Taniya Sheikh- তানিয়া শেখ

আমার লেখার ভার্চুয়াল ডায়ারি

28/02/2024

লোকে শুধায় আমি কেন তোমাকে চাই! আমি বলি তোমাতে জীবন আছে, আমাতে নেই তাই। ওরা ভাবে তোমায় পাবার লাগি বুঝি আমার এই বিধ্বংসী লড়াই!
ভুল! ভুল! ভুল!
তোমায় আমি পেতে চাই। কিন্তু আপনার জন্য না। কারণ, তুমি আমার বুকের গহীনের দগদগে ঘা।

-----কিং লেগাসোভ (পুরো নাম দিলাম না। প্লিজ এটুকুও কপি কইরেন না)

তুষার অরণ্যে পূর্ণিমা

উপন্যাসটি শুরুর আগে মাঝে মাঝে এমন কিছু পোস্ট করব। কবে নাগাদ শুরু করব শীঘ্রই জানিয়ে দেবো।

ছবি: সংগৃহীত

08/02/2024

"তুষার অরণ্যে পূর্ণিমা" আবহ দিয়ে গেলাম।

ছবি ও কথা দুটোই সংগৃহীত।

06/02/2024

জ্যোৎস্না রাঙা বউ এর চূড়ান্ত প্লট নির্ধারণ শেষ। পুরোনো পর্বগুলো ডিলেট করতে হবে। নতুন ভাবে শুরু করব কিন্তু, কিন্তু আমার মনটা সর্বনাশ সর্বনাশ শুরু করেছে। এবার আপনারাই বলুন কোনটা আগে দেবো।

জ্যোৎস্না রাঙা বউ

অথবা

তুষার অরণ্যে পূর্ণিমা( নিকোলাসের ঝলক থাকবে বলেছিলাম)

বিঃদ্রঃ আগামী দু এক মাসে মধ্যে বোধহয় শুরু করতে পারব না। কথা দিচ্ছি সব ঠিকঠাক থাকলে একেবারে ফিরব ইন শা আল্লাহ। কোনো ফাঁকিবাজ করব না।

08/01/2024

#জ্যোৎস্না_রাঙা_বউ
পর্ব:০৫
লেখনীতে: তানিয়া শেখ

ভোরের সূর্য উঠল। সোনাভান প্রথমবার স্বামীর ভিটাতে পা রাখার পূর্বেই অপয়া, অলক্ষুণে হয়ে গেল। কপাল ভাঙার অবস্থা। স্বামী উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রত্যাখ্যান করল ওকে। রাতের অন্ধকারে সোনাভানের কালো রঙ পাউডার দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল ওর চতুর বাবা-মা। ধোঁকা দিয়েছে ঝন্টুকে ওরা। শুধু কালো মেয়ে দিয়ে নয় অতগুলো রোগা, আধমরা ছাগল, মুরগি দিয়েও। রাত ভোর হওয়ার আগেই যা মরে শক্ত হয়ে ছিল। গ্রাম ঘোষিত অলক্ষুণে বউ ও ঘরেই তুলবে না। কিন্তু কোমরের টাকাগুলো তেমনই রইল। ওইটুকু ছাড়া যাবে না। সারাদিন গোয়াল ঘরে ঘোমটা মুখে বসে থাকল সোনাভান। ভয় এখনও ওর চেতনায় জাগ্রত। পেত্নীর ওই রূপ ও যেন এই দিনের আলোতেও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পায়। কিন্তু কেউ তো বিশ্বাস করে না। ওই লোকটাও না, যে বারংবার বউ, বউ বলে ওকে সম্বোধন করছে। উলটো রাগ ঝাড়ল। সোনাভান সংসারের জটিলতা বোঝে না। সম্পর্কের জ্ঞানও তেমন নেই। কিন্তু এক রাতে ও বুঝে গেছে ওই লোকটা ওর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়ে গেছে। অথচ, এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরেও সোনাভান তার জীবনে তুচ্ছ -তাচ্ছিল্যের বস্তু যেন। গ্রামের মানুষের সামনে মিথ্যাবাদী বলে অপমান করল ওদের। দেহের রঙটা নিয়ে নানান জনে নানান কটুক্তি করেছে। কিন্তু এই মানুষটার কটুক্তি সোনাভানের খুব লাগল। লোকটা ওর কল্পনার রাজকুমার তো নয়। তবে কেন তার কটুবাক্য, প্রত্যাখ্যান ওর খারাপ লাগল! গত রাতের ভয়ের ধাক্কা থেকেও বুঝি বেশি। নয়ত এই দুর্গন্ধ গোয়ালের এককোনায় বসে বসে ফুপায়!

নূরবানু গোয়ালের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মনটা ভীষণ খারাপ। সেই রাতে কিছু খেয়েছিল। এর পর থেকে পেটে কিছু পড়েনি। খিদের চোটে চোখে সর্ষে ফুল দেখছে। অসহায় মুখে কাচুমাচু হয়ে আছে। এই ভীন গ্রামে না আছে বাপ-মা আর না আছে আপনজন। বুড়িটাও সকাল সকাল বিপদ টের পেয়ে ওদের একলা ফেলে সরে পড়েছে। কার কাছে গিয়ে কষ্টের কথা বলবে? ওর বড় বোনটা সেই কখন থেকে ফুপিয়ে যাচ্ছে। বেজায় জেদ সোনাভানের। নয়ত ওমন দুর্গন্ধময় জায়গায় কেউ ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে পারে! দুলাভাই নামক লোকটাও কী নিষ্ঠুর! একটিবার ভালোমন্দ জিজ্ঞেস তো দূর তাকালো না পর্যন্ত। নূরবানুর ভীষণ অপছন্দের এই লোকটা। গ্রামে থাকলে ইচ্ছে মতো বকে দিতো।

"কাইল্যা ষাঁড় কোন হানকার!" নূরবানু গাল দিলো বিড়বিড় করে। চোখের সামনে প্রখর রোদ। এই তাপে লোকটাকে জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিতে ইচ্ছে করছে। যারা ওর বোনকে কষ্ট দিয়েছে সকলকে ও এমনি করে একদিন ভস্মীভূত করবে।

"ও বুবু, বুবুরে!"

সোনাভান সাড়াশব্দ করে না। আগের ফুঁপানির শব্দও নেই। এমন সময় ঝন্টু বাড়িতে ঢোকে। মাথার চুলগুলো ধুলোবালি মাখা উসকোখুসকো। গায়ে ছেঁড়া ফাটা একটা গেঞ্জি। পরনের লুঙ্গী হাঁটুতে গিঁট দেওয়া। পা খালি। নূরবানুর দিকে চোখ পড়তে ভুরু কুঁচকে ফেললো। একই মায়ের পেটের বোন দুজন কিন্তু কী আলাদা। নূরবানু খুব সুন্দরী। কিন্তু, ঝন্টু ওর রূপ দেখে আকৃষ্ট হয় না। ওর চোখে নূরবানু কেবল শিশু। বিরক্তের ভান ধরে কলপাড়ে গেল। নূরবানু লজ্জা পেয়ে এক ছুটে বোনের কাছে ছুটে যায়। ঝন্টু তখন কলপাড়ে পা ধুচ্ছিল। হঠাৎ গোয়াল ঘর থেকে ভেসে এলো নূরবানুর আর্তনাদ।

"বুবুরে! ওরে আমার বুবুর কী হইছে! ও বুবু কতা ক।"

ঝন্টু আর স্থির থাকল না। দৌড়ে এলো গোয়াল ঘরে। দেখল গোয়ালের কাঁদা গোবরে সোনাভান লুটিয়ে পড়ে আছে৷ ওর পরনে এখনও বিয়ের শাড়ি। নূরবানু মাথার কাছে বসে বিলাপ করছিল তখনো। চোখে-মুখে ভয়। ঝন্টু সোনাভানের মুখ থেকে কাপড় সরাল। এই প্রথম ওর মুখ দেখল না। গতরাতের জ্যোৎস্নাতে দেখেছিল। তখন সাদা পাউডার শ্যামলা মুখটাকে কালো করেছিল। লেপ্টে গিয়েছিল চোখের কাজল। ঝন্টু রূপ দেখে মুগ্ধ হয়নি। হয়েছিল হতাশ। স্বপ্ন ভঙ্গ মেনে নিতে পারেনি। চটে গিয়েছিল। রাগ ঝেড়েছিল নতুন বউয়ের ওপর। এই মুহূর্তে সোনাভানের অচেতন মুখ দেখে নতুন এক অনুভূতি টের পেল। মেয়েটির রূপ ওকে মুগ্ধ করতে না পারলেও মায়ায় ফেলেছে। ও মুখ মায়াবী। ঝন্টুর দিলে দয়া-মায়া আছে। ও ঠকতে চায় না, আবার এই মুখের মায়াও উপেক্ষা করতে পারে না। কপাল ছুঁতেই ঝন্টুর হাত পুড়ে যায় যেন। মেয়েটার ভীষণ জ্বর গায়ে। কী করবে!

