুত্রবধু প্রভৃতি স্ত্রীরা অনাদৃত হয়ে যে বংশকে উদ্দেশ্য করে অভিশাপ দেন, সেই বংশ অভিচার হতের মত ধনপশু প্রভৃতির সহিত সর্বতোভাবে বিনাশ প্রাপ্ত হয়।

অতএব যারা ভূতি অর্থাৎ ঐশ্বর্য্য সম্পদাদি কামনা করেন, এইরকম পতিসম্বন্ধীয় লোকেরা উপনয়ন, অন্নপ্রাশন প্রভৃতি বিভিন্ন সৎকার্য্যানুষ্ঠানে এবং নানা উৎসবে অলঙ্কার, বস্ত্র ও ভোজনাদির দ্বারা নিত্য নারীদের পূজা করবে; অর্থাৎ সম্মানিত করবে।"

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

14/10/2023

অপরাজিতা 'দেবীসূক্ত'

আদ্যাশক্তি মহামায়া অচিন্ত্য, এরপরেও অসুর নিধনে তিনি বারেবারেই আবির্ভূতা হন। পুরাকালে শুম্ভনিশুম্ভ নামক দুই অসুরদ্বয় মহাপ্রতাপশালী হয়ে ত্রিলোক জয় করে নেয়। তারা স্বর্গের অধিকারের সাথে সাথে দেবতাদের যজ্ঞভাগ পর্যন্ত গ্রহণ করা শুরু করে দেয়। আসুরিক শক্তির প্রভাবে এভাবে, দৈবশক্তির পক্ষে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠে। তখন সূর্য, চন্দ্র, কুবের, যম, বরুণ, অগ্নি ইত্যাদি প্রধান দেবতাগণ শুম্ভনিশুম্ভ নামক মহাসুরদ্বয় কর্তৃক স্ব-স্ব অধিকার হতে বিচ্যুত ও স্বর্গ হতে বিতাড়িত হয়ে বিপদ থেকে উদ্ধারে আদ্যাশক্তি মহামায়ার স্মরণ করে। তখন দেবী অপরাজিতা দুর্গারূপে দেবতাদের সম্মুখে আবির্ভূত হন। অপরাজিতা তাঁকেই বলা হয়, যাঁকে কখনো পরাজিত করা যায় না।

হতাধিকারাস্ত্রিদশাস্তাভ্যাং সর্বে নিরাকৃতাঃ ।
মহাসুরাভ্যাং তাং দেবীং সংস্মরন্ত্যপরাজিতাম্ ॥
তয়াস্মাকং বরো দত্তো যথাপসু স্মৃতাখিলা ।
ভবতাং নাশয়িষ্যামি তৎক্ষণাৎ পরমাপদঃ ॥
(শ্রীচণ্ডী:৫.৫-৬)

সকল দেবতারা সম্মিলিতভাবে মহাদেবীর সন্তুষ্টির জন্য, তাঁর উদ্দেশ্যে স্তব করে। দেবতাদের স্তবে প্রসন্ন হয়ে অপরাজিতারূপিণী দুর্গা শুম্ভনিশুম্ভ নামক অসুরভ্রাতৃদ্বয়কে বিনাশ করে। দেবতাদের কৃত এই স্তোবকে তান্ত্রিক দেবীসূক্ত বলে অবিহিত করা হয়। স্তবটি যেহেতু মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীচণ্ডীর অন্তর্ভুক্ত তাই একে পৌরাণিক দেবীসূক্ত বলার কথা। কিন্তু কেন তান্ত্রিক দেবীসূক্ত বলা হয়, সে বিষয়টি অজ্ঞাত। অত্যন্ত পবিত্র তান্ত্রিক দেবীসূক্তকে 'অপরাজিতাস্তব' নামেও অবিহিত করা হয়। কারণ দেবতারা দেবীকে যখন স্তোত্র করছিলেন, তখন মহাদেবী এক অপরাজিতা নারীমূর্তিতে আবির্ভূতা হয়েছিলেন।লক্ষ্মীতন্ত্রে এই স্তোব প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এই দেবীসৃক্ত সর্বফলদায়ক। এই সৃক্ত দ্বারা নিত্য দেবীর স্তব করলে মানুষ সকল ক্লেশ অতিক্রম করে মুক্তিরূপ মহাঐশ্বর্য লাভ করেন।

নমো দেব্যাদিকং দেবীসূক্তং সর্বফলপ্ৰদম্ ।
ইমাং দেবীং স্তবন্নিত্যং স্তোত্রেণানেন মামিহ ॥ ক্লেশানতীত্য সকলানৈশ্বৰ্যং মহদশ্নুতে ॥

সাত্ত্বিকী, রাজসী ও তামসী প্রকৃতিভেদে বিষ্ণুমায়া ত্রিবিধা। এই জন্য প্রত্যেকটি শ্লোকে তিনবার করে ‘তস্যৈ' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বিষ্ণুমায়ার সৃষ্টিশক্তি রাজসী, স্থিতিশক্তি সাত্ত্বিকী এবং সংহারশক্তি তামসী।কায়িক, বাচিক ও মানসিক এই তিন প্রকারের প্রণামকে উপলক্ষ করে প্রত্যেক শ্লোকের শেষে ‘নমঃ' শব্দের ত্রিরুক্তি করা হয়েছে।

