Koyel writes
ʿʿইহ‚ শারিপুত্র‚ রূপং শূন্যতা শূন্যতৈব রূপংʾʾ
༄༅ ཀོ་ཡེ་ལ་། བྷཊ་ཊཱ་ཅཱརྱྱ་།།
|| ধর্মবিজয় ||
কুমারী পর্বতের পাদদেশে এসে মগধসম্রাটের রথের চাকা বসে যায়। ঋষিকুল্যার তটস্থ অরণ্যের চোরা কাদা গজ-তুরঙ্গের পা টেনে ধরে। মৌর্য্য সেনাপতি পদব্রজে উপরে উঠে দেখেন, কুন্দশুভ্র উপবীতধারী এক প্রৌঢ় পূজারী দুই ভদ্র কিশোরীকে দুই পাশে নিয়ে বসে মন্দিরের দরজা আগলাচ্ছেন। সেনাপতি ভিতরে প্রবেশ করতে চাইলে ব্রাহ্মণ বাধা দেন। দৃপ্ত কণ্ঠে শ্লেষ করেন, “তোমাদের ঐ প্রেমবৈরী চণ্ডাল রাজাকে আগে অনুতাপের চোখের জলে মনের মালিন্য আর হাতের রক্ত ধুয়ে আসতে বলো। এই তীর্থ মহাপ্রেমের, মহাকরুণার। এখানে অধর্মের স্থান নেই।” মৌর্য্য সেনাপতি বলেন, “আমরা কলিঙ্গের পলাতকা রাজকন্যাকে খুঁজছি। সন্দেহ হয়, তিনি এখানে আত্মগোপন করেছেন।” ব্রাহ্মণ বলেন, “যদি সে এখানে থেকেও থাকে, তোমরা আমায় অতিক্রম করে তার কাছে পৌঁছতে পারবে না।”
মৌর্য্য সেনাপতি এবার রেগে গিয়ে তরবারি কোশমুক্ত করেন। ব্রাহ্মণের দুই কিশোরী মেয়ে সামনে এগিয়ে এসে ব্রাহ্মণকে আড়াল করে। প্রথমজন খর গ্রীষ্মরৌদ্রের মতো তেজোবতী। চোখ দু’টিতে যেন গনগনে যজ্ঞশিখা জ্বলছে। হাতে মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে আনা নভোশ্চুম্বী ত্রিশূল। বীরাঙ্গনা যোদ্ধৃণীর ভঙ্গিমায় প্রত্যালীঢ় পদন্যাসে দাঁড়িয়ে সে সেনাপতিকে নীরব রণাহ্বান জানাচ্ছে। দ্বিতীয়জন শ্যামা, শান্তা; অগ্রজার ঠিক বিপরীত। হাতে একটি নীলপদ্ম বৈ অন্য কোনো অস্ত্র নেই। অথচ সারা কলিঙ্গভূমি জুড়ে শোণিত-স্রোতোস্বিনী বইয়ে দেওয়া মৌর্য্য সেনাধ্যক্ষের কোশমুক্ত তরবারিকে তার এতটুকু ভয়ও নেই। সে তার শূলধারিণী জ্যেষ্ঠা ভগিনীর থেকে আরো খানিক এগিয়ে এসে পদ্মধরা বামহস্ত তুলে দম্ভভরে আদেশ করে, “যাও, তোমাদের রাজাকে পাঠাও। যাও, বলছি!”
এই ব্রাহ্মণ আর তাঁর দুই তনয়ার পানে ঠায় চেয়ে থাকলে মাথা ঘোরে। আবেশ লাগে। কানে একনাগাড়ে বুঝি ওঁঙ্কারধ্বনি বাজে। শরীর অবশ হয়, হাতের তরবারি ঠক করে মাটিতে পড়ে যায়। সেনাপতি থতমত খেয়ে ছুটতে ছুটতে নীচে নামেন। বলেন, “মহারাজ, এই স্থান ভালো না। বোধ হয়, এ ডাকিনী-যোগিনীর ক্ষেত্র। এখানকার জল-হাওয়ায় কেউ যেন মন্ত্র পড়ে রেখেছে। আমাদের দ্রুত এই পীঠ ত্যাগ করা সমীচীন।” সম্রাট শুধোন পর্বতশিখরের মন্দিরটি খুঁজে দেখা হয়েছে কি না। সেনাপতি লজ্জায় মাথা হেঁট করে থাকেন। সম্রাট মন্দিরগমনার্থ রথ থেকে অবতরণ করলে বেচারি আকুল হয়ে বলেন, “যাবেন না, মহারাজ! ওখানে দুই যক্ষিণী আছে, গেলেই সকলকে গুণ করবে।” সম্রাট তবু শোনেন না।
কোন এক অদৃশ্য রজ্জুর টানে বশীভূতের মতো হাঁটতে হাঁটতে সম্রাট উপরে উঠতে থাকেন। মন্দির যত সন্নিকটস্থ হয়, তত মনে হয় নীচে মায়াময় সংসার হারিয়ে যাচ্ছে অনেক দূরে। সময়ের গতি কমে আসছে। মন্দিরের দরজায় ত্রিশূল ধরে তপ্তকাঞ্চনবর্ণা এক রমণী দাঁড়িয়ে আছেন। ক্রুদ্ধ স্বরে বলছেন, “নিরপরাধ কলিঙ্গবাসীর রক্তে যে তরবারি রাঙ্গিয়েছিস তুই, ঐ তরবারি দিয়ে আজ তোকে আমার সাথে যুদ্ধ করতে হবে। আমি তোকে হত্যার অভিপ্রায়ে অস্ত্র তুলব, তুই নিজে বাঁচার দায়ে আমার প্রহার ঠেকাবি। এবার প্রস্তুত হ! তোর মৃত্যুর সময় আসন্ন!” বুঝি আষাঢ়জলদের তীব্রতম বিদ্যুজ্জ্বালাটি সম্রাটের কম্পমান শরীরকে মাধ্যম করে ধরণীবক্ষে নেমে আসে। স্পষ্ট স্মরণ হয়, এই রমণীকেই সম্রাট গতরাত্রের স্বপ্নে দর্শন করেছিলেন সিংহবাহিনী দশভুজার রূপে। ঠিক এই কথাগুলিই এই রমণী তাঁকে গতরাত্রেও বলেছিলেন— “প্রস্তুত হ! তোর মৃত্যুর সময় আসন্ন!” সত্যিই কি সম্রাটের মৃত্যু আসন্ন? বীরবিক্রমে কলিঙ্গদেশ জয় করে শেষে এক স্ত্রীলোকের হাতে মরবেন? কে জানে!