"আবার বুবু কতা কয় না ক্যা? ও বুবু, বুবুরে!"

ঝন্টুর বিবেক যাতনা দেয়। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোলে তুলে নেয় সোনাভানকে।

"কোন হানে নেন আমার বুবুরে!" নূরবানু আর্ত কণ্ঠে শুধায়। ঝন্টু হাঁপ ছাড়ে,

"ঘরে।"

নূরবানু ওর পিছু নেয়। ঝন্টুর ঘর আর গোয়াল ঘরে পার্থক্য খুব একটা নেই। এ ঘরের মেঝের মাটি শক্ত আর গন্ধহীন এই যা। ঘুণে খাওয়া একটা চৌকি। তার ওপর ময়লা ছেঁড়া তালির কাঁথা। দুটো তেল চিটচিটে বালিশ। তাতেও এখানে ওখানে তুলো বেরিয়ে আছে। কতদিন যে ওগুলো পরিষ্কার করে না সেই হিসাব বোধহয় ঝন্টুরও নেই। সোনাভানকে সেখানে শুইয়ে দিলো। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আবার হাতে একটা টিনের বাক্স নিয়ে ঢুকলো। ওটা সোনাভানের বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া। বাক্সটা খুলে নূরবানুকে বলল,

"তোমার বুবুর কাপড় বদলাইয়া দাও। আমি পানি নিয়া আহি৷ গায়ে জ্বর। মাথায় পানি দেওন লাগব।"

নূরবানু ডুকরে কাঁদে। একা অসহায়বোধ করে। ভয় পায়। বোনের শাড়ি টেনে খুলতে গিয়ে পারে না। ঝন্টু বালতি হাতে ঘরে এসে ওর কাজ দেখে ধমকে ওঠে,

"এইটুক কাম পারো না। পারোডা কী!"

নূরবানু সলজ্জে মাথা হেঁট করে রইল। টুপ করে একফোঁটা জল পড়ল চোখ গড়িয়ে।

ঝন্টু প্রথমে সংকোচ করল। তারপর লজ্জা ফেলে আস্তে আস্তে নতুন বউয়ের কাঁদা গোবর মাখা শাড়ি খুললো। এইটুকু জীবনে ও নারীসঙ্গ উপভোগ করেনি। ইচ্ছে যে জাগেনি তা নয়। আজ নতুন বউকে এত কাছে দেখে গা কাঁপতে লাগল। মনে হলো জ্বরটা বুঝি ছোঁয়াচে। অথচ, বউটা ওর মনমতো হয়নি। ত্যাগ করবে বলে একপ্রকার পণই করেছিল।

নতুন একটা শাড়ি কোনোরকমে নতুন বউয়ের গায়ে জড়িয়ে দিলো। খোঁপা খুলতে মেঘকালো চুল লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। ঝন্টুর মনে হলো ও যেন মখমল স্পর্শ করেছে। একটা মানুষ একেবারে অপছন্দের হতে পারে না। বিধাতা কোনো মানুষের মধ্যে কিছু কমতি রাখলে আবার কিছু বাড়িয়ে ইনসাফ করে দেয়। সোনাভানের কালো রূপ ঝন্টুর ভালো না লাগলেও ওর দীঘল কালো কেশ মুগ্ধ করেছে। নাকের কাছে নিতে ইচ্ছে করে। পেছনে দাঁড়ানো নূরবানুর উপস্থিতি সেই ইচ্ছাতে বাধা দেয়। খানিক রাগই হলো যেন। মুখ গোমড়া করে ঘরের বাইরে চলে গেল। খানিক বাদে একটা কলার পাতা হাতে আবার ঢুকল। নূরবানু তখন কান্না থামিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে আছে সোনাভানের পায়ের কাছে। মাঝে মাঝে নাক টানছে। ঝন্টু কলার পাতাটার একপাশ সোনাভানের মাথার তলে দিলো। আরেকপাশ নিচের বালতির ভেতর। একটা বদনা হাতে নিয়ে নূরবানুকে বলল,

"মাথায় পানি দিতে পারো তো?"

নূরবানু সলজ্জে মাথা নাড়ায়। তারপর সংকুচিত হয়ে উঠে এসে বোনের মাথার কাছে দাঁড়ায়। বদনা পানি ভর্তি বালতিতে ডুবিয়ে তুলে এনে বোনের কপালে ঢালে। চুল ভিজে সেই পানি কলার পাতায় গড়িয়ে পড়ে বালতিতে। ঝন্টুর মাঠে কাজ আছে। ধানের চারা তুলতে হবে। লোক দিয়ে করলে খরচ। নিজেই করে। একটু বেশি খাটতে ওর তেমন সমস্যা হয় না। দরজার মুখে যেতে কী যেন খেয়াল করে ঘরের ভেতর তাকায়। বদনা ধরা নূরবানুর হাতটা কাঁপছে। ঝন্টু বিরক্ত গলায় বলল,

"তোমারও কি জ্বর আইছে? হাত কাঁপে ক্যা?"

নূরবানু আরও সংকুচিত হয়ে পড়ে। জবাব না পেয়ে ঝন্টুর গলা তপ্ত হয়,

"কতা কও না ক্যা? হাত কাঁপে ক্যা?"

"জানি না।" নূরবানু অস্ফুটে বলে। বদনা কোলের কাছে নিয়ে আছে। ঝন্টু গটগটিয়ে ওর কাছে এলো। রুক্ষ হাতে কপাল ছুঁয়ে বলল,

"জ্বর তো নাই। তাইলে?"

নূরবানুর গলা শুকিয়ে আসে। ঝন্টু কী যেন ভাবে। তারপরেই মুখে অপরাধবোধ জেগে ওঠে। পরক্ষণেই আড়াল করে ঘরের মাঝের মাচানের কাছে যায়। বের করে আনে একবাটি মুড়ি আর এক টুকরো পাটালি। বন্ধ টিনের বাক্সের ওপর রেখে বলে,

"খাইয়্যা নিয়ো। তোমার বইন জাগলে তারেও খাওয়াইয়া দিয়ো।"

উঠোনে নেমে অভিযোগের সুরে বলে,

"আমারে খুব ঠকান ঠকাইছে তোমার বাপে। বাটপারি করছে, মিথ্যা কইছে। রাইতেইর আগেই তোমাগো বাপ হাজির হইব। যাইয়ো গা বইনরে নিয়া।"

ঝন্টুর গলার স্বর আস্তে আস্তে বাড়ির বাইরে চলে যায়। নিস্তব্ধতা নেমে আসে ঘরে। নূরবানুর খিদে পেয়েছে। চোখেমুখে পানির ছিটা দিতে সোনাভান চোখ টিপটিপ করে। নূরবানুর যেন কলিজায় পানি এলো।

"বুবু!"

"নূরি!" সোনাভান চোখ মেলে। জ্বরে লাল হয়ে আছে চোখ। নূরবানু ডুকরে ওঠে। সোনাভান বোনের গালে হাত রাখে।

"কান্দোস ক্যান? কিছু হয় নাই আমার।"

নূরবানু এবার শব্দ করে কেঁদে ওঠে। সোনাভান কোনোরকমে উঠে বসে। বুকে টেনে নেয় বোনকে।

"পাগলি একডা! এই দ্যাখ কিছু হয় নাই আমার। কান্দিস না।"

সোনাভান আশে-পাশে তাকায়। হঠাৎ ওর মুখ আর্ত হয়ে যায়।

"আমি এহানে কেমনে আইলাম রে নূরি?"