দেবা ঊচুঃ । ৮ (ওঁ ঐ)
নমো দেব্যৈ মহাদেব্যৈ শিবায়ৈ সততং নমঃ।
নমঃ প্ৰকৃত্যৈ ভদ্রায়ৈ নিয়তাঃ প্রণতাঃ স্ম তাম্ ॥ ৯
রৌদ্রায়ৈ নমো নিত্যায়ৈ গৌৰ্যৈ ধাত্র্যৈ নমো নমঃ । জ্যোৎস্নায়ৈ চেন্দুরূপিণ্যৈ সুখায়ৈ সততং নমঃ ॥ ১০ কল্যাণ্যৈ প্ৰণতা বৃদ্ধ্যৈ সিদ্ধ্যৈ কুৰ্মো নমো নমঃ ।
নৈঋত্যৈ ভূভৃতাং লক্ষ্ম্যৈ শৰ্বাণ্যৈ তে নমো নমঃ ॥১১
দুর্গায়ৈ দুর্গপারায়ৈ সারায়ৈ সর্বকারিণ্যৈ ।
খ্যাত্যৈ তথৈব কৃষ্ণায়ৈ ধূম্ৰায়ৈ সততং নমঃ ॥ ১২
অতিসৌম্যাতিরৌদ্রায়ৈ নতাস্তস্যৈ নমো নমঃ ।
নমো জগৎপ্রতিষ্ঠায়ৈ দেব্যৈ কৃত্যৈ নমো নমঃ ॥ ১৩
যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা।
নমস্তস্যৈ (১৪) নমস্তস্যৈ (১৫) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ১৬
যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে।
নমস্তস্যৈ (১৭) নমস্তস্যৈ (১৮) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ১৯
যা দেবী সর্বভূতেষু বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (২০) নমস্তস্যৈ (২১) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ২২
যা দেবী সর্বভূতেষু নিদ্রারূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (২৩) নমস্তস্যৈ (২৪) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ২৫
যা দেবী সর্বভূতেষু ক্ষুধারূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (২৬) নমস্তস্যৈ (২৭) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ২৮
যা দেবী সর্বভূতেষু ছায়ারূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (২৯) নমস্তস্যৈ (৩০) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৩১
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (৩২) নমস্তস্যৈ (৩৩) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৩৪
যা দেবী সর্বভূতেষু তৃষ্ণারূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (৩৫) নমস্তস্যৈ (৩৬) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৩৭
যা দেবী সর্বভূতেষু ক্ষান্তিরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (৩৮) নমস্তস্যৈ (৩৯) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৪০
যা দেবী সর্বভূতেষু জাতিরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (৪১) নমস্তস্যৈ (৪২) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৪৩
যা দেবী সর্বভূতেষু লজ্জারূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ (৪৪) নমস্তস্যৈ (৪৫) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৪৬
যা দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (৪৭) নমস্তস্যৈ (৪৮) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৪৯
যা দেবী সর্বভূতেষু শ্রদ্ধারূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ (৫০) নমস্তস্যৈ (৫১) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৫২
যা দেবী সর্বভূতেষু কান্তিরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (৫৩) নমস্তস্যৈ (৫৪) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৫৫
যা দেবী সর্বভূতেষু লক্ষ্মীরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (৫৬) নমস্তস্যৈ (৫৭) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৫৮
যা দেবী সর্বভূতেষু বৃত্তিরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (৫৯) নমস্তস্যৈ (৬০) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৬১
যা দেবী সর্বভূতেষু স্মৃতিরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (৬২) নমস্তস্যৈ (৬৩) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৬৪
যা দেবী সর্বভূতেষু দয়ারূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ (৬৫) নমস্তস্যৈ (৬৬) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৬৭
যা দেবী সর্বভূতেষু তুষ্টিরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ(৬৮) নমস্তস্যৈ(৬৯) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥৭০
যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ(৭১) নমস্তস্যৈ (৭২) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৭৩
যা দেবী সর্বভূতেষু ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতা । নমস্তস্যৈ(৭৪) নমস্তস্যৈ (৭৫) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ৭৬
ইন্দ্রিয়াণামধিষ্ঠাত্রী ভূতানাঞ্চাখিলেষু যা ।
ভূতেষু সততং তস্যৈ ব্যাপ্তিদেব্যৈ নমো নমঃ ॥৭৭
চিতিরূপেণ যা কৃৎস্নমেতদ্ ব্যাপ্য স্থিতা জগৎ । নমস্তস্যৈ(৭৮) নমস্তস্যৈ (৭৯) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥৮০
(শ্রীচণ্ডী:৫.৮-৮০)