দেবী এগিয়ে এসে ত্রিশূল তুলে আঘাত হানেন, সম্রাট অধিকক্ষণ সে আঘাত ঠেকিয়ে রাখতে পারেন না। তরবারি স্খলিত হয়। দেবী নির্মম কারুণ্যকটাক্ষে নিমেষে সম্রাটকে পদাব্জে আছড়ে ফেলে শূলবিদ্ধ করেন। সম্রাটের মনে হয়, যেন তাঁর কায়-বাক্-চিত্তে যা কিছু অন্ধকার ছিল, সব দেবী শুষে নিচ্ছেন। যন্ত্রণার ঘোরে সম্রাট দেখেন, দেবীর পিছনে বাসন্তী কাষাব পরিহিত এক রাজভিক্ষু এসে দাঁড়িয়েছেন। আর সেই ভিক্ষুর হাত ধরে এসেছে উৎপলধারিণী এক শ্যামাঙ্গিণী বালিকা। ধীরে ধীরে বসেছে সম্রাটের শিয়রে। সম্রাটের মাথা কোলে টেনে নিয়ে সস্নেহে ললাটের স্বেদ মার্জন করছে। তার ভগিনীর ত্রিশূলে সৃষ্ট ক্ষতের উপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সম্রাটের সব যন্ত্রণার উপশম ঘটছে। তারপর দুই স্ত্রীমূর্তি সহসা একত্রে সেই রাজভিক্ষুর মধ্যে নিবিষ্ট হয়ে গেল। ভিক্ষুর সম্ভোগকায়ার অর্ধভাগ কাঞ্চনবর্ণে, অর্ধভাগ হরিতবর্ণে বিভূষিত হয়ে অপার্থিব এক মূর্ততা রচনা করল। কাঞ্চনার্ধের হস্তে নির্মম ত্রিশূল, হরিতার্ধের হস্তে করুণার নীলপদ্ম। এক পুরুষের শক্তির দুই রূপ। করুণাও নির্মমতা, নির্মমতাও করুণা।
সেদিন কুমারী পর্বতে দুই ব্রাহ্মণদুহিতা মগধসম্রাটকে সত্যিই গুণ করেছিল। একজন প্রাণ নিয়েছিল চণ্ডাশোকের, অপরজন জন্ম দিয়েছিল ধর্মাশোকের। সেই মহাপ্রেম আর মহাকরুণার তীর্থেই আচার্য্য উপগুপ্তকে ডেকে মগধসম্রাট ত্রিশরণ গ্রহণ করেছিলেন। সেই মন্দিরেই কলিঙ্গদেশের রাজকুমারী মগধসম্রাটের গলায় বরমাল্য পরিয়েছিলেন।
বৌদ্ধ নির্ঘণ্টানুসারে দশমী আজই। সিকিম, নেপাল, ভুটান, উত্তরবঙ্গের বহু মঠে আজ বুকে নিঃসীম শূন্যের আকুলান তোলা সুরে প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র পঠিত হবে। ভক্তপ্রাণে যত খেদ, ক্লেশ, কর্দমকলঙ্ক; সব চোখের জলে ধুয়ে, নিংড়ে, শাস্তা সমাধিপ্রস্থান আরম্ভ করবেন।
আমাদের ডাক্তারবাবুর বাড়িতে অবশ্য আজ মা নবমীর পুজো নিচ্ছেন। আমি এই আয়োজনে উপস্থিত থাকতে না পেরেও আছি, এ আমার বিরাট সৌভাগ্য। যে মুহূর্তে ওঁকে আমি বজ্রযানী শৈলীতে মূর্তি গড়তে বলেছিলাম, সেই মুহূর্তে মা নিশ্চয়ই আমার জিহ্বাগ্রে অধিষ্ঠান করছিলেন। মা স্বয়ং ওঁর হাতে এভাবে নির্মাণকায়া নিতে চেয়েছিলেন বলেই আমায় দিয়ে 'বলিয়ে' নিয়েছিলেন।
আমি আর ব্রহ্মকমল ওঁকে বারবার বলি এসব কাজে বেশি সময় দিতে। ডাক্তারি পড়ার ছাত্রের অভাব দেশে নেই, কিন্তু এমন মূর্তি গড়ার মানুষ বড় কম। আমরা সৌন্দর্যের সাধক। সৃজনশীলতার মধ্যেই মৃন্ময়ীতে চিন্ময়ীর সার্থক আরাধনা। অন্তত ফেসবুক ওয়ালে এই প্রতিমা অক্ষয় হয়ে রয়ে যাক। বছর বছর স্মৃতিতে ভেসে উঠবে।
বর্ধমানের বদ্যি বুড়ো, তোমার অন্তরের শিল্পীটি
দীর্ঘজীবী হোক; মায়ের কাছে এই প্রার্থনা করি।
|| বলিদান ||
গঙ্গাবক্ষে ভিক্ষু রাঢ়বঙ্গে পাড়ি দেবে। বিকালের পর কোনো নৌকা আর যাত্রী তুলতে রাজি হয় না। জলে নাকি ডাকাতের বড় উপদ্রব। ভিক্ষু চারটি স্বর্ণমুদ্রা দেবে বলে। মাঝি রুদ্ধশ্বাসে দ্রুত বৈঠা ফেলে। আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণে কালো মেঘ জমে। ঝড় উঠবে। ভিক্ষুর মনে পড়ে, শীলভদ্র বলেছিলেন আর্য্যতারা জলাপৎশমনী। না, না— আর্য্যতারা এক তীর্থিকদেবীর অনুকৃতি। পরমতের আরাধ্যার শরণাগতি নেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। সে ভাবে, এদেশে আসবার কালে পথের সমস্ত আপদবিপদে যেমন বুদ্ধ রক্ষা করেছেন, এদেশেও তেমন বুদ্ধই রক্ষা করবেন। কিন্তু এদেশে যে বুদ্ধ বিপত্তারণের ভার অন্য একটি মেয়ের কাঁধে সঁপেছেন, সে বুঝতে পারে না। তারপর একসময় মাঝনদীতে জোরে বাতাস বয়। নৌকা ডোবে। ভাসতে ভাসতে অচৈতন্য অবস্থায় ভিক্ষু কোনোক্রমে এসে ঠেকে তীরের জঙ্গলে। কারা যেন চ্যাংদোলা করে তাকে ধরে নিয়ে যায়।
রাত্রিবেলা সে টের পায়, মোটা সোনার কাঁকন পরা একখানি হাত তার জ্বরতপ্ত ললাটে পরমযত্নে জলপটি দিচ্ছে। “কে! কে, মা, তুমি! কী সুন্দর পদ্মপাতার মতো মুখ। মরকতমণির মতো চোখ জুড়োনো গায়ের রঙ। মমত্বের আভায় সারা দেহ যেন ঢলঢল করছে। আমার জন্মদাত্রী মা আমায় সেই কোন শিশুবয়সে পদ্মপাতায় করে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। বড় হয়ে বহুবার তাঁর মুখচ্ছবি কল্পনা করতে চেয়েছি। করতে পারিনি। আজ তোমার শ্রীমুখ দেখে কেন জানি মনে হচ্ছে, তুমিই আমার হারানো সেই মা। চীনদেশেতে জলে ভাসিয়ে এখন ভারতে কোলে নিয়েছ।”
“তুই ডাকাতের হাতে পড়েছিস, বাছা আমার। এই দয়ামায়াহীন লোকগুলি জ্বর নামার সাথে সাথে তোকে মা দুগ্গার থানে হাঁড়িকাঠে বলি চড়াবে। তুই আজ্জতারার নাম জপ কর। আজ্জতারার নাম সারা সংসারের সার। একটিবার তারা বলে ডাকলে চোখের নিমেষে সব বিপদ কেটে যায়।”
“না। পরমতের দেবীর শরণ আমি কিছুতেই নেব না। তাতে বিপদ না কাটে, না কাটুক। আমার শাক্যমুনি যদি আমায় রক্ষা করতে না পারেন তবে তোমাদের হাঁড়িকাঠেই আমার বলি চড়ুক।”
“এত জাতগব্ব তোর? এক ডাকাতের বৌকে অবলীলায় মা বলে ডাকতে পারিস, আর স্বয়ং জগতের মা’কে মা বলে ডাকতে গিয়ে মত বিচার করতে বসিস? সন্তানের জন্যেও যে মায়ের প্রাণ কাঁদে, সে কথা কি তুই বুঝিস নে!”
সেই মমতাময়ী নারীর আকুলান দেখে ভিক্ষুরও চোখ ভিজে ওঠে। “হারে রেরে রেরে, বলির ক্ষণ আইল নাকি রে!” বাইরে দস্যুদের মদমত্ত হুঙ্কার ধ্বনিত হয়। ডাকাতপত্নী আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদেন, আর যথাসম্ভব বিলম্ব করেন। ভিক্ষুকে তারার নাম জপতে বলে কাকুতি মিনতি করেন। রাত্রিদ্বিপ্রহরে অবশেষে জ্বর নামে। ডাকাতেরা ভিক্ষুকে দুর্গার থানে আনে। ডাকাতরাজা আকাশ কাঁপিয়ে মন্ত্র পড়েন,
“নমস্তে জগচ্চিন্ত্যমানস্বরূপে নমস্তে মহাযোগিনি জ্ঞানরূপে।
নমস্তে নমস্তে সদানন্দরূপে, নমস্তে জগত্তারিণি ত্রাহি দুর্গে॥
অনাথস্য দীনস্য তৃষ্ণাতুরস্য ভয়ার্তস্য ভীতস্য বদ্ধস্য জন্তোঃ।
ত্বমেকা গতির্দেবি নিস্তারকর্ত্রী, নমস্তে জগত্তারিণি ত্রাহি দুর্গে॥”
ভিক্ষুর বুকের মধ্যে তোলপাড় করে। এই কি এক দুর্জনের পুজো? এ তো যাকে হত্যা করতে আনা হয়েছে তারই মুক্তির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা! এ যে সর্বস্ব অপহরণের বদলে পরমস্ব দানের সাধনা! এখন হঠাৎ নিজের অজ্ঞাতসারেই মন বলে তার, এই দেবীর পায়ে মাথা রেখে মরলে বিশেষ ক্ষতি নেই। শাক্যমুনিও সম্ভবত তার এমনই মৃত্যু চা’ন।
ডাকাতের দল তার দুই হাত পিছমোড়া করে কষে বেঁধে দেয়। তেলসিঁদুরে স্বস্তিকচিহ্ন এঁকে যূপকাষ্ঠ সাজায়। যূপকাষ্ঠে গলা পেতে ভিক্ষু খড়গাঘাতের প্রহর গোনে, এক… দুই… তিন…; কই, ঘা পড়তে এত দেরি হয় কেন।
ঘাড়ের কাছে মোটা কাঁকনের কিঙ্কিনী বাজে। ডাকাতপত্নী স্বামীর হাত চেপে ধরেছেন। আকুল হয়ে বলছেন, “দোহাই তোমার, ওকে মেরো না।” ডাকাতরাজা গম্ভীর স্বরে ধমকে উঠলেন, “আমি যে দেবীর পুজোয় ওকে বলি দেবার সঙ্কল্প করে ফেলেছি, এখন কী করে ভাঙ্গব সে সঙ্কল্প!”