"ওই ব্যাডা আনসে।"

সোনাভান এদিক ওদিক তাকিয়ে তাকে দেখে না। বাক্সের ওপর মুড়ির বাটি দেখে ওর পেট গড় গড় করে।

"কে দিলো রে?" সোনাভান জানে। তবুও প্রশ্ন করে। নূরবানু নাক মুছে বলে,

"ওই ব্যাডায়ই।"

সোনাভান শুকনো ঠোঁট জোড়া কুঁচকে ফেলে। নূরবানু উঠে গিয়ে মুড়ির বাটি এনে বলে,

"নে খা।" তারপর বোনের অপেক্ষা না করে গপাগপ মুখে দিয়ে বলে,

"জানিস বুবু ব্যাডায় কী কইছে? কইছে, আমারে খুব ঠকান ঠকাইছে তোমার বাপে। বাটপারি করছে, মিথ্যা কইছে। রাইতেইর আগেই তোমাগো বাপ হাজির হইব। যাইয়ো গা বইনরে নিয়া।"

সোনাভান একমুঠো মুড়ি ধরেছিল। হঠাৎ ওর শরীর দুর্বল হয়ে এলো। খসে পড়ে মুভিগুলো হাত থেকে। চোখ জোড়া উদাস হয়ে গেল। এত কেন খারাপ লাগল বুঝতে পারে না। এ বাড়ি, এ গাঁ ছেড়ে নিজ গাঁয়ে ফিরলেই বরং বেশি খুশি হবে। কারো জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত হয়েছে বুঝেই হয়তো এত খারাপ লাগা।

সোনাভান শুয়ে পড়ল আবার। নূরবানু কপাল কুঁচকে বলল,

"খাবি না বুবু?"

"না রে! বমি আসে। আমি শুইয়া থাকি। আব্বা আইলে জাগাইয়া দিস।"

নূরবানু উজ্জ্বল মুখে মাথা নাড়ায়। তারপর টুকটুক করে মুড়িগুলো খেতে থাকে৷ মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে,

"অল্প কয়ডা খা বুবু।"

সোনাভান মাথা নাড়ায়। চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে বিছানায়। মাথায় যন্ত্রণা বাড়ে। ফের বুঝি গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। জ্বরের ঘোরে একসময় নূরবানুর গলা শোনে। উঠোনে ওর বাবার গলা, সাথে অপরিচিত কিছু গলা। ওর বাবা নিশ্চয়ই নিয়ে যেতে এসেছে। মায়ের সেবা পেলে সোনাভান একদিনেই সুস্থ হয়ে যাবে। তারপর হারুদের পুকুরে মাছ ধরতে যাবে। বাবাকে বলবে মাকে না জানিয়ে একটা বরশি কিনে দিতে৷ নূরবানুকে এবার গোল্লাছুট খেলায় নেবে। বেচারি প্রত্যেকবার দুধভাত হয়ে মুখ ভার করে বসে থাকে। সোনাভান এসব ভাবতে ভাবতে আবার অচেতন হয়ে যায়। এরপর যখন চেতনা ফেরে তখন চারপাশে ঝিঁঝির অবিরাম ডাক। সোনাভান চোখ মেলে কেবল অন্ধকার দেখে। কিন্তু ও টের পায় এই ঘর ওর আশৈশব কাটানোর ঘরটা নয়। সোনাভানের বুক ঢিপঢিপ করে। ঘাম দিয়ে জ্বরটা ছেড়ে গেল। কিন্তু একটা ভয় আচমকা ওর চেতনায় কড়া নাড়ে। মাথার দিকে অদূরে ছনের বেড়ায় বড়সড় ছিদ্র। ধা করে শীতল বাতাস ঢুকলো এ ঘরে। বয়ে নিয়ে এলো সেই শব পোড়া উৎকট গন্ধ। কখন যেন ঝিঁঝির ডাক থেমে গেছে। মাথার দিকে ওই ছিদ্র আরও বড়ো হয়ে গেল। একজোড়া চোখ দেখা যায়। রক্তলাল রাগে আগুন। কী করেছে সোনাভান ওর?সোনাভান কাঁপতে লাগল। জ্বরে নয় ভয়ে এবার। গলা দিয়ে গোঙানি ওঠে। হঠাৎই একটা হাত ওর কোমর পেঁচিয়ে ধরে পাশ থেকে।

"আবার কি জ্বর বাড়ল? কী মুসিবত! ঘুমা বউ। সক্কাল হইলে ডাকতর ডাকমুনে।"

মানুষটার গলা ওর চেনা। ওই যে বউ ডাকল! সোনাভানের কাঁপুনি কমে আসে। শান্ত হয়ে গেল। ছিদ্র দিয়ে কেবল অন্ধকার দেখা যায়। ঝিঁঝি ফের ডাকছে। সোনাভান আরও মিশে যায় মানুষটার প্রশস্ত শক্ত বুকে। ভীষণ উষ্ণতা অনুভব করে। কিন্তু নিরাপদ। চোখ বন্ধ করতেই মানুষটা বিড়বিড় করে,

"ডাকতর ডাকলে ট্যাহা দিতে হইব। কতগুলা ট্যাহা! বউ দরকারি না ট্যাহা! ট্যাহা..না, বউ...না, ট্যাহা..না,বউ.."

সোনাভানের ঠোঁটের কোণে হাসি জাগে। লোকটা ওর রাজকুমার নয় একটা অদ্ভুত মানুষ।

চলবে,,,

31/12/2023

#জ্যোৎস্না_রাঙা_বউ
পর্ব:০৪
লেখনীতে: তানিয়া শেখ

কনে নিয়ে শ্বশুরালয় থেকে বিদায় হতে হতে সন্ধ্যা উতরে রাত। অনেকে বলল রাতটা এখানে কাটানো উত্তম। ঝন্টু মানলো না। ঘর-বাড়ি, গোরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী রেখে অন্যত্র রাত কাটাতে গেলে ক্ষতি হয়ে যাবে ওর। মহা ক্ষতি। নতুন বউ পেয়ে ও যেন যৌতুকের কথা বেমালুম ভুলে বসেছিল। বুড়িকে ইশারা করতে বুড়ি যেন বুঝল। সকিরনকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেল বুড়ি। কী কথা হলো ঝন্টু জানে না। বুড়ি যখন হাসিমুখে ওর সামনে এলো স্বস্তি পেল। ডান হাত খুব যেন চুলকাচ্ছিল। মনে মনে খুশি হলো এই ভেবে যে, অনেক টাকা আসবে। কী ভাগ্যবানই না ও! জ্যোৎস্না রাঙা বউও পেল আবার টাকাও! সুতরাং এখান থেকে তাড়াতাড়ি বিদায় হতে হবে। তাহলেই না অর্থ মিলবে। সাথে বউটাও! ঝন্টুর মন খুশিতে ডুগি-তবলা বাজাতে লাগল।

নতুন জামাইয়ের এমন জেদের কাছে নিরুপায় ছমিরদ্দি ও সকিরন। অতগুলো টাকা দিলো দেনা করে। দেনার দায় বড়ো দায়। কিন্তু কন্যা দায়! ও পার করা চায়-ই-চায়। রীতি অনুযায়ী একলা মেয়ে প্রথমবার শ্বশুরালয় যায় না। নূরবানুকে তাই বোনের সঙ্গে পাঠাল। তাছাড়া ও মেয়ে বোনকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারবে না। সঙ্গে দিলো দুই হাড়ি নানা রকমের পিঠা, মিষ্টি, এক বস্তা মুড়ি, বাড়িতে পালা তিনটে মুরগি, একটা মোরগ এবং একটা ছাগল। বড়সড় দেখে একটা মাছ দিতে চেয়েছিল। রাত বলে সকিরন মানা করেছে। তৈজসপত্র, কাঁথা -বালিশসহ সংসারে ব্যবহারিক সামগ্রিও দেওয়া হলো।

কথিত, নতুন বউয়ের সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে যাওয়া অকল্যাণের। তার ওপর সোনাভান নববধূ। হলুদের গন্ধ কাঁচা ওর গায়ে। সকলে আশ্বস্ত করলেও সকিরনের কেন যেন মনটা কু গাইল। মেয়ে বিদায় দিয়ে সে কী বিলাপের কান্না ওর।

এদিকে অত রাতে ভ্যান রিকশা মিললো না বিধায় ও পাড়ার রহমত গাড়িয়ালকে ঠিক করা হয়। ছাগল, মুরগী সহ যাবতীয় জিনিস একপাশে বাঁধল। বুড়ি বসল সামনে। পাশে নতুন বউ আর সোনাভান। ঠিক তার পেছন দিকে ঝন্টু। নতুন বউয়ের কান্না নাকে কান্নায় রূপ নিয়েছে। গোরুর গাড়ির ছাউনির সাথে হেলান দিয়ে ন্যাকা সুরে কেঁদে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ রাতে ওইটুকুই কেমন অদ্ভুত সুর তুলে মিশে যাচ্ছে পূর্ণিমার আলোয়। ঝন্টুর কারো জন্য মন পোড়ে না। তবে আশ্চর্যরকম ভাবে নতুন বউয়ের কষ্ট ও যেন বোঝে কিংবা বলা যায় অনুভব করতে পারে। উঠে গিয়ে পাশে বসতে ইচ্ছে করে। অভয়ও দিতে চায়। কিন্তু কী অভয় দেবে?