"মহামায়া অপরাজিতাকে দেবগণ বললেন—দেবীকে প্রণাম এবং মহাদেবীকে প্রণাম। সতত মঙ্গলদায়িনীকে প্রণাম। সৃষ্টিশক্তিরূপিণী প্রকৃতিকে প্রণাম। স্থিতিশক্তিরূপিণী ভদ্রাকে প্রণাম। নিত্য আমরা সমাহিত চিত্তে তাঁকে প্রণাম করি। ৮-৯
সংহারশক্তিস্বরূপা রৌদ্রাকে প্রণাম। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এ ত্রিকালাতীত সত্তারূপিণীকে নিত্যাকে প্রণাম। গৌরী এবং জগদ্ধাত্রীকে প্রণাম। জ্যোৎস্নারূপা, চন্দ্ররূপা ও সুখস্বরূপাকে সতত প্রণাম। ১০
কল্যাণী, সমৃদ্ধিরূপা ও সিদ্ধিরূপা দেবীকে বারবার প্রণাম করি। অলক্ষ্মীরূপা, ভূপতিগণের লক্ষ্মীরূপা শর্বাণী দেবীকে বারবার প্রণাম করি। ১১
দুরধিগম্যা দুর্গা, দুস্তর সংসার সমুদ্র থেকে পরিত্রাণকারী, শক্তিরূপিণী, সর্ব কারণের কারণ, আদ্যাশক্তি নামে খ্যাতা, কৃষ্ণবর্ণা ও ধূম্রবর্ণা দুর্গা দেবীকে বারবার প্রণাম করি। ১২
বিদ্যারূপে অতিসৌম্যা এবং অবিদ্যারূপে অতি রৌদ্রাকে প্রণাম করি। তাঁকে বারবার প্রণাম। জগতের আশ্রয়রূপিণীকে এবং ক্রিয়ারূপা দেবীকে বারবার প্রণাম। ১৩
যে দেবী সকল প্রাণীতে বিষ্ণুমায়া নামে বেদাদি শাস্ত্রে অভিহিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার। ১৪-১৬
যে দেবী সকল প্রাণীর চেতনারূপে প্রসিদ্ধা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার। ১৭-১৯
যে দেবী সকল প্রাণীর বুদ্ধিরূপে অবস্থিতা তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।২০-২২
যে দেবী সর্বভূতে নিদ্রারূপে বিরাজিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার। ২৩-২৫
যে দেবী সর্বভূতে ক্ষুধারূপে অবস্থিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।২৬-২৮
যে দেবী সর্বপ্রাণীতে ছায়ারূপে অবস্থিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।২৯-৩১
যে দেবী সর্বপ্রাণীতে শক্তিরূপে অধিষ্ঠিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার। ৩২-৩৪
যে দেবী সর্বভূতে বিষয়-বাসনা নামক তৃষ্ণারূপে সংস্থিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার। ৩৫-৩৭
যে দেবী সর্বভূতে ক্ষমারূপে, অর্থাৎ সামর্থ্যসত্ত্বেও অপকারীর প্রতি অপকারের অনিচ্ছারূপে অবস্থিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার। ৩৮-৪০
যে দেবী সর্বপ্রাণীতে জাতিরূপে সংস্থিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।৪১-৪৩
যে দেবী সর্বভূতে লজ্জারূপে; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।৪৪-৪৬
যে দেবী সর্বপ্রাণীতে শান্তিরূপে সংস্থিতা;তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।৪৭-৪৯
যে দেবী সর্বভূতে শ্রদ্ধারূপে অবস্থিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।৫০-৫২
যে দেবী সর্বপ্রাণীতে কান্তিরূপে অবস্থিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার। ৫৩-৫৫
যে দেবী সর্বপ্রাণীতে লক্ষ্মীরূপে অবস্থিতা;তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।৫৬-৫৮
যে দেবী সর্বভূতে কৃষি, গোরক্ষা ও বিবিধ বাণিজ্যাদি জীবিকা রূপে সংস্থিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।৫৯-৬১
যে দেবী সর্বভূতে স্মৃতিরূপে অবস্থিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার। ৬২-৬৪
যে দেবী সর্বপ্রাণীতে দয়ারূপে অবস্থিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।৬৫-৬৭
যে দেবী সর্বভূতে সন্তোষরূপে বা যথালাভে তুষ্টি, প্রাপ্ত বস্তুর অধিক প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা শূন্যতারূপে
অবস্থিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার। ৬৮-৭০
যে দেবী সর্বপ্রাণীতে মাতৃরূপে অবস্থিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।৭১-৭৩
যে দেবী সর্বভূতে ভ্রান্তিরূপে সংস্থিতা;তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।৭৪-৭৬
যিনি সকল প্রাণীতে চতুর্দশ ইন্দ্রিয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবতারূপে বিরাজিতা এবং যিনি পৃথিবী আদি পঞ্চ স্থূল ও পঞ্চ সূক্ষ্ম ভূতের প্রেরয়িত্রী, সেই বিশ্বব্যাপিকা' ব্রহ্মশক্তিরূপা দেবীকে বারংবার প্রণাম। ৭৭
যিনি চিৎশক্তিরূপে এই সমগ্র জগৎ ব্যাপিয়া অবস্থিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।৭৮-৮০"

ঋগ্বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের ১২৫ সূক্ত সূক্ত 'দেবীসূক্ত'। বৈদিক এ সূক্তে আদ্যাশক্তি মহামায়ার মহিমা বর্ণিত হয়েছে। আটটি ঋগ্বেদীয় দেবীসূক্তের মন্ত্রদ্রষ্ট্রী ঋষি হলেন অম্ভৃণ মহর্ষির কন্যা বাক্। তিনি ধ্যানযোগে সমাধি অবস্থায় নিজের মধ্যেই আদ্যাশক্তি মহামায়াকে উপলব্ধি করে এ মন্ত্রটি দর্শন করেছিলেন। সূক্তের মন্ত্রগুলোতে উপলব্ধি করা যায় যে, অম্ভৃণ মহর্ষির কন্যা বাক্ জগতের পরমেশ্বরী আদ্যাশক্তি মহামায়ার সাথে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। এ অবস্থানেই সাধকের মুক্তি ঘটে। এ সূক্তে শুধু দ্বিতীয় মন্ত্রটিই জগতীছন্দে রচিত, অন্য অবশিষ্ট সাতটি মন্ত্রই ত্রিষ্টুচ্ছন্দে রচিত। পরব্রহ্মময়ী আদ্যাশক্তি জগন্মাতার প্রীতির জন্য এ সূক্তটির বিনিয়োগ করা হয়।সপ্তশতী শ্রীচণ্ডী পাঠ করার পরে দেবীসূক্ত-পাঠের বিধান রয়েছে। ঋগ্বেদ সংহিতা দেবীসূক্তের প্রথমমন্ত্র হল:

অহং রুদ্রেভির্বমুভিশ্চরা-
ম্যহমাদিত্যেরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভ-
র্ম্যহমিদ্ৰাগ্নী অহমশ্বিনোভা॥
(ঋগ্বেদ সংহিতা: ১০.১২৫.১)

"আমি একাদশ রুদ্ররূপে, অষ্টবসুরূপে, দ্বাদশ আদিত্যরূপে এবং সর্বদেবরূপে জগতে বিচরণ করি।আমি মিত্র ও বরুণ, উভয় দেবতাকে ধারণ করি। আমি ইন্দ্র, অগ্নি এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে ধারণ করি।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

14/10/2023

তন্ত্রে প্রতিমাপূজা মাহাত্ম্য

দেবতাগণ মন্ত্রময়। তাই মন্ত্রে আবাহন করে, অনন্য চিত্ত হয়ে ধ্যান করে, বিবিধ প্রকারের মুদ্রা প্রদর্শন করে, গন্ধপুষ্প অক্ষতের দ্বারা দেবীর পূজা করতে হয়।

মন্ত্রেণানেন চাবাহ্য যজেদ্দেবীমনন্যধীঃ ।
ধ্যাত্বা মুদ্রাং প্রদর্শ্যার্থ গন্ধপুষ্পাক্ষতাদিভিঃ ॥
(কুলার্ণবতন্ত্র: ৬.৭২)

"মন্ত্রে আবাহন করে, অনন্যধী হয়ে ধ্যান করে, বিবিধ প্রকারের মুদ্রা প্রদর্শন করে, গন্ধপুষ্প অক্ষতের দ্বারা দেবীর পূজা করতে হবে।"

ব্রহ্ম অচিন্ত্য বা জীবের চিন্তার অতীত। তাই অধিকারী সাধকদের হিত বা কল্যাণের জন্যই সেই চিন্ময়স্বরূপ, প্রমাণের অতীত, নির্গুণ ত্রিগুণিত, অশরীরী বা যাঁর কোন প্রাকৃত শরীর নেই। সেই ব্রহ্মের রূপকল্পনা করা হয় ।