“উপায় আছে। উভয় কূল রক্ষার উপায় আছে। ও দেবীর পায়ে প্রণত হলেই বলির সঙ্কল্প পূর্ণতা পায়। মাথা নত করানোও মুণ্ডচ্ছেদেরই সমান।”
“বেশ”, ডাকাতরাজা বলেন, “ও যদি দেবীর চরণে ভক্তিভরে মাথা ঠেকায়, আমি ওকে প্রাণভিক্ষা দেব।”
ভিক্ষু বলে, “আমার প্রাণভিক্ষার প্রয়োজন নেই, বরং আমায় বলি দিয়েই সঙ্কল্প পূরণ করা হোক। কারণ ত্রিশরণ ব্যতীত অন্য কোনো শরণে আমি প্রণত হতে অপারগ।”
“তোর এই মায়ের মাথার দিব্যি লঙ্ঘন করতেও তুই অপারগ”, ভিক্ষুর হাতের বাঁধন খুলে দক্ষিণ করতলটি নিজ শিরোপরি টেনে নিয়ে ডাকাতপত্নী বলেন, “যদি সত্যিই আমায় জননীর আসনে বসিয়ে থাকিস, আমার আদেশ তোকে পালন করতে হবে। প্রাণভিক্ষা পেতে পরের দেবীর শরণাগতি নয় নাই নিলি; আমার মাতৃত্বের মান রাখতে এই মাতৃবিগ্রহের চরণে তোকে মাথা ঠেকাতে হবে। পারবি না ঠেকাতে? বল্—!”
তাঁর মাথা থেকে হাত নামিয়ে ধীরে ধীরে ভিক্ষু পূজাবেদীর দিকে এগিয়ে যায়, নতজানু হয়; ডাকাতেরা প্রবল ঢক্কানিনাদ তুলে সমস্বরে গায়,
“শরণমসি সুরাণাং সিদ্ধবিদ্যাধরাণাং মুনিমনুজপশূনাং
দস্যুভিস্ত্রাসিতানাং নৃপতিগৃহগতানাং ব্যাধিভিঃ পীড়িতানাম্
ত্বমসি শরণমেকা দেবি দুর্গে প্রসীদ॥”
মহিষমর্দিনীর চরণে মাথা ঠেকিয়ে কতক্ষণ সে অশ্রুপাত করে, কে জানে। তারপর মনে হয়, মোটা সোনার কাঁকন পরা সেই হাতখানি তার চিবুকপানে বাড়িয়ে দিয়ে মা দাঁড়িয়ে আছেন দশপ্রহরণধারিণী দেবীপ্রতিমার সামনে। অন্য হাতে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও অনামিকার যোগমুদ্রায় ধরে আছেন সনাল ইন্দীবর। মরকতমণির মতো চোখ জুড়োনো মায়ের গায়ের রঙ। সুন্দর পদ্মপাতার মতো মুখ। অবাধ্য ছেলেকে প্রণত করতে ডাকাতপত্নীর বেশ নিয়েছিলেন; এখন সে ছদ্মবেশের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ছেলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো পিছনে ফিরে দেখে, সেই ডাকাতরাজা আর সঙ্গীসাথীর স্থানে লোকেশ্বর, মঞ্জুশ্রী, মৈত্রেয় প্রমুখ কোটি বোধিসত্ত্ব-পরিবৃত হয়ে পীতবাস জটাজুটধারী এক সিংহতপস্বী সহাস্যবদনে অভয়াশীর্বাদ করছেন।
Medha Sinha
তোকে ট্যাগাতে পারি না কেন?
কোথায় সমস্যা হয়?
|| সাধনসমর ||
অষ্টমীর সারা বেলা অঝোরধারে বৃষ্টি হয়ে সন্ধ্যায় সন্ধিক্ষণে এসে মেঘ সরল। দেখা দিল শুক্লপক্ষের নির্মল চাঁদ। অর্জ্জুন শারদার আরাধনা সমাপ্ত করেছে। এখন দেবী তাকে বজ্রাসনের আদ্যা স্বরূপে দর্শন দেবেন। শাক্যমুনির বজ্রবৎ কঠোর সঙ্কল্পের কারণেই এই আসনের নাম বজ্রাসন। জন্ম-জন্ম দান-শীল-ক্ষান্তি-বীর্য্য আদি নববিধ পারমী পূরণ করে এই জন্মে শাক্যসোম অশ্বত্থতলে বসেছেন বোধিলাভের অভিপ্রায়ে। মার তাঁর তপস্যা ভঙ্গ করতে মায়াসৈন্য নিয়ে সমাগত। অহঙ্কার নিয়েছে মদমত্ত হস্তীমূর্তি, কাম হয়েছে বিষসর্প। ক্রোধ হয়েছে মহিষ। লোভ ললনার বিগ্রহে স্তনপট্ট শিথিল করে কটিতট দোলাচ্ছে। তবু তিনি নির্বিকার দেখে মার আস্ফালন করে বললেন, “বোধিলাভের সঙ্কল্প মিথ্যা! বুদ্ধ মিথ্যা! কামনাই একমাত্র সত্য। জগতে যে কামনা চরিতার্থ করতে পারে তাকেই জগত মনে রাখে। যে পারে না তাকে ভুলে যায়। বুদ্ধের সাধনা জগত মনে রাখে না। বুদ্ধের কৃচ্ছ্রসাধনা মিথ্যা! বুদ্ধ মিথ্যা!” শাক্যসিংহের দক্ষিণ হস্ত ভূমিস্পর্শ করল। “বুদ্ধ সত্য, জগত মায়া। বুদ্ধের প্রজ্ঞা সত্য, বদ্ধ জীবের কামনা বাসনা মায়া। এই চিরসতী ধরিত্রী বুদ্ধের কৃচ্ছ্রসাধনের সাক্ষী।” অমনি ভূমা ধরণী প্রেমপুলকে কেঁপে উঠল। শাক্যমণির ভ্রূযূথমধ্যস্থ ঊর্ণকোশ থেকে তীব্র আলোকরশ্মি নির্গত হয়ে দশভুজা এক দিব্য রমণীর রূপ নিল। তিনিই ধরা, তারা; অবিদ্যাসংহারিণী সনাতনী বুদ্ধপ্রজ্ঞা। জগদ্বৃক্ষমূলনিবাসিনী যোগাদ্যা কুণ্ডলিনী মূলাদুর্গা। দশ পারমিতা তাঁর দশ হাতের আয়ুধ। ত্রিনাড়ী- ত্রিরত্নের দ্যোতক সুতীক্ষ্ণ ত্রিশূল বজ্রমুষ্ঠিতে ঊর্ধ্বে ধরে তিনি “বুদ্ধ সত্য, জগত মায়া”–র বেদবাক্য প্রচার করছেন। তাঁর অট্টহাস্যে মার মরীচিকার মতো মহাশূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে।
Medha Sinha এঁকেছে স্ক্রিনে আঙ্গুল বুলিয়ে। আমার লেখাটি ইতিমধ্যেই পঞ্চম বৈদিক শারদ পৌরাণিকায় প্রকাশিত। সকলকে মহাষ্টমী এবং মহানবমীর শুভেচ্ছা।
|| সিদ্ধি ||
দুইশত বৎসর পর প্রথমবার সেদিন মাতৃবিগ্রহসম্মুখে অমরের ধ্যান ভঙ্গ হয়েছিল। সে অশনিসঙ্কেতে নিজের অজান্তেই বুঝে গেছিলেন, তাঁর শেষ প্রহর ঘনিয়ে আসছে। দাক্ষিণাত্যের এক নাবালক ব্রহ্মচারী সারা ভারতবর্ষ জুড়ে বৌদ্ধদের তর্কে পরাস্ত করে বেড়াচ্ছে। ধর্মকীর্তির মতো অপরাজেয় পণ্ডিত অবধি তাকে সামলাতে বেগ পাচ্ছেন। এখন সেই ছেলে অবস্থান করছে গৈরিধারার সন্নিকটে। অমর বাক্সিদ্ধ হয়ে যদি সেই ছেলের গতিরোধের সাহস না সঞ্চয় করতে পারেন, তবে তাঁর জীবনের কী বা মূল্য! দুইশত বৎসর পর সমাধি থেকে আত্মপ্রকাশ করে অমরবান শঙ্করকে তর্কে আহ্বান দিলেন।
তর্ক আরম্ভ হল। অমরের শর্তানুযায়ী দুই পক্ষের মাঝে একটি দীর্ঘ বস্ত্রপট্টের আড়াল থাকত। অমর তাঁর বাগীশ্বরীর মূর্তি সঙ্গে নিয়ে তর্কাসনে বসতেন বিপক্ষের অগোচরে। বাগীশ্বরী সত্যিই তাঁকে সঙ্গ দিতেন। আট দিন ব্যাপী তর্ক চলার পর শঙ্করের হার হল। কিন্তু শঙ্কর বুঝতে পারল, অমর একার কৃতিত্বে জয়লাভ করেননি। তাঁর মাথার উপর নিশ্চয় কোনো ঐশী শক্তির বরদ পাণিপদ্ম ন্যস্ত আছে। সেই শক্তির স্বরূপ জানতে শঙ্কর তৎক্ষণাৎ তর্কস্থলেই ধ্যানে বসল। তার ভ্রূযুগল তরঙ্গায়িত হতে লাগল। ওষ্ঠাধর অভিমানে কাঁপল।—