ঝন্টুর মাথার ভেতর সব যেন আউলে যায়। হুট করে দক্ষিণ দিক থেকে ধেয়ে আসা শীতল বাতাস ও বুক জুড়িয়ে দেয়। পেটের কাছে লুঙ্গিতে গিঁট দেওয়া হাজার টাকার ভার নতুন বউয়ের ন্যাকা সুরের কান্না ভুলিয়ে দেয়। দূর আকাশে রূপোর থালার মতো চাঁদটার দিকে তাকায়। পূর্ণিমাতে ওর রূপ, রঙ ঢলে পড়েছে যেন। এই রাত্রিতে ও বুঝি সঙ্গী হয়েছে ওদের। ঝন্টুর ভয়-ডর নেই। অমাবস্যায় নদীতে মাছ ধরেছে, রাত-বিরাতে বাইরে থেকেছে। ছাউনি থেকে সরে এসে খোলা দিকে বসল। দেখল পূর্ণিমায় এই রাতের সাজ। যেন বিয়ের সাজ। ঝন্টুর বিয়ের সাজ। আরেকবার নতুন বউয়ের দিকে ফিরে চাইল। একহাত ঘোমটায় আড়াল করা মাথাটা নেতিয়ে পড়েছে ছাউনির সাথে। গাড়ির তালে তালে দেহখানি দুলছে। ঝন্টু আবার পূর্ণিমা রাঙা চাঁদে তাকায়। মুচকি মুচকি হেসে বিড়বিড় করে বলে,

"রইস্যা না আমিই জিতছি।"

কতক্ষণ জ্ঞান হারিয়েছিল জানে না সোনাভান। ছাগল-মুরগির কুঁইকুঁই শব্দে চেতনা এলো। যখন চোখ মিললো সারা শরীর অসাড়। মুখ ভার। কপাল কুঁচকে সামনে আঁধার দেখল, গাড়িয়াল দেখল। শুনল গোরুর পায়ের শব্দ। কোলে মাথা রাখা লাল টুকটুকে নূরবানুর ঘুমন্ত মুখ দেখতে কপালের কুঞ্চন একটা একটা করে ছাড়ে। ভাঁজ পড়ে ঠোঁটে। পাশে ঘুমের মধ্যে ঘোঙানো বুড়িটাকে দেখতে ঠোঁট কাঁপে। কান্না গলায় দলা পাকে। কাঁদতে পারে না। সেই জোর পায় না। দু হাতে পরনের লাল শাড়ি খামচে রইল। মা-বাবা ছাড়া ও থাকবে কী করে। ভাঁটেরচর শুনেছে অনেক দূর। রাত ভোর হয়ে যাবে। অতদূর থেকে কি আর কোনোদিন ওর ফেরা হবে? গত বছর ও পাড়ার মর্জিনার বিয়ে হলো দূর এক গাঁয়ে। তারপর আর ফেরেনি মর্জিনা। ওর মা বলে, "মাইয়্যাগো আসল বাড়িই হইলো সোয়ামির বাড়ি। আর একডা আছে। সেইডা মরলে হয়। মাটির তলে।"

সোনাভানের বুক ফেটে কান্না আসে। পৃথিবীটা এই মুহূর্তে ওর কাছে নিষ্ঠুর হয়ে ধরা দেয়। নূরবানু ছাড়া সবই যেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আওতায় পড়ে। নূরবানুর মুখটা দেখে চোখ মোছে। হঠাৎ একটা তীব্র গন্ধ ওকে সচকিত করে। গন্ধটা ও চিনতে সময় নিলো না। হিন্দু পাড়ার শশ্মানে যতবার লাশ পুড়াতে দেখেছে ততবারই গন্ধটা নাকে এসে লাগত। গা হিম করা শব পোড়া গন্ধ। সোনাভানের মনে পড়ে গেল হিন্দু পাড়ার কানাইয়ের কথা, "শব পোড়া গন্ধ পাইলে পেছন ফিরবি না সোনা। ও হইলো মানুষ খেকো পেত্নীর গাঁয়ের গন্ধ। ওগো চোখে তাকাইলেই তোর মরণ।"

সোনাভান ভয়ে কাঠ হয়ে রইল। পেছনে ফিরবে না। চোখ-মুখ খিঁচে দোয়া-দরুদ মনে করতে গিয়েও পারল না। কেন যে মকতবে ফাঁকি দিয়েছিল! আচমকা ওর বরের কথা মনে পড়ল। মানুষটা কোথায়! মানুষ খেকো পেত্নী খেয়ে ফেললো না তো। সোনাভান সব পণ, ভয় ভুলে পেছন ফিরতে জমে গেল। ছাউনির শেষ মাথায় হেলান দিয়ে রয়েছে ওর নতুন বর। ঠিক তার পাশে বসে আছে এক তরুণী। একমাথা সর্পিলাকার কালো মেঘের মতো উড়ন্ত চুল। লাল পাড় হলুদ ছাপার শাড়ির আঁচল কোমরে বাঁধা। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে পাশের মানুষটার পানে। তারপর আচমকা ওর মাথাটা ঘুরে গেল সোনাভানের দিকে। জ্বলন্ত একজোড়া অশুভ চোখ। দীর্ঘ নাসিকা। তার একপাশে ঝুলে আছে বড়ো নথ। ঠোঁট দু'টো টকটকে লাল। সূচালো দাঁতের পাটি খিঁচে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

"কী লো মা*গি, ভা*তার নিবি?
একলাই?
আমারও যে চাই তোর ভা*তারটাই।
এহন কী করি, কী করি!
চি*বাইয়া খাই, ধরি-মা*রি,
হি-হি-হি-হি।

পেত্নী হাত বাড়ায়। লম্বা ধারালো নখওয়ালা হাড্ডিসার রেশমী চুড়িভর্তি হাতটা এগিয়ে যায় সোনাভানের দিকে। আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠে সোনাভান। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে সেখানেই।

চলবে,,,
নতুন বছরের শুভেচ্ছা সকলকে। সকলের জীবন কল্যাণকর ও স্বস্তিময় হোক। দোয়া করবেন যেন ভালো ভালো লেখা উপহার দিতে পারি, বেশি বেশি লিখতে পারি।💜

16/12/2023

#জ্যোৎস্না_রাঙা_বউ
পর্ব:০৩
লেখনীতে: তানিয়া শেখ

ঝন্টুর একখানই পাঞ্জাবি। কোনো এক ঈদের আগে চেয়ারম্যানের ছোটো ভাই ওটি দিয়েছিল। সে বিদেশ থাকে। কয়েক বছর পর পর দেশে আসে। ঝন্টু সে বার ওর ছেলেটাকে পুকুরে ডুবে মরা থেকে বাঁচিয়েছিল। একরাত মাংস, পোলাও পেট ভরে খাইয়ে পাঞ্জাবিটা দিয়েছিল।

সেই উপহারের জিনিসের বয়স যে কত হলো ঝন্টু ঠিক মনে করতে পারে না। চার ঈদ আগে চেয়ারম্যানের ছেলের বিয়ের কাঙ্গালি ভোজে গিয়েছিল পাঞ্জাবিটা পরে। আজ আবার পরল৷ খাটো হয়ে খানিক হাঁটুর ওপরে উঠে গেছে। ঝন্টুর ভুঁড়ি নেই। সারাদিন পরিশ্রম করা পেটানো শরীর। তবুও একটু যেন টাইট টাইট লাগল গায়ে পাঞ্জাবিটা। বোতলের তলায় একটুখানি সরিষার তেল লেগে ছিল। তাই ঝাঁকিয়ে মাথায় ও হাতে-পায়ে মাখল। পুরানো একখান আয়না ছিল। একপাশ ভাঙা, ফাটা। তাতেই নিজেকে দেখল ঝন্টু। গায়ের রঙ মহিষের মতো হয়েছে। সরিষার তেল মাখাতে চকচক করছে। চিরুনি ছিল না। হাত দিয়েই কটা, জটা চুলগুলো পরিপাটি করল। মাঝ সিঁথি কেটে দু পাশে নেতিয়ে দিলো চুলগুলো। ঘরের মাঝে রাখা মাচানের একটি ধানের কলসে লুকিয়ে রাখা টাকার বান্ডিল থেকে বহুকষ্টে পঞ্চাশ টাকা বের করে আনে। টাকাগুলো খরচ হয়ে যাবে ভাবলে বুকের ভেতর ব্যথা শুরু হয়ে যায়। মাথা ঘোরে। বুড়িকে মনে মনে গাল দেয়। পরে পাঞ্জাবির পকেটে এই সান্ত্বনায় রাখে যে, "পঞ্চাশ গেলে একশ পাব। মেয়ের বাপে মেলা যৌতুক দিবো।"