চিন্ময়স্যাপ্রমেয়স্য নির্গুণস্যা শরীরিণঃ।
সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনা ॥
(কুলার্ণবতন্ত্র: ৬.৭৩)

" অধিকারী সাধকদের হিত বা কল্যাণের জন্যই চিন্ময়, অপ্রমেয়, নির্গুণ, অশরীরী ব্রহ্মের রূপকল্পনা করা হয় ।"

সাধকদের কল্যাণের জন্যই চিন্ময়, অপ্রমেয়, নির্গুণ, অশরীরী ব্রহ্মের রূপকল্পনা বিষয়টি বেদসহ বিবিধ পুরাণেও বলা হয়েছে। অষ্টাদশ পুরাণের অন্যতম বিষ্ণুপুরাণে অক্রূরের উক্তিতে বর্ণিত, নিরাকার পরম ব্রহ্মই জগতের আদি কারণ পরম ব্রহ্ম অবিকারী, জন্মরহিত, নাম রূপহীন, কল্পনার অতীত, বাক্য দ্বারা অনির্দেশ্য। কিন্তু সেই সর্বব্যাপী অব্যক্ত পরমেশ্বরকে কল্পনা ব্যাতীত অন্য কোন উপায়ে স্তুতি করা যায় না। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব এই ত্রিদেব সেই অব্যক্ত নিরাকার ব্রহ্মেরই কল্পিত নাম ও রূপ।

প্রসীদ সর্ব সর্বাত্মান্ ক্ষরাক্ষরময়েশ্বর।
ব্রহ্মবিষ্ণুশিবাদ্যাভিঃ কল্পনাভিরুদীরিতঃ।।
অনাখ্যেয়স্বরূপাত্মন্ অনাখ্যেয়প্রয়োজন
অনাখ্যেয়াভিধানং ত্বাং নতোঽস্মি পরমেশ্বর।
ন যত্র নাথ বিদ্যন্তে নামজাত্যাদিকল্পনাঃ।
তদব্রহ্ম পরমং নিত্যমবিকারী ভবানজ।
ন কল্পনামৃতেঽর্থস্য সর্বস্যাধিগমো যতঃ।
ততঃ কৃষ্ণাচ্যুতানন্ত-বিষ্ণুসংজ্ঞাভিরাড্যতে।।
(বিষ্ণুপুরাণ:৫.১৮.৫১-৫৪)

"হে সর্ব! হে সর্ব্বাত্মন! হে ক্ষরাক্ষরময়! হে ঈশ্বর! তুমি প্রসন্ন হও। হে ভগবান! ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবাদি রূপ কল্পনা করে তোমার স্তব করছি, তুমি প্রসন্ন হও।
হে অব্যক্ত পরমেশ্বর! তোমাকে নাম ও বাক্য দ্বারা নির্দেশ করা যায় না। হে প্রভু! তোমাকে নমস্কার।

হে নাথ, হে অজ (জন্মরহিত)! যাঁর নাম রূপ ও জাতির কল্পনা করা যায় না, তুমিই সেই নিত্য অবিকারী পরম ব্রহ্ম।
হে প্রভু! যেহেতু কল্পনা ব্যাতীত সমস্তকিছুরই জ্ঞান সম্ভব নয়, তাই তোমাকে শ্রীকৃষ্ণ, বিষ্ণু, অচ্যুত প্রভৃতি নামে কল্পনা করে জীব উপাসনা করে থাকে।"

কুলার্ণবতন্ত্রে দশটি পূজাস্থান বর্ণিত হয়েছে। সে দশটি পূজাস্থানে কর্মকাণ্ড নিরত ব্যক্তিরা অরূপ পরমশিবা আদ্যাশক্তিকে রূপধারিণী রূপে কল্পনা করে পূজা করে। সে দশটি পূজাস্থান হলো:

১. লিঙ্গ: শিবলিঙ্গ মূর্তি বা নর্মদা নদীতে উৎপন্ন বাণলিঙ্গ।

২. স্থণ্ডিল : মাটি বা বালুকার তৈরি চতুষ্কোণ যজ্ঞবেদি।

৩.বহ্নি: যজ্ঞের অগ্নি।

৪. অম্বু: সপ্তসিন্ধু, গঙ্গা, যমুনা ইত্যাদি নদী বা বিবিধ সরোবর কুণ্ডের জল।

৫.সূর্প: ধান, গম ইত্যাদি শষ্য ঝাড়ার কুলা।

৬. কুড্য : গৃহ বা মন্দিরের ভিত্তি বা দেয়াল।

৭.পট: সংস্কৃত পট্ট (কাপড়) শব্দ থেকে পট শব্দের উৎপত্তি, আর এই পটে অঙ্কিত বিভিন্ন দেবদেবীর চিত্রই হচ্ছে পটচিত্র।

৮. মণ্ডল: প্রতীকের জ্যামিতিক আকৃতি হলো মণ্ডল বা যন্ত্র। মনকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য, আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনায় মণ্ডলের প্রয়োগ হয়।

৯.ফলক: ত্রিশুলাদি অস্ত্রের ফলক।

১০. মূৰ্দ্ধা অথবা হৃদয় : মস্তকে হৃদয়ে বিগ্রহাদি বিহীন মানসপটে অচিন্ত্য ব্রহ্মের মানসপূজার স্থান ।

লিঙ্গস্থণ্ডিলবহ্ন্যম্‌ বুসূৰ্পকুভ্যপটেষু চ।
মণ্ডলে ফলকে মূর্দ্ধি হৃদি বা দশ কীর্তিতাঃ।।
এষু স্থানেষু দেবেশি যজন্তি পরমাং শিবাম্‌।
অরূপাং রূপিণীং কৃত্বা কর্মকাণ্ডরতা নরাঃ ॥
(কুলার্ণবতন্ত্র: ৬.৭৪-৭৫)

"লিঙ্গ, স্থণ্ডিল, বহ্নি, অম্বু, সূর্প, কুড্য ( দেয়াল ), পট, মণ্ডল, ফলক, মূৰ্দ্ধা, অথবা হৃদয় এই দশটি পূজাস্থান বলে প্রখ্যাত। দেবেশী, কর্মকাণ্ড নিরত ব্যক্তিরা অরূপ পরমশিবাকে রূপধারিণী কল্পনা করে এ সকল স্থানে পূজা করে।"