“জননি! এ তোমার কেমনতর পক্ষপাতিত্ব? এক সন্তানকে বঞ্চনা করে আরেক সন্তানকে অনৈতিকভাবে সঙ্গ দিচ্ছ। আমি তোমার পতির মতানুসারী নই বলেই কি আমার প্রতি এই কাপট্য! বেশ, তবে তোমায় জয় করেই আমি তোমার পতির মত খণ্ডাব।”
সে মনে মনে এই সঙ্কল্পবাক্য উচ্চারণ করবার সাথে সাথে মাঝের বস্ত্রপট্ট দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে ফেলল। অন্তরালের ধন ব্যক্ত হয়ে পড়ল। অমর লজ্জা পেলেন। শঙ্কর মা’কে প্রণাম করতে এলে তিনি ঝটিত বেগে বিগ্রহ সরিয়ে নিলেন; বললেন, “তুমি তো ব্রাহ্মণসন্তান! তোমার প্রণাম গ্রহণের জন্য বেদের তেত্রিশ কোটি দেবতা মুখিয়ে আছেন। কিন্তু আমার মতো শূদ্রের প্রণাম গ্রহণের জন্য এই আর্য্যতারা ছাড়া আর কেউ নেই। আমার মায়ের মূর্তি আমি তোমাকে স্পর্শ করতে দেব না।”
শঙ্কর সক্ব উপত্যকায় গিয়ে তারার সাধনায় বসল। নীলকণ্ঠ নীলাকে বলল, “দেখলে! শঙ্করের অভিমানের প্রাবল্যের কাছে অমরের অভিমানও যেন খর্ব হয়ে যাচ্ছে। আমি তো স্পষ্ট শুনছি, সে একাগ্রচিত্তে স্বহৃদিপীঠে লব্ধ খদিরবনসুন্দরীর বৌদ্ধ মতের নিত্য দশাক্ষরী মন্ত্রটি জপ করছে। হরিত তারা কর্মকুলমহিষী। অমোঘসিদ্ধি তার কুলাধীশ। তাকে যে জয় করতে পারবে, তারও সিদ্ধি অমোঘ। প্রিয়তমা! আমি যোগচক্ষু দিয়ে দেখতে পেলেম, শঙ্করের ঐকান্তিক সাধনায় তুষ্ট হয়ে সেই উৎপলধারিণী রাজকন্যা শূন্য থেকে রূপ নিল। শঙ্কর বদ্ধাঞ্জলিপুটে তার স্তুতি করল;
স্মেরচারুমুখমণ্ডলাং বিমলগণ্ডলম্বিমণিমণ্ডলাং
হারদামপরিশোভমানকুচভারভীরুতনুমধ্যমাম্।
বীরগর্বহরনূপুরাং বিবিধকারণেশবরপীঠিকাং
মারবৈরিসহচারিণীং মনসি ভাবয়ামি পরদেবতাম্॥—”
নীলা শুধোল, “তারপর?”
“তারপর অমরবানের তারামূর্তিটি অন্তর্হিত হল। অমরবান পরাজয় স্বীকার করে নিলেন; তারপর তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তি, তাঁর বাগীশ্বরীর অনুগ্রহে রচিত সেই শব্দকোশ বিজয়ীর হাতে তুলে দিলেন।”
“তারপর?”
“তারপর শঙ্করের প্রস্থানমাত্র তাঁর এতদিন যাবত বিরচিত বাকি পুঁথিগুলি একে একে ছিঁড়ে ফেলতে লাগলেন আগুনে। সবশেষে নিজে ঝাঁপ দেবার আগে গবাক্ষ উদ্ঘাটন করে একবার দেখলেন, দেহময় ত্রিপুণ্ড্র আঁকা ঐ একরত্তি ছেলে গৈরিক বসনাবৃত স্কন্ধে দণ্ডধ্বজা নিয়ে চলে যাচ্ছে। আর তার পিছন পিছন এক শ্যমলা দ্বিভুজা মেয়ে বাম হস্তে উৎপল, দক্ষিণ হস্তে বরদ মুদ্রা প্রদর্শন করে বীরগর্বহরণ নূপুর পরে নিক্বণ তুলে হাঁটছে।”
Artwork by Medha Sinha
সকলকে মহাসপ্তমীর শুভেচ্ছা
|| বোধন ||
পদ্মবাঁকের ধারে এসে থমকাল অর্জ্জুন। ঝিলে পদ্ম ফোটা তো দূর, পায়ের পাতা ভেজাবার জলটুকুও নেই। তার পদার্পণের পর নালন্দায় কখনো এমন অঘটন ঘটেনি। এবার কি তবে কোনো কারণে প্রকৃতিমাতৃকা কুপিতা হয়েছেন? বিহারতোরণে মহেশ্বরের বিগ্রহে প্রচণ্ড তাপে মাঝ বরাবর ফাটল ধরেছে। উমা-মহেশ্বরের ইচ্ছেতেই একদিন মগধে নালন্দা, বজ্রাসন ও মহাবোধি বিহারত্রয় মাথা তুলেছিল। কৈলাসতীর্থগত দুই নিষ্ঠ ব্রাহ্মণসন্তানকে হরপার্বতী তন্ত্রযানী মঠ স্থাপনের আদেশ দিয়েছিলেন। বজ্রাসন শাক্যমুনির বোধনপীঠ। এখানে শাক্যমুনিই শিব। শিবানী বুদ্ধশক্তি প্রজ্ঞাপারমিতা। বুদ্ধের প্রজ্ঞাই চণ্ডীরূপা মারমর্দিনী, আবার মহালক্ষ্মীস্বরূপা খদিরবনবরণী শ্যামাঙ্গিণী; আর্য্যতারা– জগত্তারিণী; সর্বক্লেশবিখণ্ডিনী। অন্নাভাব ঘোচাতে তারার আবাহনই একমাত্র পথ।
অনাবৃত পদে প্রস্তরসঙ্কুল আরোহণ অতিক্রম করে অর্জ্জুন গৃধ্রকুটশিখরে উঠে গেল। আকাশে রক্তচক্ষু সূর্য অগ্নিবাণবর্ষণরত। নীচে ফুটিফাটা শস্যক্ষেত্রে কৃষকেরা রোরুদ্যমান। উত্তরে নৈরঞ্জনাতীরে আজও স্থির সেই অশ্বত্থবৃক্ষ, যে বৃক্ষমূলে বসে শাক্যসিংহ বোধিলাভ করেছিলেন। পশ্চিমে সহস্রবাহুপুরীর সেই ছোট্ট তারা-চণ্ডী মন্দির, যেখানে শাক্যনাথকে দেবী অষ্টমবর্ষীয়া বালিকার বেশে দেখা দিয়েছিলেন। সংসার তাঁর শিক্ষার সার বুঝতে পারবে না ভেবে শাক্যকুলচক্রবর্তী যখন সংশয়াপন্ন, তারিণীই প্রথম তাঁর সন্দেহ নিরসন করে বলেছিলেন, “সারনাথ যাও। ধর্মচক্রে গতি আনো।” শাক্যমুনির প্রিয়তমা তিনি। জন্মজন্মান্তরের সহধর্মিণী। কিন্তু বুদ্ধ এক্ষণে ব্রহ্মচারী, প্রিয়া হয়ে ধরা দিলে কলঙ্ক লাগে তাই আত্মজা হয়ে ধরা দিলেন। অর্জ্জুন চোখ বুজে স্পষ্ট দেখতে পেল, মা শাক্যনাথকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। রোদে পোড়া হলুদ ঘাসে মায়ের সবুজ পা পড়ছে। বর্ষার মতো একটানা সুরে রুমঝুম নূপুরধ্বনি বাজছে। “মা! মাগো! তুমিই বুদ্ধের করুণার অশ্রুধারা! তোমায় আজ নালন্দার বড় প্রয়োজন।” চীবরে কষে গিঁট বেঁধে একগুল্ফোপরি তপোনর্তনভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আকাশপানে দুই হাত জুড়ে অর্জ্জুন গাইল কল্যাণত্রিংশতিকা স্তোত্র—
“যা দেবী সর্বসত্ত্বানাং সৃষ্টিসংহারকারিণী।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥
যা দেবী সর্বভূতানাং প্রতিপালে প্রতিষ্ঠিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥
যা দেবী দেবদেবীনাং দেবতারূপিণী স্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥
যা দেবী দৈত্যদুর্দান্তদাহরূপা ভয়ানকা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥
যা দেবী জলনাগাহিদুর্ভিক্ষভয়তারিণী।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥”
শারদ অমাবস্যার পর প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া করে একে একে ষষ্ঠী পার হয়ে গেল। দিন নেই, রাত নেই; মাতৃস্তব গাইতে গাইতে অর্জ্জুন অবিরাম নেচে চলেছে। তার নৃত্যঝঙ্কারেই প্রচণ্ডচণ্ডিকাকে জাগতে হবে। মা তার ডাকে সাড়া দিয়ে নালন্দায় বৃষ্টি নামাবেন, তবে সে ক্ষান্ত হবে। মা তার ভক্তি পরখ করতে এমনি প্রখর তাপ দিলেন যে জলাশয়ের শেষ বিন্দু জলটুকু মাটি শুষে নিল। পশুপাখি অর্ধমৃত হয়ে পড়ে রইল। গলা শুকিয়ে কাঠ হল, তবু অর্জ্জুনের স্তব স্তব্ধ হল না। নৃত্যে লেশমাত্র ছন্দপতন হল না। অবশেষে শুক্লা সপ্তমীর অপরাহ্ণে আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণে ঘন কালো মেঘ ছেয়ে এল। মহাবিহারের আবাসিকরা সব একযোগে ধন্য ধন্য করে উঠল। রাত্রে ঝোড়ো বাতাস ছাড়ল বজ্রাসনের দিক থেকে। গবাক্ষের কবাট খুলে রাহুলশ্রীভদ্র দেখলেন, রাজগৃহের সমস্ত বনাঞ্চল মুহুর্মুহু প্রবল আলোড়িত হচ্ছে। উদ্ভিদরাজি একত্রে আন্দোলিত হচ্ছে। বীটপে লতাগুল্ম আছাড়ি পিছাড়ি খাচ্ছে। অর্জ্জুন এখনো কল্যাণস্তুতি-সহকারে নাচছে, আর তার নৃত্যের তালে তালে স্বয়ং প্রলয়নৃত্যে মেতেছেন স্বমহিমায় জাগ্রতা মহারৌদ্রী। শূন্যরূপা বুদ্ধপ্রকৃতিই ঘোররূপা জগতপ্রকৃতি।
Medha-র আঁকায়, আমার লেখায়।
দেবী ত্বমেব গিরিজা কুশলা ত্বমেব
পদ্মাবতী ত্বমসি তারিণী দেবমাতা।
ব্যাপ্তং ত্বয়া ত্রিভুবনে জগদৈকরূপা
তুভ্যং নমোঽস্তু মনসা বপুষা গিরা নঃ॥
দেবী, তুমিই হিমালয়নন্দিনী; তুমিই কল্যাণী দাক্ষ্যায়ণী। তুমি পদ্মাবতী; ত্রাণকর্ত্রী; সর্বদেবজননী। সমস্ত জগত জুড়ে তুমি নিরবচ্ছিন্না নির্বিকল্পা অদ্বৈতের রূপে ব্যাপ্ত হয়ে আছো। তোমাকে কায়মনোবাক্যে নমস্কার।
যানত্রয়েষু দশপারমিতেতি গীতা
বিস্তীর্ণযানিকজনা জলশূন্যতেতি।
প্রজ্ঞাপ্রসঙ্গচটুলামৃতপূর্ণধাত্রী
তুভ্যং নমোঽস্তু মনসা বপুষা গিরা নঃ॥
শ্রাবক, প্রত্যেকবুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব যানত্রয়ে তুমি দশ পারমিতার অভিধায় বন্দিতা হও। শূন্যের বারিধিবক্ষে তুমিই একমাত্র প্রশস্ত নিস্তারনৌকা। প্রজ্ঞার অমৃতপূর্ণ কলস তুমিই ধারণ করো। তোমাকে কায়মনোবাক্যে নমস্কার।
আনন্দনন্দবিরসা সহজস্বভাবা
চক্রত্রয়াদপরিবর্তিতবিশ্বমাতা।
বিদ্যুদ্প্রভা হৃদয়বর্জ্জিতজ্ঞানগম্যা
তুভ্যং নমোঽস্তু মনসা বপুষা গিরা নঃ॥
নিরস নিরানন্দেও তুমি সতত আনন্দময়ী হয়ে বিরাজ করো। তুমি বুদ্ধহৃদয়ের অসংস্কৃতধর্মতা, নিষ্প্রপঞ্চস্বরূপা সহজা! ধর্মচক্রের আবর্তনত্রয়ে অনিত্যধর্মের প্রকাশকালেও তুমি জগদ্ধাত্রীর শাশ্বত আসনে অবিচলা ছিলে। ক্ষণপ্রভার মতো ক্ষণকালীন হয়েও চিরন্তনী তুমি, বাঙ্মনসগোচরাতীতা। তোমাকে কায়মনোবাক্যে নমস্কার।
কিমত্র বহুনা দেবি জল্পিতেন ময়া ননু
যদ্ যদা বাঞ্ছিতং সর্ব্বফলদাত্রী নমোঽস্তু তে॥
কীসেরই বা এত জল্পনা! হে ভগবতী, সংসারে ইচ্ছা হয়ে বিরাজমানা স্বয়ং তুমি; আবার সংসারীর মনষ্কামপূরয়িত্রীও সেই তুমিই। তোমার শরণেই সর্ববিধ তৃষ্ণার নিবৃত্তি।
The union of the ring finger and the thumb depicts the yabyum position of Prajna and Upaya; whereas the index finger alongwith the middle and the little ones stretched upwards symbolise the victory of triple jewels. Bhagavati Arya Tara holds this hand gesture near her left breast as a mark of reverence to Buddha-Dharma-Sangha accompanied by the supreme signature of Mahamudra.
Five days having passed since the new moon of Ashwin, the duration of entering into the Vajra Samadhi is almost over. In Bengal's Durga Puja, this prime moment is called 'Bodhon' - when yogis visualise the Mother Goddess in the form of clear light for first time. This evening, Vairochani would appear in Vajrasana from the space between the eyebrows of the Sage of the Shakyas, and descend in the loving compassionate clasp of sadhaka.
Before Bodhon, to my Ishta Devi, I pay homage.
বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীর অষ্টোত্তর শতনামে বুদ্ধ বলছেন,
লোকপালঃ সহস্রাক্ষ ঈশ্বরস্ত্বং প্রজাপতিঃ।
শিবস্ত্বং সর্বভূতানাং ত্বং বিভুর্গুণসাগরঃ॥
ঋষিত্বং পুণ্যঃ শ্রেষ্ঠশ্চ জ্যেষ্ঠো জাতিস্মরস্তথা।
বিনায়কো বিনেতা চ জিনপুত্রো জিনাত্মজঃ॥
ভানুঃ সহস্ররশ্মিস্ত্বং সোমস্ত্বং চ বৃহস্পতিঃ।
ধনদো বরুণশ্চৈব ত্বং বিষ্ণু্ত্বং মহেশ্বরঃ॥
অনন্তো নাগরাজস্ত্বং স্কন্দঃ সেনাপতিস্তথা।
হেমচিত্রাসুরেন্দ্রস্ত্বং ভৌমঃ শুক্রো বুধস্তথা॥
অর্থাৎ মঞ্জুশ্রীই বেদোক্ত সহস্রাক্ষ বিরাটপুরুষ, মঞ্জুশ্রীই ঈশ্বর। মঞ্জুশ্রী প্রজাপতি হিরণ্যগর্ভ, মঞ্জুশ্রীই সাক্ষাৎ শিব! মঞ্জুশ্রীই বিনায়ক গণপতি; মঞ্জুশ্রীই সহস্ররশ্মি সূর্য, সোম, দেবগুরু বৃহস্পতি। মঞ্জুশ্রী ধনরাজ কুবের, জলধিরাজ বরুণ; বিষ্ণুও মঞ্জুশ্রী, মহেশ্বরও মঞ্জুশ্রী। মঞ্জুশ্রী নাগরাজ— দেবসেনাপতি বীর স্কন্দ। মঞ্জুশ্রীই বুধ ও শুক্র; দেবাসুর সর্বমধ্যে অগ্রগণ্য।