ঝন্টুর পোষা দুটি কুকুর ছিল। বেজায় হিংস্র। ও দুটিকে বাড়ি পাহাড়ায় বসিয়ে, ঘরের দরজায় শিকল টেনে বুড়িকে সাথে নিয়ে ঝন্টু চললো বাবলাপুরের উদ্দেশ্যে। ভাই-বোন কারো সাথে ওর বনে না। তাছাড়া ওদের বলা মানে আরও টাকার অপচয়। ঝন্টু কাওকে কিছু না জানিয়েই গেল। কিন্তু ও না জানালে কী হবে। ঠক ঠকানি বুড়ির পেটে কোনো কথা গোপন থাকে না। সকাল হতেই চাউর হয়ে গেল ঝন্টুর মেয়ে দেখতে যাওয়ার খবর। পথে যেতে ভ্যান থামিয়ে চালক, মুদি দোকানি, গাঁয়ের যে দেখে সে, শেষে নৌকার মাঝি প্রশ্ন করে,

"এত সাজগোছ কইরা কই যাস রে ঝন্টা? বিয়া করতে?"

ঝন্টু ওদের সাথে মুখোমুখি ঝগড়া করে না। মনে মনে গালাগাল করে। তারপর বুড়ির দিকে রাগত দৃষ্টিতে তাকাতে বুড়ি ফোকলা দাঁতে হেসে বলে,

"আমি কিন্তু কাওরে কিচ্ছু কই নাই। এসব কতা বাতাসে ওরে বুঝলি!"

ঝন্টু সব বোঝে। কিন্তু যখন তখন সেটা প্রকাশ করে না। মেয়েটা পছন্দ হলে, যৌতুক সমেত বিয়ের করার পর বুড়িকে শায়েস্তা করবে।

নদী পার হয়ে ওরা ওপারের গাঁয়ের বাজারে ঢুকল। বুড়ি বলে বলে ওকে দিয়ে ভালো দু কেজি মিষ্টি কিনালো। তাতেই দশ টাকা শেষ। মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে মুখ কালো করে চলতে লাগল ঝন্টু। দশ টাকার মিষ্টি! দশ টাকা খরচ হয়ে গেল! হা হুতাশ করতে করতে এগোতে লাগল। অনেকদূর যেতে একটি গরুর গাড়ি পেল ওরা। বুড়ি আগে উঠে পড়ল। ঝন্টু উঠল পড়ে। পা ঝুলিয়ে ও পেছনের দিকে বসে। তখন অদূরে কোথাও যোহরের আজান হচ্ছে। গাড়োয়ানের হাঁক ওঠে একটু পর পর। আঁকাবাকা পথ বেয়ে, বন পেরিয়ে গাড়িটি ঢোকে বাবলাপুর। মেয়ে পক্ষকে আগেই জানানো হয়েছিল। পাড়া-পড়শীর অনেকে উঁকি দিচ্ছে ঝন্টুকে দেখবে বলে। ছমিরদ্দি ও সকিরন অবাক হয়েছে দুজনকে দেখে। ওরা ভেবেছিল কমপক্ষে পাঁচজন তো আসবে মেয়ে দেখতে। ছমিরদ্দি গাঁয়ের সম্মানিত কজন লোক ও আপন-ভাইদের ডেকেছিল। তাদের সাথে বসল ঝন্টু। দূর থেকে ওকে দেখে সকিরনের মুখ কালো হয়ে গেল। বুড়ি অভিভাবক হিসেবে ঝন্টুর পাশেই বসে। বাড়িয়ে-চাড়িয়ে ওর প্রশংসা করতে লাগল,

"ছেলের অভাব বলতে এড্ডা লক্ষী বউ ছাড়া আর কিছুই নাই। ওইডাই আমরা আপনাগো গাঁও থেইক্যা নিতে আইছি। ছেলে তো দেখছেনই। ছোডু বেলায় দুধের লাহান সোন্দর আছিল। মাঠে খাটতে খাটতে গতর এমুন তামার রঙ পাইছে। বেডা ছেলেগো রঙ কালা হইলেও সোনা। অত অত সম্পদ একলাই সামলায়। কত গাঁও থেইক্যা বিয়ার প্রস্তাব দেয় মাইয়্যার বাপেরা। ওই রাজি হয় না। ডর পায় কোন মাইয়্যা কেমন হয়। আমার কতায় এইহানে আইতে রাজি হইছে। ছমিরদ্দি মাইয়্যার কতা আমি শুনছি। শুইনা এত ভালো লাগছে যে ওরে নিয়াই আইয়া পড়ছি একেবারে মাইয়্যা দেকতে। এই যে এতক্ষণ ধইরা বকরবকর করলাম। পোলাডা কিন্তু একটা কতাও কইলো না। শরম পায় বুঝলেন বাবারা। ফুলের ভেতর পোকা পাইবেন কিন্তু এই পোলার স্বভাব চরিত্রে দোষ পাইবেন না। গাঁয়ের রঙডা তামা হইলে কী হইব! পোলা কিন্তু এক্কারে খাটি সোনা।"

ঝন্টু লজ্জা যেমন পাচ্ছিল তেমনি বুড়ির বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বলা কথায় মনে মনে খুশিই হয়। ভেতরে ভেতরে গর্ববোধ করে নিজের ওপর। কিন্তু এত লোকের সামনে নেহাৎ সাধুপুরুষ সেজে বসে রইল। বাবলাপুরের গুরুজনেরা ছেলের ভদ্রতা, নম্রতা দেখে একবাক্যে বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। ছমিরদ্দির আর আপত্তি থাকে কোথায় সেখানে। কথায় কথায় বুড়ি তাদের জানায়, ভাই-বোন বলতে ঝন্টুর যা আছে তা কেবল নামে মাত্র। হিংসা করে ওর উন্নতিতে। তাই কেউ আসেনি। ছমিরদ্দির এ নিয়ে মনে খটকা লাগে। এমন সময় সকিরনের ডাক পড়ে ভেতর থেকে। ছেলেকে দেখে প্রথমে অপছন্দ করলেও বুড়ির কথার প্রভাবে এখন এই ছেলেকেই মেয়ে জামাই করার পণ করে। সে।

"এমন ছেলে ভাগ্য গুনে পাইছি। যেমনেই হোক আইজ বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করেন। এই ছেলের সঙ্গে সোনাভানের বিয়া হইলে মাইয়্যা আমাগো রাজরানি হইয়া থাকব।"

"কিন্তু খোঁজ খবর তেমন নেওয়া হইল না। এত তাড়াহুড়া কইরা অগো মুখের কতায় বিয়ে দেওন কি ঠিক হইব? তাছাড়া সবুরে ছাড়া বিয়া দিলে মনে কষ্ট পাইব না?" ছমিরদ্দি মনের দ্বিধাবোধ প্রকাশ করে। সকিরন ছ্যাঁত করে ওঠে,

"অ্যা! অত খুঁত খুঁত করলে পরে মাইয়্যা খুঁটি বানাইয়া রাকতে হইব। আপনের বুদ্ধিতে চললে এ জনমে মাইয়্যা বিয়া হইব না। অমন কালা, অকর্মা মাইয়্যা কার ঘাড়ে পার করবেন? রিশকাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা না কামলার ঘাড়ে? এই হানে বিয়া হইলে রানির হালে থাকব সোনাভান। সবুররে চিঠিতে যা লেখনের লেখুমনে। ও নিয়া আপনারে ভাবতে হইব না। কতা বাড়াইয়েন না। যা কইছি করেন।"