কুলার্ণবতন্ত্রে অত্যন্ত সুন্দর করে একটি অসাধারণ দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন পরমেশ্বর সর্বত্র বিরাজমান হলেও কেন প্রতিমায় তাঁকে উপাসনা করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, গাভীর সারা শরীরে দুধ বা দুধের উপাদান থাকলেও সে দুধ শরীরের অন্য কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাঝে পাওয়া যায় না। দুধ শুধু গাভীর স্তনমুখেই ক্ষরিত হয়, তেমনি পরমেশ্বর সর্বগত হলেও প্রতিমাদিতে দীপ্তি পান।

গবাং সর্বাঙ্গজং ক্ষীরং স্রবেৎ স্তনমুখাৎ যথা।
তথা সর্বগতো দেবঃ প্রতিমাদিষু রাজতে ॥
(কুলার্ণবতন্ত্র: ৬.৭৬)

"গাভীর সর্বাঙ্গে দুধ থাকলেও তা যেমন স্তনমুখে ক্ষরিত হয় তেমনি দেবতা সর্বগত হলেও প্রতিমাদিতে দীপ্তি পান।"

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মূর্তিপূজা করে না, তাঁরা মূর্তিতে পরমেশ্বরের উপাসনা করে। আরও বিশেষ করে বলতে গেলে মূর্তিকে প্রতিমায় রূপান্তরিত করে উপাসনা করে। অর্থাৎ মৃন্ময়ী প্রতিমাকে চিন্ময়ী প্রতিমাতে রূপান্তরিত করে উপাসনা করে। প্রতিমার সৌন্দর্যে, পূজার বিশেষত্বে এবং সাধকের সুতীব্র বিশ্বাস ও ভক্তিতেই মৃন্ময়ী, দারুময়ী, শিলাময়ী বা ধাতুময়ী প্রতিমা চিন্ময়ী প্রতিমায় রূপান্তরিত হয়।

আভিরূপ্যাচ্চ বিমবস্য পূজায়াশ্চ বিশেষতঃ।
সাধকস্য চ বিশ্বাসাৎ সন্নিধৌ দেবতা ভবেৎ ॥
(কুলার্ণবতন্ত্র: ৬.৭৭)

"প্রতিমার সৌন্দর্যে, পূজার বিশেষত্বে এবং সাধকের বিশ্বাসে দেবতা সন্নিধিস্থ হন।"

শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য ও বৈষ্ণবাদি যেকোন মতে এবং কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি, যোগ ও তন্ত্রসহ যে কোন পন্থায় পরমেশ্বরের উপাসনা করা যায়। দুধের মাঝে সর্পি বা মাখন যেমন বিরাজ করে, আদ্যাশক্তি পরমেশ্বরী মহামায়াও জীবের সর্বশরীরে সর্পির মত বিরাজিতা। তবে তিনি জীবেত সর্বশরীরে বিরাজিতা হলেও, উপাসনা বিনা জীবকে কৃপা করেন না।

গবাং সর্পিঃ শরীরস্থং ন করোত্যঙ্গপোষণম্‌ । স্বকর্মরচিতং দত্তং পুনস্তামেব পোষয়েৎ ॥
এবং সর্বশরীরস্থা সর্পিবৎ পরমেশ্বরী।
বিনা চোপাসনাং দেবি ন দদাতি ফলং নৃণাম্‌ ॥
(কুলার্ণবতন্ত্র: ৬.৭৮-৭৯)

"গাভীর শরীরস্থ সর্পি, অর্থাৎ গোদুগ্ধের মধ্যে অবস্থিত সর্পি গাভীর শরীরকে পুষ্ট করে না । কিন্তু কোন ব্যক্তি নিজের কর্মের দ্বারা অর্থাৎ দুগ্ধদোহন ইত্যাদি ক্রমে তা তৈরি করে গাভীকে যদি খেতে দেয়, তবে সেই সর্পিই গাভীর শরীরকে পুষ্ট করে তোলে।

হে দেবী, এই প্রকারে পরমেশ্বরী জীবের শরীরে সর্পির মত সর্বশরীরে বিরাজিতা হলেও, উপাসনা বিনা মনুষ্যকে ফল প্রদান করেন না।"

দেবতার সকলীকরণ করে, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়সমূহের উদ্দীপন করে বিগ্রহাদি প্রতিষ্ঠা করে, তবেই পূজা সম্পন্ন করতে হয়।

সকলীকৃত্য তৎপ্রাণান্ সমুদ্দীপ্যেন্দ্রিয়াণি চ। প্রতিষ্ঠাপ্যার্চয়েদ্দেবি চান্যথা নিষ্ফলং ভবেৎ ॥
(কুলার্ণবতন্ত্র: ৬.৮০)

"হে দেবী, দেবতার সকলীকরণ করে, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়সমূহের উদ্দীপন করে বিগ্রহাদি প্রতিষ্ঠা করতে হবে । এরপর পূজা করতে হবে । নৈলে, সে-পূজা ব্যর্থ হবে।"

শাস্ত্রে মন্ত্রহীন, ক্রিয়াহীন, বিধিহীন পূজাকে অঙ্গহীন, পদহীন পূজা বলে অবিহিত করা হয়েছে। সে অঙ্গহীন, পদহীন পূজায় কখনো সিদ্ধি লাভ হয় না।

মন্ত্রহীনং ক্রিয়াহীনং বিধিহীনঞ্চ যদ্ ভবেৎ ।
ন তৎ সাধয়তে সর্বং হীনমঙ্গং পদং তথা ॥
(কুলার্ণবতন্ত্র: ৬.৮১)

"যা মন্ত্রহীন, ক্রিয়াহীন, বিধিহীন সে-সব অঙ্গহীন, পদহীন পূজা কখনো সিদ্ধিপ্রদ হয় না।"

পূজায় কখনো নিয়মের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করতে নেই। নিয়মের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করলে পূজায় ক্রমদোষের সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর ক্রমদোষের প্রাদুর্ভাব ঘটলে সকল আয়োজনই বৃথা যায়। কিঞ্চিৎ ফললাভের সম্ভাবনাও থাকে না।