বৌদ্ধের মঞ্জুশ্রী কুমারভূত, কুমারতত্ত্ব; দুর্গার বামপার্শ্বে কলাপীর উপর যাঁর অধিষ্ঠান। মঞ্জুশ্রীমূলকল্পে শাক্যমুনি তাঁকে ষড়মুখ কার্তিকেয় বলে সম্বোধন করেছেন। কলাপ ব্যাকরণ বা কাতন্ত্র ব্যাকরণ বৌদ্ধের মুখ্য ব্যাকরণ; স্বয়ং কার্তিক যে ব্যাকরণের আদিগুরু। তাই বজ্রযানে মঞ্জুশ্রী বাগীশ্বর; তাঁর পত্নী সরস্বতী। আবার সেই কারণেই মঞ্জুশ্রী আদি পরমেশ্বর ব্রহ্মাও বটে; বাঙ্ময় চৈতন্যময় জগতের সৃষ্টিকর্তা— কারণ তাঁরই মধ্যে আদ্য প্রণবাক্ষর সমাহিত।
কার্তিক শিবপুত্র; আবার কার্তিকই স্বয়ং শিব। মঞ্জুশ্রী বুদ্ধপুত্র, আবার মঞ্জুশ্রীই স্বয়ং বুদ্ধ। মঞ্জুশ্রীমূলকল্পে মঞ্জুশ্রী আদিবুদ্ধ। কার্তিকের বাহন যেমন নাগশত্রু ময়ূর, তেমন মঞ্জুশ্রীও নাগসঙ্কুল ধান্যকটক পর্বতে পূজিত দেবতা। তাই মঞ্জুশ্রী নাগরাজ। ধান্যকটক পর্বত নাগার্জ্জুনপাদের সাধনক্ষেত্র। 'নাগার্জ্জুন' নামের অর্থও তাই হয় : নাগরাজ। নাগার্জ্জুনের নাগলোকবিজয়ের গল্পের সাথে তদানীন্তন বিদর্ভ তথা অধুনা অন্ধ্রাঞ্চলে সুব্রহ্মণ্যের গল্পের প্রত্যক্ষ যোগ বর্তমান।
নাগার্জ্জুনপাদ নিজেই হরপার্বতীর পুত্র মঞ্জুশ্রী-স্কন্দ। তাঁর জীবনে বুদ্ধ শিব, আর্য্যতারা শিবানী। তিনি যতবারই বুদ্ধস্তব করেছেন, সেই স্তবে শিবনাম নিহিত করেছেন। আবার তিনি নিজেও শিব, কারণ পিতায় পুত্রে ন্যূনতম ভিন্নতা নেই। শিব আদিগুরু বলেই শিবপুত্র আদিগুরু; একইভাবে বুদ্ধ আদিগুরু বলেই বুদ্ধপুত্র আদিগুরু।
রোমাগ্রকূপবিবরে পরিবর্তমানং
বিশ্বপ্রপঞ্চকরণং সুগতাত্মজস্য।
ত্রৈবিদ্যমন্ত্র তব নাথ গুণার্ণবেণ
সূক্ষ্মায় বুদ্ধতনয়ায় নমোঽস্তু তস্মৈ॥
আজ শারদ নবরাত্রির পঞ্চমী, স্কন্দমাতার আরাধনার তিথি। চিরব্রহ্মচারী হৈমবতীনন্দন মঞ্জুশ্রী সকলকে প্রজ্ঞাহৃদয়ে উপনীত করুন।
ছবি :
১. বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী, গোনসার রিনপোচের আঁকা;
২. জন্মদাতা-কর্তৃক পূজিত স্কন্দদেব, অজন্তা আর্ট ক্যালেন্ডারে প্রকাশিত;
৩. নাগলোক বিজয়ের পর কুরুকুল্লার ধনুক ও প্রজ্ঞাপারমিতা পুঁথি হাতে নাগার্জ্জুন, এঁকেছে আমার বান্ধবী Medha Sinha;
৪. পুত্রকে প্রশিক্ষণরতা উমা, এঁকেছেন মাঙ্গল্য ঘোষ।
বরবারিজরুপি জগৎপ্রসরং সরসীরুহলোচনচারুতরম্
তরসাপি রসত্ববিশুদ্ধিপরং প্রণমে ধরণীশ্চরাজবরম্—!
কলকাতায় অজন্তা
আর্য শ্রী মহাদেবী ব্যাকরণে লোকেশ্বর-সকাশে শাক্যনাথ-কর্তৃক ব্যক্ত দেবীর অষ্টোত্তর শত নামাবলি।
শৃণু অভয়াবলোকিতেশ্বর শ্রিয়া মহাদেব্যা নামানি।
তদ্ যথা;
১. সর্বতথাগতাভিষিক্তা : সমস্ত তথাগতের দ্বারা অভিষিক্তা যিনি।
২. সর্বদেবতাভিষিক্তা : সর্ব দেবতার দ্বারা অভিষিক্তা যিনি।
৩. সর্বতথাগতমাতা : সর্ব তথাগতের জন্মদাত্রী যিনি।
৪. সর্বদেবতামাতা : সর্ব দেবতার জন্মদাত্রী যিনি।
৫. সর্বতথাগতশ্রী : সর্ব তথাগতের শ্রীসম্পদরূপিণী যিনি।
৬. সর্ববোধিসত্ত্বশ্রী : সর্ব বোধিসত্ত্বের শ্রীসম্পদরূপিণী যিনি।
৭. সর্বার্যশ্রাবকপ্রত্যেকবুদ্ধশ্রী : সর্ব আর্যশ্রাবক ও প্রত্যেকবুদ্ধের শ্রীসম্পদরূপিণী যিনি।
৮. ব্রহ্মবিষ্ণুমহেশ্বরশ্রী : ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের শ্রীস্বরূপা যিনি।
৯. মহাস্থানগতশ্রী : মহাস্থানগত, অর্থাৎ পরমার্থপ্রাপ্তের শ্রীস্বরূপা যিনি।
১০. সর্বদেবতাভিমুখশ্রী : দেবত্বপ্রাপ্ত সত্ত্বগণের শ্রীস্বরূপিণী যিনি।
১১. সর্বদেব-নাগ-যক্ষ-গন্ধর্বাসুর-গরুড়-কিন্নর-মহোরগশ্রী : সর্ব দেবতা, নাগ, যক্ষ, গন্ধর্ব, অসুর, গরুড়, কিন্নর ও মহোরগদের শ্রীরূপিণী যিনি।
১২. সর্ববিদ্যাধর-বজ্রপাণি-বজ্রধরশ্রী : সর্ব বিদ্যাধর, বজ্রপাণি ও বজ্রধরগণের শ্রীরূপা যিনি।
১৩. চতুঃপঞ্চলোকপালশ্রী : চতুর্দিকস্থ পঞ্চলোকপালদিগের শ্রীরূপা যিনি।
১৪. অষ্টগ্রহাষ্টাবিংশতিনক্ষত্রশ্রী : অষ্টগ্রহ এবং অষ্টাবিংশতি নক্ষত্রের শ্রী যিনি।
[ওঁ]
১৫. সাবিত্রী : বেদমাতা যিনি।
১৬. ধাত্রীমাতা : ধারণ করেন যে জননী।
১৭. চতুর্বেদশ্রী : চার বেদের অধিষ্ঠাত্রী ঐশ্বর্য্য যিনি।
১৮. লক্ষ্মী : (নারায়ণপত্নী)
১৯. ভূতমাতা : সর্বভূতের জন্মদাত্রী যিনি।
২০. জয়া : (দুর্গার নাম)
২১. বিজয়া : (দুর্গার নাম)
২২. গঙ্গা : পবিত্রতমা নদী।
২৩. সর্বতীর্থা : সর্বতীর্থে অধিষ্ঠাত্রী যিনি।
২৪. সর্বমঙ্গল্যা : (দুর্গার নাম) সবার মঙ্গলদায়িনী যিনি।
২৫. বিমলনির্মলকরশ্রী : সর্ব মালিন্য মোচনকারী তথাগতের ঐশ্বর্য্য যিনি।
২৬. সর্বপাপহন্ত্রী : সর্বপাপের বিনাশকারিণী যিনি।
২৭. নির্মদকরা : অহঙ্কার দূর করেন যিনি।
২৮. চন্দ্রশ্রী : চন্দ্রের জ্যোৎস্নারূপিণী শ্রী যিনি।
২৯. সূর্যশ্রী : সূর্যের তেজরূপিণী শ্রী যিনি।
৩০. সর্বগ্রহশ্রী : সর্বগ্রহের শ্রীরূপা যিনি।
৩১. সিংহবাহিনী : (দুর্গা) সিংহ যে দেবীর বাহন।
৩২. শতসহস্রকোটিপদ্মবিবরসমুৎপন্না : শত-সহস্র-কোটি পদ্মবিবর থেকে উদ্ভূতা হন যিনি।
৩৩. পদ্মা : (লক্ষ্মী ও মনসার নাম) পদ্মরূপিণী যিনি।
৩৪. পদ্মসম্ভবা : পদ্মে সঞ্জাতা যিনি।
৩৫. পদ্মালয়া : (লক্ষ্মী) পদ্মে নিবাসিনী যিনি।
৩৬. পদ্মধরা : (লক্ষ্মী) পদ্ম ধারণ করেন যিনি।
৩৭. পদ্মাবতী : (লক্ষ্মী, মনসা)
৩৮. অনেকরত্নাংশুমালা : বহু রত্নের জ্যোতিরূপিণী যিনি।
৩৯. ধনদা : (লক্ষ্মী) ধন দান করেন যিনি।
৪০. শ্বেতা : (সরস্বতী, দুর্গা) শুভ্রবর্ণা যিনি।
৪১. মহাশ্বেতা : (সরস্বতী, দুর্গা) অতীব শুভ্রবর্ণা যিনি।
৪২. শ্বেতভুজা : (সরস্বতী) শ্বেতবর্ণ হস্ত যে দেবীর।
৪৩. সর্বমঙ্গলধারিণী : সবার মঙ্গল ধারণ করেন যে দেবী।