ছমিরদ্দির কিছু করা লাগেনি। গাঁয়ের গুরুজনেরা সকিরনের বুদ্ধি রাখে। ঠকঠকানি বুড়িকে তারা বিয়েতে রাজি করে ফেলেছে। কিন্তু ঝন্টু যেন একটু গড়িমসি করছিল। সবাই মিলে এমনভাবে ধরল যে ও বেচারাও রাজি হয়ে গেল।

বুড়ি কায়দা করে ঝন্টুর কাছ থেকে অবশিষ্ট টাকা নিয়ে বিয়ের শাড়ি ও সাজসজ্জার সামগ্রী কিনতে দেয়। এতগুলো টাকা হাত থেকে চলে যাওয়ায় ঝন্টুর মাথা ভনভন করতে লাগল। বুড়ির ওপর প্রচন্ড রাগ হয়। ভিন্ন গ্রাম, এক বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে ফেটে পড়তে পারল না। বুড়ির সান্ত্বনাও তখন ওর মনের জ্বালা কমাতে ব্যর্থ। একটা সন্দেহ জাগল তার বদলে। বুড়ি ফাঁকি দিচ্ছে না তো ওকে! বিয়ের আগে বউ দেখল না বুড়ির ওপর বিশ্বাস করে। পস্তাচ্ছে ঝন্টু। একবার ভাবল পালিয়ে যাবে। পরক্ষণেই পঞ্চাশ টাকার শোক ওকে স্থির রাখল। বিয়ে করে টাকা উসুল করে তবেই যাবে।

বিকেলের রৌদ্র কোমল হতেই কাজী এসে হাজির। যথাসময়ে বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। কাবিন নিয়ে একটা গোলমাল হওয়ার আশঙ্কা করেছিল বুড়ি। সে জানে ঝন্টুকে আর বেশি চাপ দেওয়া ভালো হবে না। তাইতো আগেই কনে পক্ষকে বুঝিয়ে দেয়," ঝন্টুর যা তা তো সোনাভানেরই হইব। কাবিন বেশি-কমে কী আসে যায়।" মেয়ে দায়গ্রস্ত ছমিরদ্দি এ নিয়ে আর কিছু বলে না। জামাইয়ের খরচার হাত দেখে ইতোমধ্যে সন্তুষ্ট সকলে। সুতরাং কথা আর উঠল না।

সন্ধ্যার পরপরই একশ এক টাকা দেনমোহরে বিয়ের কার্য সম্পন্ন হয়। ছমিরদ্দি জামাইয়ের জন্য নতুন পাঞ্জাবি, পায়জামা, টুপি ও একজোড়া সেন্ডেল উপহার দিয়েছে। ঝন্টুর মুখে চাপা রুমালটা সকিরন দিয়েছে। বর-কনেকে বসানো হয় এক খাটে। লজ্জায় কেউ কারো দিকে তাকায় না। ওদের ঘাড়ের ওপর গ্রামের মেয়ে-বউরা। নূরবানু সোনাভানের পাশে গুটিশুটি হয়ে আছে। একটু পর পর ফিরে ফিরে নতুন দুলাভাইকে দেখছে। ওর মুখে আঁধার নেমে আসে। সামনে বিছানার ওপর আয়না রাখা। পাশে জ্বলছে টিমটিমে কেরোসিনের ল্যাম্প। সলজ্জে ঝন্টু চোখ তুলে তাকায়। ওর যেন চোখ ঝলসে যায় আয়নায় সোনাভানের মুখ দেখে। এত সুন্দর বউ! বুড়ি তবে ওকে ফাঁকি দেয়নি! ঝন্টু এক বিঘে জমি কেনার মতো আনন্দ পেল। ওর ওই আনন্দ ঢলে পড়া চকচকে চোখে-মুখে চেয়ে নূরবানুর মুখ আর্ত হয়ে ওঠে। মনে মনে বলে,"এ তো রাজপুত্তুর না। রাক্ষসপুরীর দানব!" এমন নিষ্ঠুরভাবে স্বপ্ন ভঙ্গে কান্না পেয়ে যায় ওর। বোনের আরও কাছে সরে গিয়ে সিক্ত কণ্ঠে সতর্ক করতে চায়,

"ও বুবু, বুবুরে!"

সোনাভান মুখ তোলে না। লজ্জায় ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। সারাদিন একবার মুড়ি, গুড় খেয়ে খিদেতে মাথা ভন ভন করছে। মাংসের ঘ্রাণে ম-ম করছে বাড়ি। আরও কত পদ না করেছে আজ ওর মা! বলেছিল কবুল বলার পর খেতে পারবে। কবুল বলেছে কখন! ওর মা খাবার দেয় না কেন! নূরবানুকে কি জিজ্ঞেস করবে? হঠাৎ গা শিরশির করে উঠল। পাশে বসা অচেনা মানুষটা ওর আরও কাছে সরে এসেছে। গায়ে গা লাগছে ওদের। আস্তে আস্তে একটা হাত সাপের মতো ওর শাড়ির আঁচল ভেদ করে উরুর কাছে উঠে এলো। সোনাভান খিদে ভুলে গেল। ও শুনল নূরবানু পাশে কাঁপছে। আরও শুনল কয়েকটি পরিচিত গলা।

"ও নয়া জামাই, কী দেখা যায় আয়নায়?" মেয়ে- বউরা ঝন্টুকে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে। ঝন্টু লাজ লাজ মুখে বলে,

"আমার রাঙা বউ দেখা যায়।"

মেয়ে-বউরা হেসে ওঠে। আবার শুধায়,

"কেমন রাঙা বউ গো জামাই?"

ঝন্টু হেসে বলে,

"জ্যোৎস্না রাঙা বউ গো আমার।"

চলবে,,,

09/12/2023

#জ্যোৎস্না_রাঙা_বউ
পর্ব:০২
লেখনীতে: তানিয়া শেখ

ছমিরদ্দি মাঠ থেকে বাড়িতে ফেরার পথে কথাটা শুনল। দ্রুত পা চালিয়ে উঠোনে এসে হাঁক ছাড়ল।

"ও সবুরের মা, কই গেলি রে তুই?"

সবুরের মা সকিরন ঘর লেপছিল। হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। হাত ভর্তি কাদা।

"হইছে কী? ডাক ছাড়তাছেন কেন?"

"মইজ্জা মাঝির সাথে পথে দেখা। ভাটেরচর থেইক্যা পোলা আইতাছে মাইয়্যা দেখনের লাইগা।"

"হায়! হায়! কন কী!" হাতটা দ্রুত এককোণে রাখা বালতির পানিতে ধুয়ে উঠে বলল,

"কোন বেলায় আইব হেরা?"

"কইল তো সন্ধ্যা তামাত পৌঁছাইয়া যাব। এহন চাট্টিখানি খাইতে দাও। খাইয়া বাজারে যাই।" ছাউনি দেওয়া পাকের ঘরের কোনের ঘটি থেকে কোনোমতে হাতটা ধুয়ে বসল ছমিরদ্দি। সবুরের মা প্লেট ধুয়ে খেতে দেয়।

"এক কেজি গোরুর গোশত আইনেন। বাড়িতে একটা দেশি মোরগা আছে। মসলাপাতিও আইনেন।..." বাজারের ফর্দ বলতে বলতে হঠাৎ কী যেন মনে পড়ল সবুরের মায়ের। এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল,

"একটা সুগন্ধিওয়ালা পাউটার(পাউডার) আইনেন লুকাইয়া।"

ছমিরদ্দি খাওয়া থামিয়ে বউয়ের দিকে তাকাল। সবুরের মায়ের চোখটা ঠিক তার মেজো মেয়ের মতো। যখন বউ হয়ে আসল কী যে সুন্দর ছিল সকিরন। লোকে বলত চাষার বউ এত সুন্দর হওয়া চিন্তার কথা। ছমিরদ্দি বড় ছেলে হওয়ার আগ পর্যন্ত বউকে লুকিয়ে রাখত এক প্রকার। তিন সন্তানের মা হয়েও সকিরন এখনও সুন্দর। গায়ে মেদ জমেছে, চুল কটা হয়েছে, এখন আর স্নো, পাউডার মাখে না, কাজল দেয় না চোখে। তবুও তার চোখে সকিরন এখনও সুন্দর। সবাই বলত ছমিরদ্দির ছেলে মেয়ে বউয়ের রূপ পেলে তো চাঁদের মতো সুন্দর হবে। মেয়েগুলো রূপের জোরেই বিদায় হবে। খরচের ভয় থাকবে না। খরচের ভয় করেও না ছমিরদ্দি। তার যা আছে খেয়ে-পরে বেশ চলে। সবুরটা ঢাকায় এক বড়ো সাহেবের বাসায় কাজ করছে। মাস গেলে কিছু পাঠায়। সবুরের মা ওই টাকা কাওকে স্পর্শ করতে দেয় না। তার সাত রাজার ধনের টাকা সে জমা করে করে জমি রাখবে। ছেলেই হবে সেই জমির মালিক। মেয়েদের যে সকিরন ভালোবাসে না তা নয়। কিন্তু ওই যে, পরের ঘরে যাবেই যখন তখন আর মায়ায় জড়িয়ে দুঃখ বাড়াবে কেন। ছমিরদ্দি বউয়ের মতো শক্ত মনের না। দুই মেয়েকে চোখে হারায়। বিশেষ করে মেজোটাকে। ওকে দেখলে কেন যেন তার মায়ের কথা মনে পড়ে। ওমনই চঞ্চলা আর উদারমনা ছিল তার মা। হাসির আদল একেবারে মিলে যায়। সকিরন শুনলে টিপ্পনী কাটত। বলত,

