S.S Zoon

গল্প পড়তে ভালোবাসি, যারা গল্প পড়তে ভালোবাসেন আমার পেজে লাইক ফলে দিয়ে রাখবেন ❤️❤️❤️❤️❤️

31/12/2022

#ফাল্গুনের_রংধনু
#পর্বঃ০৮
রুবাইদা ইসলাম

সচ্ছ আকাশ।স্পষ্ট প্রকৃতি। রোদের তাপে মিষ্টতা ছুয়ে যাচ্ছে গা।পায়ের কদম কিছুটা কম।মেহু গলির মাথায় বড়ো রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। কনা শিলার প্রথম ক্লাস নেই বলে ওরা আরো কিছু সময় পর বের হবে তার উপরে কনার আজ রান্না ছিলো বলে এখনো সব শেষ করে উঠতে পারেনি। যে জন্য মেহুকেও খালি পেটেই বেরুতে হয়েছে।মেহু গলির মুখে দাঁড়িয়ে থেকে চোখে এদিক ওদিক তাকায় রিক্সা নামক তিন চাকার বাহনের জন্য। তবে ও ভালো করেই যানে এখানে দাঁড়িয়ে কোনো লাভ নেই। এমনিতেই এখানে রিক্সা পাওয়া যায় না তার উপরে এই সময়টা অফিস টাইম হওয়ায় আরো বেশি সোনার হরিন হয়ে দাঁড়ায়।তবে গায়ের জোর খানিকটা কম থাকা মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মেহু।নয়তো অন্য সময় হলে পায়ে পায়ে ভার্সিটি চলে যেতো।মেহু ভেবে সময় পার না করে পা বাড়ায়

- মামা যাইবেন?

কথাটা শুনেই মেহু চট করে ঘুরে দাঁড়ায়। ওর পাশ ঘেসে একটা রিক্সা দাঁড়িয়ে আর তার ড্রাইভার এর মুখে এমন কথা শুনে মেহুর চোখ চরক গাছ।যেখানে হাজার খুজেও রিক্সার দেখা মেলেনা সেখানে যেচে এসে ওকে বাহনের সহচরী বানাতে চাইছে।

- কি মামা যাইবেন?

মেহু এমন সুযোগ পেয়ে হাত ছাড়া করতে মোটেও রাজি না তবে ভাড়াটা ঠিক করে ওঠাটা বাঞ্ছনীয় বলে বাড়ার কথা তুলতেই রিক্সা ওয়ালা রেগুলার ভাড়ার কথা বলতেই মেহু রিক্সায় উঠে বসে। ঘুরতে শুরু করে তিন চাকার সোনার হরিন। আর কিছুটা দূরে তৃপ্তিময় দৃষ্টি নিয়ে চোখে কেও হাসে।

ভার্সিটির গেটে আসতেই চঞ্চল তিন চাকা স্থির হয়।মেহু রিক্সা থেকে নেমে ব্যাগ হাতরে ভাড়ার টাকা বের করতে।কিন্তু মেহুকে অবাক করে রিক্সাওয়ালা হুট করে রিক্সার দিক পরিবর্তন করেই এক ছুটে সামনে এগিয়ে চলে।মেহু রিক্সা চলতেই বার বার থামতে বললেও থামাতো দূর নিমেশেই উধাও হয় মেহুর দৃষ্টি সীমানা থেকে।মেহু বার কয়েক ডেকে বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।সেধে নিয়ে এসে আবার ভাড়া না নিয়েই উধাও হওয়া সব কিছুই মেহুর মাথার উপর দিয়ে যায় তবে বোকার মতো কিছু সময় গেটের স্থির দাঁড়িয়ে থেকে ঘুরে সোজা গেট গলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।কনা শিলা না থাকায় একাই নিজের ডিপার্টমেন্ট এর দিকে গুটি গুটি পা বাড়ায়। সেই দিন ওই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার পর মাঝে কেটে গেছে ৪ দিন। এই কয় দিন ও ভার্সিটিরতে আসেনি।নিজের মাঝে কিছুই অস্বস্তি কাজ করলেও কারো ওর প্রতি কোনো আগ্রহ না দেখে চুপ চাপ নিজের ক্লাসের দিকে পা এগোয়। তবে মাথা নিচু রেখেও অস্বস্তিতার কারনে চোখ এদিক সেদিক করায় ব্যস্ত মেহু।তবে ওকে নিরাশ করে কেও ওর প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায় নি। ক্লাসে ঢুকে কয়েকটি বেঞ্চ পেরুতেই পরিচিত গলা শুনে মাথা তুলে তাকায়