৪৪. সর্বপুণ্যোপপিতাঙ্গী : সর্বপুণ্যরূপিণী পিতাঙ্গধারিণী যিনি।
৪৫. দাক্ষ্যায়ণী : দক্ষকন্যা, শিবজায়া সতী।
৪৬. শতসহস্রভুজা : শত সহস্র হস্ত যে দেবীর।
৪৭. শতসহস্রনয়না : শত সহস্র নয়ন যে দেবীর।
৪৮. শতসহস্রশিরা : শত সহস্র মাথা যে দেবীর।
৪৯. বিবিধবিচিত্রমণিমৌলিধরা : বিবিধ বিচিত্র মণি মুকুটে ধারণ করেন যে দেবী।
৫০. সুরূপা : সুরসুন্দরী যিনি।
৫১. বিশ্বরূপা : সমগ্র বিশ্বরূপিণী যিনি।
৫২. যশোধরা : (শাক্যমুনির অর্ধাঙ্গিনী) যশ ধারণ করেন যিনি।
৫৩. মহাযশা : মহাযশস্বিনী যিনি।
৫৪. সৌম্যা : সৌম্য রূপ যে দেবীর।
৫৫. বহুজীমূতা : বহু মেঘে ঘনীভূতা যিনি।
৫৬. পবিত্রকেশা : পবিত্র কেশ যে দেবীর।
৫৭. চন্দ্রকান্তা : চন্দ্রের পত্নী যিনি।
৫৮. সূর্যকান্তা : সূর্যের পত্নী যিনি।
৫৯. শুভা : শুভময়ী যিনি।
৬০. শুভকর্ত্রী : শুভকারিণী যিনি।
৬১. সর্বসত্ত্বাভিমুখী : সর্বসত্ত্বে অভিমুখী, অর্থাৎ কৃপাদৃষ্টিদাত্রী।
৬২. আর্যা : সম্মানার্থ সম্বোধন (দুর্গার নাম)
৬৩. কুসুমশ্রী : ফুলের সৌন্দর্য যিনি।
৬৪. কুসুমেশ্বরা : সর্ব ফুলের প্রধানা ঈশ্বরী যিনি।
৬৫. সর্বসুমেরুপর্বতরাজশ্রী : সমস্ত কল্পে কৈলাস পর্বতের সম্রাজ্ঞী যিনি।
৬৬. সর্বনদীসরিৎশ্রী : সমস্ত নদী-জলধারায় প্রাণের প্রবাহরূপিণী যিনি।
৬৭. সর্বতোয়সমুদ্রশ্রী : সর্ব জলধির বিশালতারূপিণী যিনি।
৬৮. সর্বতীর্থাভিমুখশ্রী : সমস্ত তীর্থে আধাররূপিণী যিনি।
৬৯. সর্বৌষধিতৃণবনস্পতিধনধান্যশ্রী : সমস্ত ঔষধি তৃণ, বনস্পতি, ধনধান্যে উপস্থিত ঐশ্বর্য্য যিনি।
৭০. হিরণ্যদা : (লক্ষ্মী) হিরণ্য, অর্থাৎ স্বর্ণ দেন যিন।
৭১. অন্নপানদা : (অন্নপূর্ণা, দুর্গা) অন্ন ও পানীয় দেন যিনি।
৭২. প্রভাস্বরা : প্রভায় ভাস্বর যিনি, আভাস্বর চক্রে যাঁর অধিষ্ঠান।
৭৩. আলোককরা : আলোকিত করেন যিনি।
৭৪. পবিত্রাঙ্গা : পবিত্র অঙ্গ যে দেবীর।
৭৫. সর্বতথাগতবশবর্তিনী : সর্ব তথাগতের বশ্যতা স্বীকার করেছেন যিনি।
৭৬. সর্বদেবগণমুখশ্রী : সর্ব দেবতা ও গণের প্রমুখের শক্তি যিনি।
৭৭. যম-বরুণ-কুবের-বাসবশ্রী : যম, বরুণ, কুবের ও ইন্দ্রের শক্তি যিনি।
৭৮. দাত্রী : দান করেন যে দেবী।
৭৯. ভোক্ত্রী : ভোগ করেন যে দেবী।
৮০. তেজা : তেজরূপিণী যিনি।
৮১. তেজোবতী : তেজ ধারণ করেন যিনি।
৮২. বিভূতি : বিয়োগ, অর্থাৎ অনিত্যতারূপিণী যিনি।
৮৩. সমৃদ্ধি
৮৪. বিবৃদ্ধি
৮৫. উন্নতি
৮৬. ধর্মশ্রী : ধর্মের শ্রী যিনি।
৮৭. মাধবাশ্রয়া : মাধব, অর্থাৎ মায়ের স্বামী। প্রচলিত অর্থে, নারায়ণ। নারায়ণের আশ্রয়রূপিণী, অর্থাৎ লক্ষ্মী।
৮৮. কুসুমনিলয়া : পুষ্পে বাস করেন যিনি।
৮৯. অনসূয়া : ঈর্ষাহীনা যিনি।
৯০. পুরুষকারাশ্রয়া : পুরুষার্থের আশ্রয়রূপিণী শক্তি যিনি।
৯১. সর্বপবিত্রগাত্রা : সমস্ত গাত্র পবিত্রা যাঁর।
৯২. মঙ্গলহস্তা : মঙ্গলার্থে হস্ত প্রদর্শন করেন যিনি।
৯৩. সর্বালক্ষ্মীনাশয়িত্রী : সমস্ত অলক্ষ্মীর বিনাশকর্ত্রী যিনি।
৯৪. সর্বপুণ্যাকর্ষণশ্রী : সমস্ত পুণ্যের আকর্ষণে উৎপন্না সৌন্দর্য যিনি।
৯৫. সর্বপৃথিবীশ্রী : সমস্ত পৃথিবীর শ্রী যিনি।
৯৬. সর্বরাজশ্রী : সকল রাজার শ্রীসম্পদরূপিণী।
৯৭. সর্ববিদ্যাধররাজশ্রী : সমস্ত বিদ্যাধররাজের শক্তিরূপিণী।
৯৮. সর্বভূত-যক্ষ-রাক্ষস-প্রেত-পিশাচ-কুম্ভাণ্ড-মহোরগশ্রী : সমস্ত ভূত, যক্ষ, রাক্ষস, প্রেত, পিশাচ, কুম্ভাণ্ড, মহোরগের শ্রী যিনি।
৯৯. দ্যুতি : আলোকচ্ছটারূপিণী যিনি।
১০০. প্রমোদভাগ্যলোলা : সৌভাগ্য প্রকটকারিণী।
১০১. সর্বর্ষিপবিত্রশ্রী : সকল ঋষির পবিত্রতার সৌন্দর্যরূপিণী।
১০২. সর্বশ্রী : সর্ববিধ সৌন্দর্যস্বরূপিণী।
১০৩. ভবজ্যেষ্ঠোত্তমশ্রী : ভবজ্যেষ্ঠ, অর্থাৎ বুদ্ধ। ভবজ্যেষ্ঠোত্তমের শ্রী যিনি।
১০৪. সর্বকিন্নরসর্বসূর্যোত্তমশ্রী : সর্ব কিন্নর, সর্ব সূর্যের অগ্রগণ্যের শ্রী যিনি।
১০৫. নিরবদ্যস্থানবাসিনী : নিষ্কলুষ স্থানে নিবাসিনী।
১০৬. সুখকরী : সুখ দান করেন যে দেবী।
১০৭. কুবেরকান্তা : ধনেশ্বরের পত্নী, বৌদ্ধ মতে বসুধারা।
১০৮. ধর্মরাজশ্রী : ধর্মরাজ বুদ্ধ স্বয়ং, সেই বুদ্ধের শ্রীরূপিণী।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা ব্রহ্মকমল-কে।
মহামায়া তন্ত্রে সদাশিব বজ্রধর বলছেন :
যথা ব্যাপ্তমিদং সর্বং ব্রহ্মাণ্ডং সচরাচরম্।
উৎপত্তিঃ সর্বদেবানাং ব্রহ্মাদীনাং মহর্দ্ধিকা॥
অর্থাৎ, যাঁর দ্বারা সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড-চরাচর পরিব্যাপ্ত হয়েছে; যিনি ব্রহ্মাদি সর্বদেবতার উৎপত্তির কারণ, সর্বঋদ্ধিকারিণী, তিনিই মহামায়া।
অতীশ দীপঙ্করের সময়ের বিক্রমশীলা মহাবিহারের মঠাধ্যক্ষ রত্নাকরশান্তিপাদ মহামায়া তন্ত্রের উপর 'গুণবতী' নামক টীকা রচনা করেছিলেন। সেই টীকায় রত্নাকরশান্তি লিখেছেন,
বৃহ বৃহি বৃদ্ধৌ, মনিন্। নৈরুক্তো বর্ণবিকারঃ।
এবং ব্রহ্মেতি ভবতি। ইহ তু সর্বলোকগুরুত্বাৎ সর্বতো বৃদ্ধা ইতি ব্রহ্মাণস্তথাগতাঃ সম্ভোগনির্মাণকায়াসংগৃহীতাঃ।
তেষামণ্ডমুৎপত্তিস্থানম্, ধর্মকায় ইত্যর্থঃ।
অথবা মোক্ষাতিশয়ত্বাদ্ ব্রহ্ম চ তৎ কায়দ্বয়োৎপত্তিস্থানত্বাদণ্ডশ্চেতি ব্রহ্মাণ্ডং ধর্মকায় ইত্যর্থঃ।
পরিশুদ্ধেষু বুদ্ধক্ষেত্রেষু যঃ সত্ত্বলোকঃ, সোঽত্র চরঃ,
যস্তেষু ভাজনলোকঃ, সোঽত্রাঽচরঃ।
সহ তাভ্যাং বর্তত ইতি সচরাচর ব্রহ্মাণ্ডম্।
তদ্যথা ব্যাপ্তমিতি সম্বন্ধঃ।
সকলমিতি সর্বম্, সর্বতথাগতমিত্যর্থঃ।
তত্র কথং ব্রহ্মাণ্ডং তথা ব্যাপ্তম্?
