মাহবুবা স্মৃতি

আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি।আল্লাহর সকল পূর্ন কালেমাসমূহের উছিলায়, তার সৃষ্ট সকল প্রানীর অনিষ্টতা থেকে।

আমার একমাত্র মেয়ের স্বশুর বাড়িতে এলাম। এই আসাটা কোন নিমন্ত্রণের নয়। শোকাহত কাউকে সমবেদনা জানাতেও নয়। এখানে আমার জন্য কোন আতিথেয়তার ব্যবস্থাও নেই। মোবাইলে মেয়ের শ্বাশুড়ির দরাজ কন্ঠ তাই নির্দেশ করলো। আজ আমার মেয়েকে নিয়ে পারিবারিকভাবে বিচার বসেছে। তার স্বশুর শাশুড়ি আমাকে ফোন করে আনিয়েছে। যেহেতু মেয়ের অভিভাবক বলতে আমি ছাড়া আর কেউই নেই। তাই আমিই আসতে বাধ্য হলাম।

তারা কিছু বলার আগে, আমিই নিজ থেকে জানতে চাইলাম তার শ্বাশুড়ির কাছে,
আপা মালিহার অপরাধ কি?

তার শ্বাশুড়ি চনচনে গলায় বলতে লাগলো,
আপা,এর আগেও আপনাকে ফোন করে জানিয়েছি বারবার তার চালচলনের কথা। কিন্তু এবার তার অপরাধের মাত্রা চরমে গিয়েছে। তাই আপনাকে হাজির করতে বাধ্য হয়েছি।

আমি নমনীয় স্বরে বললাম,
আপা বলেন শুনি। আমার বাড়ি ফিরতে হবে সন্ধ্যা ফুরোবার আগেই। বাড়িতে কাল জরুরী কাজ আছে।

শুনে মেঘমুখে রুক্ষ স্বরে সে বলল,
মেয়ের মা এত ভাব দেখালে হয় আপা?

স্বভাবদোষেই তার কটাক্ষ করে বলা কথাটা হজম হলো না আমার। ফিচলে হেসে প্রতিক্রিয়া জানালাম।

কেনো আপা? জন্মের সময় অসহনীয় প্রসব ব্যথা শুধু ছেলের মায়ের হয়? মেয়ের মায়ের হয়না? ছেলেকে বড় করতে,পড়াশোনা করাতে অর্থ থেকে শুরু করে যা যা ব্যয় হয়, মেয়ের পিছনেওতো তা হয়। নাকি মেয়েকে জ্বিন,ভুতে লালল পালন করে?
আর তার জন্য অর্থের যোগান আসে গায়েবিভাবে?

তাদের পরিবারের উপস্থিত সবাই স্তব্দ হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। মনে হচ্ছে আমি কোনো এলিয়েন। তার শ্বাশুড়ির ফর্সা গাল মরিচ লাল হয়ে গেলো। আমার দিকে চেয়ে বললো,

আপনি আমার বাড়িতে এসে এত উচ্চস্বরে গলা ছাড়ছেন। আপনার বাড়িতে হলে মনে হয় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের দিতেন।

একদম না আপা। আমার বাড়ি আর ঘর হলেও সেইম কথাগুলোই বলতাম। উচিত কথা যে কোন স্থানে বা যে কাউকেই বলা যায়।

পাশ থেকে মেয়ের ননদ বললো,
আন্টি শুনেন, ভাবি মায়ের মুখে মুখে তর্ক করেছে কাল। প্রায়ই এমন করে। মা, ভাবির কোন ভুল ধরে শুধরে দিতে চাইলেই ভাবি, পাল্টা তর্ক শুরু করে মায়ের সাথে। এভাবে চলতে থাকলে কিভাবে চলবে আন্টি?

এটাই তার অপরাধ?
চোখের পাতা উল্টিয়ে তার ননদকে জিজ্ঞেস করলাম।

পাশ থেকে তার শাশুড়ি গলায় তেজের ঝাঁপি ঢেলে বললো,

এটা কি অপরাধ নয় আপা? পারিবারিক শিক্ষাটা হলো আসল। আপনার স্বামী বহু আগেই মারা গিয়েছে। মেয়েকে আপনিই বড় করেছেন। কিন্তু কি শিক্ষা দিলেন? আপনি ও কি আপনার শ্বাশুড়ির সাথে এমন করেছেন? যা দেখে দেখে আপনার মেয়েও এমন বেয়াদব হয়েছে? আপনার মেয়েকে বলে যান, আর কখনোই যেনো আমার মুখের উপরে কোন কথা না বলে চটাং চটাং করে। তা না হলে আর বরদাস্ত করবো না। এটা তার বাবার কিংবা মামুর বাড়ি নয় যে খেয়ালখুশিমতো চলবে। এটা স্বামীর সংসার।

আমি ধীর গলায় বললাম। এটা অবশ্যই তার স্বামীর সংসার। মানে তারও সংসার। এটা কয়েদিখানা নয় আপা। উপর থেকে যখন যেভাবে হুকুম পড়বে আর তা মালিহা দাসীর মতো মানতে বাধ্য হবে। এখানে তারও অধিকার রয়েছে। তারও মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা আছে।
যে কোন বিষয়ে সবার সাথে সে বোঝাপড়া করেই চলবে। সে বউ হয়েছে বলে তার কোন যুক্তি বা মতকে ভুল, তর্ক,অন্যায়,অপরাধ,
অসভ্যতামি হিসেবে দেখা আপনাদের ভুল। বউর সবকিছুই ভুল? আর স্বামীর সংসারের ছোট বড় সবাই যা বলবে তাই সঠিক আপা?