নিয়মাদতিরেকেণ যদ্ যদ্ কর্ম করোতি যঃ ।
ন কিঞ্চিদপ্যস্য ফলং সিধ্যতি ক্রমদোষতঃ ॥
(কুলার্ণবতন্ত্র: ৬.৮২)

"যে ব্যক্তি যে যে কর্মে নিয়মের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ক্রমদোষের জন্য তার সে- কর্মের কিঞ্চিৎ ফললাভও হয় না।"

পূজায় নিয়মের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি কিংবা অতিরিক্ত ঘাটতি কোনটিই কাম্য নয়। দুটি বিষয়ই পূজাকে বিফলতার দিকে ঠেলে দেয়। তাই জপ-হোম-অৰ্চনাদি কর্ম শাস্ত্রীয় বিধানানুসারে করা হলে, তবেই তা দেবতার অত্যন্ত প্রীতিপ্রদ হয়। এবং দেবতার প্রীতিপ্রদ হলে তবেই সে পূজা বা উপাদনা উপাসককে ভুক্তিমুক্তি প্রদান করে।

নূন্যতাতিরিক্তকর্মাণি ন ফলন্তি কদাচন ।
যথাবিধি কৃতানীহ সৎকর্মাণি ফলন্তি হি ॥
তদ্বিধান কৃতং কর্ম জপহোমাৰ্চনাদিষু ।
দেবতাপ্রীতিদং ভূয়াদ্ ভুক্তিমুক্তি ফলপ্ৰদম্ ॥
(কুলার্ণবতন্ত্র: ৬.৮৩-৮৪)

" যে সকল পূজায় নিয়মের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি থাকে কিংবা ঘাটতি থাকে - এ দুটিই ফল প্রদান করে না। এক্ষেত্রে যথাবিধি কৃত সৎকর্মই সফল হয়।

জপ-হোম-অৰ্চনাদি কর্ম শাস্ত্রীয় বিধানানুসারে করা হলে তা দেবতার অত্যন্ত প্রীতিপ্রদ হয় এবং ভুক্তিমুক্তি ফলপ্রদ হয়।"

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

14/10/2023

দুর্গা বৈদিককাল থেকেই পূজিতা

দেবী উপাসনা প্রাচীন বৈদিককাল থেকেই প্রচলিত। বেদের দেবীসূক্ত সহ অসংখ্য সূক্তে, মন্ত্রে দেবীমাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। শ্রীসূক্ত, ভূসূক্ত, অরণ্য সূক্ত, রাত্রিসূক্ত, দেবীসূক্ত, দুর্গাসূক্ত এ সূক্তগুলি বৈদিক দেবীমাহাত্ম্যের জাজ্বল্যমান উদাহরণ। কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকের দ্বিতীয় অনুবাকটি দুর্গাসূক্ত নামে খ্যাত। সূক্তটিতে এ জগত থেকে উদ্ধারের জন্যে জীবের কর্মফলদাত্রী অগ্নিরূপা, অগ্নিবর্ণা দুর্গাদেবীর শরণ নিতে বলা হয়েছে।তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকে দুর্গাসূক্তের সাথে সাথে একটি দুর্গাগায়ত্রী মন্ত্রও আছে, মন্ত্রটি দুর্গাপূজায় আজও ব্যবহৃত হয়।

কাত্যায়নায় বিদ্মহে, কন্যাকুমারি ধীমহি।
তন্নো দুর্গিঃ প্রচোদয়াৎ।।

কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকে দুর্গাস্তোত্র , দুর্গাগায়ত্রীর উল্লেখ থাকার পরেও কিছু মানুষ অজ্ঞানতা দ্বারা আছন্ন হয়ে বলে বেড়ায় বেদে কোন প্রতিমা পূজার কথা নেই, দেবীদুর্গার কথা নেই; যা সত্যি হাস্যকর। অনেকে বিশেষ করে দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুসারী আর্যসমাজীরা বিভিন্ন দেবদেবীর নাম, প্রসঙ্গ এবং মাহাত্ম্যকথা থাকায় বেদের ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদকে বেদ বলে মানেন না। এমনকি তারা কৃষ্ণ যজুর্বেদ সংহিতাতে বিভিন্ন দেবপ্রসঙ্গ থাকায়, কৃষ্ণ যজুর্বেদ সংহিতাকেও বাদ দিয়েছেন। যা তাদের একান্তই কষ্টকল্পিত ব্যক্তিগত মত, যার সাথে বেদবেদান্তের বা আমাদের পূর্ববর্তী ঋষিমুনিদের পরম্পরাগত মতের সম্পর্ক নেই।

জাতবেদসে সুনবাম সােম-
মরাতীয়তো নিদহাতি বেদঃ।
স ন পর্ষদতি দুর্গাণি বিশ্বা
নাবেব সিন্ধুং দুরিতাত্যগ্নিঃ।।

"আমরা অগ্নির উদ্দেশে সােমলতার অভিষেক করি। সর্বজ্ঞ অগ্নি আমাদের শত্রুগণকে সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত করুন । অপিচ, সেই অগ্নি আমাদের সমস্ত বিপদাপদ বিনষ্ট করেছেন। যেমন নাবিক নৌকার দ্বারা সমুদ্র অতিক্রম করে, তেমনি অগ্নি আমার পাপসমূহ দূরীভূত করুন।"

তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং
বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম্।
দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে
সুতরসি তরসে নমঃ।।

"আমি সেই বৈরোচনী, জ্যোতির্ময়ী অগ্নিবর্ণা, স্বীয় তাপে শত্রুদহনকারিণী, জীবের কর্মফলদাত্রী দুর্গাদেবীর শরণ নিলাম। হে সংসার-ত্রাণকারিণি দেবী তুমি আমার পরিত্রাণ করো, তোমায় প্রণাম।"

অগ্নে ত্বং পারয়া নব্যো অম্মান
স্বস্তিভিরতি দুর্গাণি বিশ্বা।
পূশ্চ পৃথ্বী বহুলা ন উর্বী ভবা
তােকায় তনয়ায় শংযােঃ।।