"শুধু হাসি? রঙডাও তো পাইছে। ওইতেই আমার মেয়ের কপাল পুড়ছে।"

ছমিরদ্দি এখন আর বউয়ের সাথে তর্ক করে না। কিন্তু মনে বেজায় কষ্ট পায়। তার মেজো মেয়ে এর চেয়ে বেশি কষ্ট হাসি মুখে হজম করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কোনোদিন মুখ ফুটে প্রতিবাদ করবে না। সহ্য করার অসীম শক্তি দিয়ে পাঠিয়েছে বিধাতা ওকে।

খাবার শেষ করে বাড়ির এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলল,

"আমার মা কই? ও মা!"

"আর মা! ওই ছেমরি এক দন্ড ঘরে থাকে? দেহেন গিয়া কোন পুকুরে মাছ ধরতাছে, মাঠে ছাগল নিয়ে দৌড়াইতাছে, ভাগ্য ভালো হইলে কারো বাড়ির পিছে পাইবেন ঝোলাপাতি খেলতে। আমারে জালাইয়া অঙ্গার কইরা দিলো। মাইয়্যার বিয়ার কতা হইতাছে আর সে দিন-রাত মাঠ-ঘাট কইরা ফেরে। ভালো সম্বন্ধ কেমনে হইব? আপনার মাইয়্যা তো উড়নচণ্ডী। আজ আসুক ছেমড়ি। মাইরা ওর পিঠ ক্যাচাক্যাচা কইরা না ফালাইছি।"

ছমিরদ্দি বউয়ের এই আরচণ ভয় পায়। তখনই তুই থেকে তুমি সম্বোধন করে বলে,

"আজ কিছু কইয়ো না। আমি গিয়া দেহি।"

"আপনে এহন মাইয়্যা খুঁজতে বাইর হইলে বাজার কইরা আনবেন কোন বেলা? জলদি বাজারে যান। মাইয়্যারে আমি দেখতাছি।"

"তুমি মারবা ওরে।"

"এত আহ্লাদের কাম নাই। আজ গেলে কাল স্বামীর ঘরে উঠব। আদব-লেহাজ না শিখাইলে দোষ আমাগো হইব তো হইব মাইয়্যার দুর্গতির শেষ থাকব না। সময় নষ্ট না কইরা বাজারে যান। যা কইছি ঠিক মতো আইনেন। আর শোনেন, পাউটার কিন্তু আনবেনই আনবেন।"

ছমিরদ্দি গায়ে পাঞ্জাবি চাপিয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেল। সকিরন বাকি ঘরটুকু লেপে হাত ধুতে ছোটো মেয়ে নূরবানু বাড়িতে এলো। হাতে কলার পাতায় মোড়ানো টাকি মাছ।

"ওমা, দেহো বুবু কী ধরছে। শোল টাকি। অবুগো পুকুর ছেইচা ধরছে বুবু। আজ রাইতে টাকি মাছ ভাইজ্যা খামু। ওই মা!"

"খাওয়াচ্ছি টাকি মাছ ভাইজ্যা। বোনের সঙ্গতে পইড়া পাড়া বেড়ানি হইতাছোস!"

মেয়ের হাত থেকে টাকি মাছ গুলো ছুঁড়ে ফেলে চুলের মুঠি ধরে টেনে বলে,

"ওই পোড়ামুখীডা কই? আইজ ওর পুকুর ছেঁচোনের সাধ মিটাব। কই ও?"

নূরবানু ব্যথায় ককিয়ে ওঠে মায়ের কিল পড়তে পিঠে। ফুঁপিয়ে বলে,

"জরিনা গো বাড়ি।"

সকিরন আঁচল কোমরে বেঁধে বাড়ির পাশ থেকে কঞ্চি নিয়ে বেরিয়ে গেল। ফর্সা মুখটা রাগে লাল হয়ে যায়। তিন চার বাড়ি পরে জরিনাদের বাড়ি। সকিরন গিয়ে দেখল তার মেয়েটি ভেজা-কাদা শরীরে বারান্দায় বসে যাতা পিষছে।

"পোড়ামুখী! দিনভর টই টই করে পরের বাড়ি বান্দি খাটান মারাও! খাঁড়া তুই আইজ!"

মেয়েকে কিছু বলার অবসর না দিয়ে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিচে নামিয়ে কয়েক গা কঞ্চির বাড়ি দিলো সকিরন। কেউ সাহস করল না এগোনোর। মেয়ের কান্না উপেক্ষা করে টানতে টানতে নিয়ে এলো বাড়ির পাশের পুকুরে। ডুবিয়ে, সাবান ডলে গোসল করিয়ে ঘরে তুললো।

"এক পা ঘরের বাইরে দিবি তো গলা টিপে মাইরা ফেলামু তোরে।"

নূরবানু দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল ভয়ে। মা পাকের ঘরে যেতে ক্রন্দনরত বোনের কাছ ঘেঁষে বসল। দু-বোনের বয়সের পার্থক্য চার বছরের। সামনের ভাদ্রে নূর বানুর নয় পড়বে। ঠিকমতো জামা পরে না। এখনও উদাম গা। পরনে একটা সুতি কাপড়ের পায়জামা। কোঁকড়া চুলগুলো সাপের মতো ঝুলে আছে পিঠেসহ মুখের দু-পাশ।

"তোর কি খুব নেগেছে রে বুবু?"

ওর বুবু হাঁটুতে মুখ রেখে ফুপিয়ে ওঠে। তারপর মাথা দু'দিকে নাড়ায়।

"আব্বা গঞ্জে গেছে। মজা আনলে পরে আমার ভাগেরতেও তুই নিস।" নূরবানু বুবুকে খুশি করার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়।

"না, আমি কিছু খামু না। তুই যা।"

নূরবানু যায় না। আরও গা ঘেঁষে।

"যা নূরবানু৷ নইলে কিল খাবি দেহিস!"

নূরবানু বোনের কঠোর শব্দে ফুঁপিয়ে ওঠে। বুবুর ভালোবাসায় অভ্যস্ত ও। একটু রাগ করলে কষ্ট হয়। মায়ের প্রহারের থেকেও বেশি ব্যথা পায় তখন যেন৷

"কানতাছিস ক্যান? তোরে কি মারছি?" নরম গলায় বলল ওর বুবু। নূরবানু নাক টানে। ওর বুবুর মনটা ভারি নরম। কারো দুঃখ, ব্যথা সহ্য করতে পারে না। দু হাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল,

"কানদিস না। আর বকতাম না৷"

দুই বোনে একে অপরের চোখের পানি মুছে সিক্ত মুখে হাসল।

"টাহি মাছডি কি মা'ই ফালাই দিসে?"

"হ!"

"মন খারাপ করিস না,নূরি। দুইদিন পর মোল্লাগো পুকুর ছেঁচবো। আরও বেশি টাহি মাছ ধইরা দিমু তোরে।"

"তুমি কত ভালা বুবু।" নূরবানু বোনকে জড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল। ওর বুবুকে মা পোড়ামুখী বলে। গায়ের রঙ একটু ময়লা বলে সবাই তাই ডাকে। নূর বানুর মোটে ভালো লাগে না। নূরবানুর সাধ্য থাকলে ওর নিজের গাঁয়ের সুন্দর রঙ বোনকে দিয়ে দিতো।

দুই বোন বিছানা জড়াজড়ি করে শুয়ে রইল। নূরবানু বলল,

"বুবু!"