শুনে সে চটুল মেজাজে বললো,

এবার বুঝলাম আপনার মেয়ে মুখে মুখে তর্ক করা কার কাছ থেকে শিখেছে?

আমিও দমে থাকার মানুষ নয়। উপস্থিত সবাইকে শুনিয়ে বললাম,

আমাকে গ্রামের আট দশটা মায়ের মতো ভাবলে আপনারা ভুল করবেন। আমি একবিংশ শতাব্দীর একজন প্রগতিশীল মা। বেগম রোকেয়া আমার মুখস্থ। নিয়তির চাপে অভাবে পড়েছি। কিন্তু অশিক্ষিত মা নই আমি। জীবনের বহু বাঁকে বহু সংগ্রাম করে নিজে বেঁচে থেকেছি। আমার একমাত্র মেয়েকে বাঁচিয়ে রেখেছি। অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে শেখাইনি।

মেয়ের নামে, স্বামীর সংসারের মানুষ ভুল অভিযোগ তুললে, তাদের পক্ষ নিয়ে মেয়েকে দশকথা শুনাবো না। মারধর ও করবো না। মাথা নিচু করে দুহাত জোড় করে মেয়ের হয়ে ক্ষমাও চাইবোনা। বা এমন ও বলবোনা, এটা মেয়েদের কপাল। মেনে নিতে হয়। মানিয়ে নিতে হয়। কারণ আমি এমন মা নই। এমন মানুষ নই। আমি চাই সবার জীবন সুন্দর ও শান্তির হোক।

মায়ের মতো করে সন্তানকে পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউই জানে না বা চিনেও না। আমার মেয়ে কেমন তা আমি বেশ জানি। সব শুনেছি আমি। সে অযথা তর্ক করেনি। ভুল যুক্তিও খন্ডন করেনি। বয়সে বড় হলেই যে আমাদের মুরুব্বিদের সব কথা সঠিক বা কোন ভুল নেই। এমন বদ্ধ ধারণা থেকে মুক্ত হোন আপা ।

জেনে রাখুন,পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষকে উচিত অনুচিত শেখায়। মরতে মরতে বাঁচতে শেখায়। আমার মেয়েকে নিজে একা হাতে মানুষ করেছি। সে কাছ থেকে দেখেছে তার মায়ের নিদারুণ লাঞ্চিত জীবন। যা আপনার মতো শ্বাশুড়ির জন্যই হয়েছে। সে পড়াশোনা করা মেয়ে। ভালোমন্দ অনুভব করার যথেষ্ট সামর্থ্য তার রয়েছে। তাই প্রতিবাদী হতে শিখেছে। যুক্তি খন্ডন করতে শিখেছে। লড়াই করতে শিখেছে।

আর আপনাদের চোখে এসবই মারাত্মক অন্যায়। আমার মেয়েকে তার পরিবেশ এটাই শিক্ষা দিয়েছে,
তুমি ভালো পরিবেশ পেলে বেশী ভালো চলবে। যাতে সবাই তোমার প্রশংসা করতে বাধ্য হয়। আর খারাপ পরিবেশ পেলে বেশী খারাপ চলবে। যাতে সবাই বুঝতে পারে,তোমাকে পুতুল হিসেবে নাচানো যাবে না। মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে।

নিজের অবস্থান থেকে নিজের মতো করে অন্যকে বোঝার চেষ্টা করবেন না।
তার অবস্থান থেকে তাকে বোঝার ও মূল্যায়ন করার চেষ্টা করুন। হতে পারে তখন সে আপনাকে চমকে দেওয়ার মতোই চলবে আপা।

মেয়েকে ডেকে বললাম,
এরপর থেকে তোর সাথে অন্যায় কিছু ঘটলে সারাজীবনের জন্য তোর মায়ের কাছে চলে আসবি। নিত্য সংঘাত আর অনাদরের জীবনের চেয়ে একা নিঃসঙ্গ জীবন শান্তির ও সম্মানের।
"মানুষ পৃথিবীতে শুধু ভালোবাসার জন্যই বেঁচে থাকেনা, সম্মানের জন্যও বেঁচে থাকে।"

তাদেরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এলাম। রাতে শূন্য বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি, আমার জীবনের সুখের ভেলা না হয় ডুবে গেল নিয়তির ঘেরাটোপে, অস্তমিত সূর্যের মতো। মেঘে মেঘে অনেক বেলাও হলো। আমার একমাত্র সম্বল আদরের কন্যা মালিহা। তারতো জীবনের রঙিন অধ্যায় মাত্র শুরু।
মা হয়ে তার শশুর বাড়িতে এতটা গলা উঁচিয়ে কথা বলা কি ঠিক হলো আমার? এর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে পরে? এতে কি মালিহা আবার বেশী প্রশ্রয় পেয়ে যাবে?

চলবে..?

#সংগৃহীত