"হে অগ্নে, তুমি আমাদের স্তবযােগ্য হয়ে কল্যাণপ্রদ উপায়সমূহ দ্বারা সমস্ত বিপদাপদ হতে রক্ষা করে আমাদের সংসার-সমুদ্রের পরপারে নিয়ে যাও। তােমার অনুগ্রহে আমাদের বাসভূমি, পৃথিবী এবং শস্যনিস্পাদনযােগ্য ভূমিও বিস্তৃতিলাভ করুক । তুমি আমাদের পুত্ৰদানের জন্য সুখপ্রদ হও।"

বিশ্বানি নাে দুর্গহা জাতবেদঃ
সিন্ধুং ন নাবা দুরিতাঽতিপর্ষি।
অগ্নে অত্রিবন্মনসা গৃণানো
অস্মাকং বোধ্যবিতা তনূনাম্।।

" হে জাতবেদ , তুমি আমাদের সমস্ত আপদের বিনাশক হয়ে নৌকাদ্বারা সমুদ্র অতিক্ৰমতুল্য আমাদের সকল পাপ হতে উত্তরণ কর । হে অগ্নে , অত্রিঋষির ন্যায় তাপত্রয়মুক্ত হয়ে তুমি মন থেকে আমাদের কল্যাণ চিন্তা কর এবং আমাদের শরীরের রক্ষকরূপে সর্বদা অবস্থান কর।"

পৃতনাজিতং সহমানমুগ্ৰনাগ্নিং
হুবেম পরমাৎ সধস্থাৎ।
স নঃ পর্ষদতি দুর্গাণি বিশ্বা
ক্ষামদেবো অতিদুরিতাত্যগ্নিঃ।।

"আমরা পরসেনাজয়ী, শত্রুগণের অভিভবকারী, ভীতিহেতু অগ্নিকে উৎকৃষ্ট স্বীয় ভৃত্যগণ সহ অবস্থানযোগ্য দেশ হতে আহ্বান করি। সেই অগ্নি আমাদের সমস্ত বিপদাপদ দূর করেছেন। অগ্নিদেব আমাদের মত অপরাধীর সব দোষ সহ্য করে আমার যাবতীয় মহাপাপ বিনষ্ট করছেন।"

প্রত্নোষি কর্মীড্যো অধ্বরেষু
সনাচ্চ হোতা নব্যশ্চ সৎসি।
স্বাং চাগ্নে তনুবৎ পিপ্রয়-
স্বাস্মভ্যং চ সৌভগমায়জস্ব।।

"হে অগ্নে, তুমি কর্ণসমূহে স্তবযােগ্য হইয়া সুখ দান করে থাক। তুমি কর্মফলের দাতা, হােমনিষ্পাদক ও স্তবযােগ্য হয়ে কর্ণদেশে অবস্থান কর। তুমি হবি দ্বারা স্বকীয় শরীরের প্রীতি সম্পাদন কর। অনন্তর আমাদের সৌভাগ্য প্রদান করে থাক।

গােভির্জুষ্টমযুজো নিষিক্তং
তবেন্দ্র বিষ্ণোরনুসংচরেম।
নাকস্য পৃষ্ঠমভি সংবসানো
বৈষ্ণবীং লােক ইহ মাদয়ন্তাম্ ।।

"হে ইন্দ্র, ধেনুগণ-সেবিত এবং অমৃতধারা নিষিক্ত মহাভাগ্য লাভের নিমিত্ত নিস্পাপ তােমার ও বিষ্ণুর সেবক হব । স্বর্গের উপরিভাগে নিবাসশীল সমস্ত দেবতা অভীষ্ট ফল প্রদান দ্বারা বিষ্ণুভক্তিপরায়ণ আমার ভক্তি বৃদ্ধি করুন।"

'জাতবেদ' শব্দের অর্থ প্রসঙ্গে বৈদিক নিরুক্তে বলা হয়েছে:

জাতবেদাঃ কস্মাৎ ॥
জাতানি বেদ জাতানি বৈনং বিদু:,
জাতে জাতে বিদ্যত ইতি বা,
জাতবিত্তা বা জাতধনঃ,
জাতবিদ্যো বা জাতপ্ৰজ্ঞানঃ ॥
(নিরুক্ত: ৭.১৯.১-২)

"জাতবেদস্ শব্দটি কি করে নিষ্পন্ন বা এর নির্বাচন বা বুৎপত্তি কি ?
জাত বা উৎপন্ন সমস্তকেই ইনি জানেন; অথবা উৎপন্ন প্রাণিমাত্রই তাঁকে জানে; অথবা যা যা উৎপন্ন তৎসমস্তেই ইনি বিদ্যমান আছেন; অথবা ইনি জাতবিত্ত অর্থাৎ জাতধন—এ হতে ধন উৎপন্ন হয়; অথবা, ইনি জাতবিদ্য অর্থাৎ জাতপ্রজ্ঞান-ইনি নৈসর্গিক প্রজ্ঞানবিশিষ্ট।"