যস্মাৎ তন্মময়মেব সর্ববুদ্ধানাং ব্রহ্মাণ্ডম্।
কস্মাগারাচরৌ লোকৌ তয়া ব্যাপ্তৌ?
তদুদ্ধবত্বাৎ তয়োঃ।
এতদেবাহ— উৎপত্তিরিত্যাদিনা।
উৎপত্তিঃ কারণম্।
সর্বদেবানামিতি পঞ্চানাং কুলডাকিনীনাম্,
ব্রহ্মাদীনামিতি পঞ্চানাং তথাগতানাম্
উত কুলানাং চ প্রত্যেকমনন্তানাম্।
মহর্দ্ধিকেতি মহাপ্রভাবা।
যিনি বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি; তিনিই বুদ্ধ। নিখিল ব্রহ্মাণ্ড সেই আদিবুদ্ধের ধর্মকায়া। ‘চর’ অর্থ পরিশুদ্ধ বুদ্ধক্ষেত্র; অর্থাৎ নির্বাণ। ‘অচর’ অর্থ ভাজনলোক; অর্থাৎ ভোগ্য জগৎ। অতএব সচরাচর ব্রহ্মাণ্ডের অর্থ দাঁড়াল— জগৎ ও নির্বাণ সহ আদিবুদ্ধের অবাঙ্মনসগোচর ধর্মকায়া। আমাদের গোচরাগোচর যাবতীয় ধর্মাবলী সেই ব্রহ্মেরই অন্তর্ভুক্ত। এবং সেই নিখিল ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ব্যাপ্তা যে শূন্যা প্রকৃতি; যাঁর দ্বারা সমগ্র চরাচর বিশ্বসংসার তন্ময়; তিনিই মহাপ্রভাবা মহামায়া। ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবগণের, অর্থাৎ পঞ্চ তথাগত ও তাঁদের ডাকিনীগণের জন্মদাত্রী তিনিই।
তাসাং পরমিয়ং গুহ্যং মহামায়া মহেশ্বরী।
মহামায়া মহারৌদ্রা ভূতসংহারকারিণী॥
যথা ব্যাপ্তং চ সকলং ত্রৈলোক্যং সচরাচরম্।
সৈষা সংহরতে বিশ্বং সৃজতে সা পুনঃ পুনঃ॥
গুহ্যকানামিয়ং মাতা মহামায়েতি বিশ্রুতা।
ত্রৈলোক্যসাধনী বিদ্যা সর্বকামপ্রদায়িকা॥
যথা বিজ্ঞানমাত্রেণ সাধকেশ্বরীবিদ্যয়া।
দেবদানবগন্ধর্বা যক্ষাসুরনরাশ্চ যে॥
বিদ্যাধরা গুহ্যকাশ্চ কিন্নরাশ্চ মহোদরাঃ।
রাক্ষসাশ্চ পিশাচাশ্চ সিদ্ধয়ন্তে সাধকেষু বৈ॥
বশ্যানি সর্বভূতানি জলজস্থলজানি চ।
প্রকৃতিপ্রভাস্বরা ধর্মা আদিশুদ্ধা হ্যনাবিলাঃ॥
তিনিই পরমা গুপ্তা তত্ত্ব, মহামায়া মহেশ্বরী। তিনিই চণ্ডরূপে মহারৌদ্রী, সর্বভূতের সংহারকারিণী। তিনিই বারম্বার সংসার ধ্বংস করেন, আবার সৃষ্টিও করেন। তিনিই সর্বসাধকের কাঙ্ক্ষিতা সেই বিশ্রুতা মহাবিদ্যা, সর্বকামনার পূরয়িত্রী। তাঁর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলে দেব, মানব, দানব, গন্ধর্ব, যক্ষ, অসুর, বিদ্যাধর, গুহ্যক, কিন্নর, মহোদর, রাক্ষস, পিশাচ, জলজ, স্থলজ, সমস্ত সত্ত্ব সাধকের বশ্য হয়।
তিনি আদিশুদ্ধা অনাবিলা বুদ্ধস্বভাব। তাই তিনি মহামায়া হয়েও মায়া নন; বরং মহাসত্য। রত্নাকরশান্তির ব্যাখ্যায়—
প্রকৃতির্নিজঃ স্বভাবঃ, তথা প্রভাস্বরাঃ প্রভাসনশীলাঃ, প্রকর্ষেণ নির্মলা ইত্যর্থঃ। নারোপার ছয় যোগের অন্যতম প্রভাস্বর যোগ, যে যোগে স্বয়ং অর্কদীপ্তা বৈরোচনী দৃষ্ট হন। বেদে তিনিই গায়ত্রী। শাক্যমুনির সিংহশরীর থেকে বিকীর্ণ আলোকচ্ছটার নামও প্রভাস্বর। তাঁর হৃদয়ে মহামায়ার বাস, তাই প্রভাস্বরমণ্ডল তাঁকে সতত ঘিরে রাখে।
কে পুনস্ত ইত্যাহ। ধর্মা ইতি। স্বলক্ষণধারণা ধর্মাঃ, সর্ববস্তুনীত্যর্থঃ। তানি পুনঃ সর্ববস্তুনি চিত্তমাত্রাণি, চিত্তস্যৈব তেন তেনাকারেণ প্রতিভাসনাৎ। ধর্ম কী? বস্তুর স্বভাবকে বলা হয় ধর্ম। এবং বস্তুর সংজ্ঞা কী? চিত্তমাত্রায় উৎপন্ন প্রতিবিম্ব। জগতের সমস্ত ধর্ম প্রতিবিম্বিত হয় আমাদের চিত্ত থেকে, তাই ধম্মপদে শাক্যকেতু বলেছেন, মনই সমস্ত ধর্মের অগ্রবর্তী; মনো পুব্বাঙ্গমা ধম্মা।
বৌদ্ধ দর্শনে শূন্যতাই একমাত্র স্বভাব, অপরাপর সমূহ সংস্কার পরভাব। পরিবর্তনশীল জগতে সদ্বস্তু কিছুই নেই; তাই জগদ্প্রকৃতি শূন্য। মধ্যমক অদ্বয়বাদে সর্ব ধর্ম শূন্য। প্রতীত্যসমুৎপাদের হেতুসম্পর্ক শূন্য। সৃষ্টি শূন্য, সংহার শূন্য, শূন্যই একমাত্র সত্য। আমরা যা দেখি, যা ভাবি, সব মায়া মাত্র। তাই বুদ্ধডাকিনী মহামায়া। প্রজ্ঞাপারমিতাহৃদয়ে শাক্যনাথ বলছেন, "ইহ শারিপুত্র সর্বধর্মাঃ শূন্যতালক্ষণা, অনুৎপন্না, অনিরুদ্ধা, অমলা, অবিমলা, ন ঊনা, ন পরিপূর্ণাঃ…" অর্থাৎ সেই আদি শূন্যপ্রকৃতির উৎপত্তি নেই, নিরোধও নেই; আবিলতাও নেই, অনাবিলতাও নেই; ক্ষয়সম্ভবনাও নেই, পরিপূর্ণতাও নেই। তাঁর সম্পর্কে যত প্রকার সংস্কৃত ধারণা মদীয় চিত্তে উৎপন্ন হতে পারে, সবই নেতি নেতি। তিনি ব্যক্ত হয়েও চির-অব্যক্ত, তাই সব ধারণা ভাসিয়ে দেওয়াই তাঁর কোলে পৌঁছবার একমাত্র পথ।
থাঙ্কা সৌজন্যে : Chhandak Jana Art
Click here to claim your Sponsored Listing.
Videos (show all)
Category
Contact the public figure
Website
Address
Chakdaha
Chakdaha
''a thing of beauty is a joy forever'',,,,,,by John keats