"হু?"

"একটা কিসসা শুনাবি?"

ওর বুবু একটু ভেবে বলে,

"কোনডা? রাজপুত্তুর আর মেঘকইন্যার?"

নূরবানু মাথা নাড়ায়। ওর বুবু গল্প বলে,

"এক দ্যাশে ছিল এক মেঘ কইন্যা। কালো মেঘের মতোন রঙ ছিল তার। তাই দেইখ্যা আকাশ, পাতালের সে কী দুঃখ! বাতাস রোজ আইসা ভেঙ্গায়," মেঘ কইন্যা কালা
দেখতে না লাগে ভালা।
আসবে না পালকি
রাজপুত্তুর দূর কী!
মেঘ কইন্যার কষ্ট হয়। ও স্বপন দেখে পালকি আসার। সাদা ঘোড়ায় চইড়া রাজপুত্তুর আসার।"

"রাজপুত্তুর আসে রে বুবু?" নূরবানু প্রশ্ন করে। ওর বুবু হাঁপ ছাড়ে।

"না!"

"একদিন আসব দেখিস! আচ্ছা বুবু, রাজপুত্তুর কি মেলা সুন্দর দেখতে?"

"মেলা সুন্দর।"

"তোর লাইগ্যাও আইব রাজপুত্তুর বুবু?"

নূরবানু খেয়াল করে ওর বুবু লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলে বালিশে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

"জানি না রে! আমিও তো মেঘ কইন্যার মতোন কালা।"

"তাই কী! আব্বায় কয় রঙডা কিছু না। তুই দাদির রঙ পাইলেও রূপ মায়ের মতোন পাইছোস। আমাগো মা কত সুন্দর।"

ওর বুবু হাসে। নূরবানু বুবুর বুকে মিশে যায়।

"তুই চিন্তা করিস না রে বুবু। দেখবি একদিন তোর রাজপুত্তুর ঠিক আইব।"

"তুই কইতাছোস?"

"হ।"

ওর বুবু খুশি হয়। নূরবানুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
"তুই কইতাছোস যহন তাইলে আইব। আমার রাজপুত্তুর আইলে তোরেও সাথে কইরা নিয়া যামু। খালি আনন্দ করমু। ঘুরমু, খেলমু আর পুকুর থেইক্যা মেলা মাছ ধরমু তারপর ভাইজ্যা দুজনে খামু। কেউ বকব না, মারব না। যাবি তো?

"একশ বার যামু।"

একটু পর সকিরন ঘরে ঢুকে রাগে গজ গজ করতে করতে মাচার ওপর থেকে টিনের বাক্স নামাল। ওই বাক্স বিশেষ সময়ে খোলা হয়। কারণ ওতে রয়েছে নতুন কাপড়, সোনার জিনিস। একটা নতুন শাড়ি বের করে নূরবানুকে লক্ষ্য করে বলল,

"তুই পাকের ঘরে যাইয়া বহ তো।"

নূরবানু চুপচাপ ভয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে গেল। কিন্তু পাকের ঘরে গেল না। দরজার আড়ালে লুকিয়ে রইল।

"এদিকে আয়।"

ভয়ে কাচুমাচু হয়ে থাকা বড়ো মেয়েকে কাছে ডাকল সকিরন। মা আবার মারবে ভয়ে ও এলো না।

"সোনাভান!" ব্যস! আর কী সাহস আছে সোনাভান কথা অমান্য করে। সভয়ে কাছে আসতে সকিরনের গম্ভীর মুখটা নমনীয় হয়। সোনাভানের দীঘল কালো চুল। রঙটা ময়লা ছাড়া মেয়ের আর কোনো খুঁত নেই। গোলগাল চেহারা, সুস্বাস্থ্য। তেরো গিয়ে চৌদ্দতে পড়েছে গত মাসে। শৈশব পেরিয়ে যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়ার লক্ষণ একটু একটু করে দেখা দিচ্ছে শরীরে। ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। সকিরন কত নিষেধ করে। মেয়েটা যেন বন্য পাখি। পোষ মানতেই চায় না। স্বামীর ঘরে গিয়ে কী করবে সেই চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম হয় সকিরনের।

"আইজকা বাড়িতে অতিথি আইব। ঘর থেইক্যা বাইর হইবি না। বিকালে ময়নার ভাবি আইসা তোরে সাজাই দিয়া যাইব।"

মায়ের কথায় বিভ্রান্ত মুখে চেয়ে বলল,

"আমারে সাজাইতে আইব ক্যান? আমার কি বিয়া?"

সকিরন মেয়ের প্রশ্নে কপাল চাপড়ায়।

"তোর কি বোধ-বুদ্ধি, লাজ-লজ্জা কিচ্ছু হইব না?"

সোনাভান বুঝল না দোষের কি বলেছে। ওর সবকিছুই সবসময় দোষের হয় কেন? সকিরন শাড়িটা বালিশের কাছে রেখে বলল,

"ভাঁজ খুলিস না। আয় চুল আঁচড়াইয়া দিই।"

সোনাভান ঘুরে বসে। সকিরন চুল আঁচড় দিতে দিতে মেয়েকে আচার-আচরণ শেখায়। সংসার কাজের কথা বলে। সোনাভান জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। দূরের ওই নীল আকাশ, খোলা মাঠ ওকে যেন ডাকে। পাখির কিচির-মিচির মায়ের কথাগুলোকে অস্পষ্ট করে দেয়। চোখ মুদে আসে। ঘুমন্ত মেয়ের মাথাটা বালিশে রেখে সকিরন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটাকে ভালো ঘর ও বরের দেখে দিতে পারলেই তার সকল চিন্তা দূর হবে।

মা ঘর থেকে বের হতে নূরবানু ঘরে ঢোকে। ঘুমন্ত বোনের শিওরে বসে ফিসফিস করে বলে,

"তোর বুঝি রাজপুত্তুর আইব রে, বুবু? মেলা সুন্দর রাজপুত্তুর!"

চলবে,,,

Want your public figure to be the top-listed Public Figure in Mirpur?
Click here to claim your Sponsored Listing.

Category

Website

Address

Mirpur

Other Writers in Mirpur (show all)
Rubai's voice - আবৃত্তিকার Rubai's voice - আবৃত্তিকার
Mirpur

তোমাকে ছুঁতে গিয়ে আবেশে, ফেলে আসি সব অতীতে, ঠিকানা ভুলে কান্না ছুঁয়ে দেখি, তুমি ছিলে শুধু স্মৃতিতে।

A•R Writer A•R Writer
Shapla, Mill, Gaibandha
Mirpur

স্পষ্টতা - 𝙲𝚕𝚊𝚛𝚒𝚝𝚢 স্পষ্টতা - 𝙲𝚕𝚊𝚛𝚒𝚝𝚢
Dhaka
Mirpur, 1216

লেখাগুলো মন থেকে আসে এই লেখায় কোন ত্রুটি নেই।

Ratul bruh Ratul bruh
Mirpur

stay with us and like, fellow this page and pls post vlo lagle like, comment, share koren thank you?

Couple love story彡 Couple love story彡
Dhaka
Mirpur

Assalamualaikum ❣️ গল্পের এক নতুন অধ্যায়। পেজের গল্পঃ গুলো পড়ে মন ছুঁয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

It's kholilur It's kholilur
Mirpur

Http://কাইল্লা.ম্যাম󱢏 Count.me.in.10.second.time.back.follow󱢏

অপরিচিতা অপরিচিতা
Mirpur

ওগো অপরিচিতা,,, তোমার পরিচয়ের শেষ হইল না,!🌸

Midnight Depressionツ Midnight Depressionツ
Dn
Mirpur, 8606

If you ever feel pain inside your chest thinking about your loved one,Tell your mind he was never urs

Rabbaitul Bait Rabbaitul Bait
Mirpur, 1216

একজন দায়িত্ববান স্বামী তাঁর স্ত্রীর অহংকার, আর চরিত্রবান স্ত্রী একজন স্বামীর অহংকার

H.M.Hasibul Isalam H.M.Hasibul Isalam
Mirpur
Mirpur

Assalamualikum, My name is H.M. Hasibul Islam. I'm a self employee. This is my official Page.

Anowar H Runi Anowar H Runi
Mirpur

জন্ম মানেই মৃত্যুর কারন!

চিলেকোঠা - Chileykotha চিলেকোঠা - Chileykotha
Mirpur

ভালোবাসি স্যার হুমায়ুন ফরিদী...