'জাতবেদস্' শব্দটির বৈদিক নিরুক্তে উক্ত "জাত বা উৎপন্ন সমস্তকেই ইনি জানেন অথবা উৎপন্ন প্রাণিমাত্রই তাঁকে জানে" ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য অগ্নি অর্থে যেমন ব্যবহৃত হয়; তেমনি অগ্নিরূপা আদ্যাশক্তি দুর্গা, অর্থেও ব্যবহৃত। অচিন্ত্য আদ্যাশক্তি দুর্গা জীবের সম্মুখে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা দৃষ্টিগ্রাহ্য অগ্নিরূপা। তাই আদ্যাশক্তি দেবীর পূজায় প্রজ্জ্বলিত অগ্নিতে হোম বাধ্যতামূলক। হোমে অগ্নিরূপা আদ্যাশক্তি মহামায়া কাছে বিবিধ দ্রব্যাদিতে হবি প্রদান করা হয়।সপ্তমন্ত্রের দুর্গাসূক্তটি সকল বিপদাপদ এবং অনিষ্ট পরিহারের কামনায় জপ এবং যজ্ঞাহুতির বিধান দেয়া হয়েছে। দুর্গাসূক্তের প্রথম মন্ত্রে জাতবেদ অগ্নির মাঝেই দুর্গাদেবীকে আহ্বান করে সকল শত্রুকে বিনাশের প্রার্থনা করা হয়েছে। দেবীদুর্গা অগ্নিরূপা; অগ্নিরূপা দেবীর কাছে দক্ষ সমুদ্রের নাবিকের মত সংসার সমুদ্র অতিক্রম এবং যুগপৎ সকল পাপসমূহ থেকে মুক্তির প্রার্থনা জানানো হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রে, "তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং" বলে অগ্নিই যে দুর্গাদেবীর স্বরূপ তা প্রকাশিত করা হয়েছে।সেই মুক্তিপ্রদাত্রী বৈরোচনী জ্যোতির্ময়ী অগ্নিবর্ণা, শত্রুদহনকারিণী আদ্যাশক্তি দুর্গাদেবীই জীবের কর্মফলদাত্রী। তিনিই জীবকে সংসার বন্ধনে আবদ্ধ করেন। বিপরীতে তিনিই আবার প্রসন্ন হয়ে জীবকে সংসারবন্ধন থেকে মুক্ত করেন, পরিত্রাণ করেন। তৃতীয় মন্ত্রে, অগ্নিস্বরূপা দেবীর অনুগ্রহে বাসভূমি, পৃথিবী এবং শস্যনিস্পাদনযােগ্য ভূমির বিস্তৃতি লাভের সাথে সাথে কল্যাণ প্রার্থনা করা হয়েছে। অগ্নিরূপা দেবীর কাছে পুত্ৰসন্তান দান করতে বলা হয়েছে। স্মর্তব্য সংস্কৃত পুত্র শব্দটি শুধুই পুত্র অর্থে ব্যবহৃত হয় না; সন্তানধারা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সন্তানই বংশধারাকে অবিছিন্ন বহমান করে এবং সুখপ্রদ করে তোলে।চতুর্থ মন্ত্রে, মন থেকে দেবীকে আশীর্বাদ করে শরীরের রক্ষকরূপে শরীরে সর্বদা অবস্থান করতে প্রার্থনা জানানো হয়েছে। একই প্রার্থনা আমরা দেবীকবচেও দেখতে পাই। আদ্যাশক্তি মহামায়া দেবী জীবের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে বিরাজিতা হয়ে, সেই সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে রক্ষা করছেন। দেবীর আশীর্বাদেই দেহ কবচাবৃত হয়ে দুর্গতুল্য হয়ে যায়। তখন শরীরে কোন দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে না। পঞ্চম মন্ত্রে, পরসেনাজয়ী, শত্রুগণের অভিভবকারী অগ্নিরূপা দেবীকে আহ্বান করে সকল বিপদাপদ দূর করতে প্রার্থনা জানানো হয়েছে। যারা দেবীর শরণাগত হন, অগ্নিস্বরূপা দেবী জাজ্জ্বল্যমান অগ্নির মত জীবের যাবতীয় সকল মহাপাপ নিমেষেই বিনষ্ট করে দেন। ষষ্ঠমন্ত্রে, অগ্নিরূপা দেবীকে সদা স্তবযােগ্য হয়ে জীবের কর্ণদেশে অবস্থান এবং সৌভাগ্য প্রদানের প্রার্থনা করা হয়েছে। দুর্গাসূক্তের সপ্তম এবং শেষ মন্ত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ মন্ত্রে স্বর্গের উপরিভাগে নিবাসশীল সমস্ত দেবতা, ইন্দ্র, অগ্নি, বিষ্ণু এবং বিষ্ণুর বৈষ্ণবী শক্তি দেবীদুর্গা বিভিন্ন নামে অভিব্যক্ত পরমেশ্বরের রূপকেই একসাথে স্তোত্র করে প্রীতি বা ভক্তি বৃদ্ধির প্রার্থনা করা হয়েছে। শ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ে অসুরাধিপতি শুম্ভ নিহত হলে, ইন্দ্রাদি দেবগণ দেবীর স্তুতি করেন। সেই স্তুতির নাম 'নারায়ণীস্তুতি'। সেই নারায়ণীস্তুতিও দেবীকে বিশ্বের আদিকারণ, অনন্তবীর্যা বিষ্ণুর জগৎপালিনী বৈষ্ণবী শক্তি নামে অভিহিত করা হয়েছে।

ত্বং বৈষ্ণবীশক্তিরনস্তবীর্যা
বিশ্বস্য বীজং পরমাসি মায়া ।
সম্মোহিতং দেবি সমস্তমেতৎ
ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তিহেতুঃ ॥
(শ্রীচণ্ডী:১১.৫)

"হে দেবি, আপনি অনন্তবীর্যা বৈষ্ণবী শক্তি ; বিষ্ণুর জগৎপালিনী শক্তি। আপনি বিশ্বের আদিকারণ মহামায়া আপনি সমগ্র জগৎকে মোহগ্রস্ত করেন, আবার আপনিই প্রসন্না হলে ইহলোকে শরণাগত ভক্তের মুক্তির কারণ হয়ে থাকেন।"

শঙ্খচক্রগদাশাঙ্গগৃহীতপরমায়ুধে ।
প্রসীদ বৈষ্ণবীরূপে নারায়ণি নমোঽস্তু তে ৷৷
(শ্রীচণ্ডী:১১.১৬)

"হে দেবি, আপনি বিষ্ণুশক্তিরূপে চারহাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও শার্ঙ্গ (ধনু বা খড়্গ) এই চার মহাস্ত্র ধারণ করেন। হে নারায়ণি, আপনি প্রসন্না হউন। আপনাকে প্রণাম।"

শ্রীচণ্ডীর সপ্তস্থানে (৮.১৮, ৮.৩৪, ৮.৪৭, ৮.৪৮; ৯.৪০; ১১.৫, ১১.১৬) বিশ্বের আদিকারণ, অনন্তবীর্যা বিষ্ণুর জগৎপালিনী বৈষ্ণবী শক্তির কথা পাওয়া যায়।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Videos (show all)

ওঁ তৎ সৎবরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মন্দিরে সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ , বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত শ্রী শ্রী ...
জন্মদিনমিদং অয়ি প্রিয় সখেশন্তনোতু তে সর্বদা মুদম্।প্রার্থয়ামহে ভব শতায়ুষীঈশ্বরঃ সদা ত্বাং চ রক্ষতু।।পুণ্য কর্মণা কীর্তিম...