- এখানে বসো

তিশার কথা শুনে মেহু মুচকি হেসে তিশার পাশে বসে পরে

- এখন শরীর ঠিক আছে তোমার

তিশার প্রশ্নের উত্তরে মেহু অধর গলিয়ে কিছু না বলে মাথা কাত করে সম্মতি প্রকাশ করে।মেহুকে চুপ থাকতে দেখে তিশাও যেচে আর কিছু না বলে চুপ থাকে।সামান্য সময় যেতেই ক্লাসে শিক্ষক এর আগমন ঘটে ব্যস্ত হয় সকলে শেখার বিস্তারে।সময় গড়ায় শিক্ষক এর পড়া শ্রবণে।এর মাঝেই হঠাৎ পিয়ন এসে হাজির। হুমায়রা মেহরোজ কে ডেকে পাঠিয়েছে প্রিন্সিপাল স্যার। কথাটা বলেই পিয়ন বিদেয় নিলেও ক্লাস মেতে ওঠে চাপা গুঞ্জনে।তবে ক্লাসে তখন অবদি শিক্ষক উপস্থিত থাকায় অল্পেই তার পরিসমাপ্তি ঘটে। আরো কিছু সময় লেকচার দিয়ে বিদেয় হয় শিক্ষক।স্যার বেরিয়ে যেতেই ক্লাসে শিলা প্রবেশ করে।মেহুর পাশে বসতেই মেহুকে উঠে দাঁড়াতে দেখে ভ্রু সংকুচিত করে নেয় শিলা।

- প্রিন্সিপাল স্যার ডেকেছে ওকে

তিশার কথায় শিলা চট করে মেহুর দিকে তাকায়। মেহুর মুখ দোটানা ভাব দেখে কিছুটা অস্বস্তিতে পরে

- তোকে কেনো ডাকলো স্যার?

- আমি কেমনে কমু?আমিতো নিজেই বুঝতাছিনা আমারে কেন ডাকলো?

মেহুর কথায় স্পষ্ট দুশ্চিন্তা দেখে শিলা পুনরায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বেঞ্চে সবে মাত্র রাখা ব্যাগটা পুনরায় কাঁধে তুলে মেহুকে বেরুতে সুযোগ দিয়ে সরে দাঁড়ায়।

- চল, আমিও তোর সাথে যাই।দেখি কেনো ডেকেছে?

- তোর দি এহন ক্লাস আছে

- কিছু হবেনা চল দেখি

শিলার কথা শেষ হতেই মেহু সামনে পা বাড়ায়। শিলাও মেহুর পায়ে পা মেলায়।প্রিন্সিপাল স্যার এর কেবিনের সামনে দাড়াতেই পিয়ন মেহুর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে ভিপির কাছে যেতে।মেহু অবাক হয়ে পিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকে।কি ব্যাপার বা কিসের কাগজ? কিছুই ওর মাথায় ঢোকেনা।এর মাঝেও শিলা পাশ থেকে মেহুর হাতে থাকা কাগজটা নিয়ে তাতে চোখ বুলায়।শিলার চোখ চরখ গাছ।মেহুর ভার্সিটি হলের থাকার কাগজ।শিলা বিস্ময় নিয়ে মেহুর দিকে তাকায়। শিলা আর কনা মেহুর আগে ভর্তি হয়েছে এবং হলের থাকার জন্য আগে আবেদন করেছে ওদের কিছু হলোনা আর মেহু আসতে না আসতেই সীট পেয়ে গেলে।

- এইডা কিসের কাগজ??

- তুই হলে সীট পেয়ে গেছিস

শিলার কথা শুনে মেহু স্বাভাবিক ভাবে ওদের কথাও যানতে চায়।কিন্তু শিলা বা কনা সীট পায়নি শুনে মুখটা মলিন করে ফেলে।কিন্ত শিলার চোখে মুখে তখনো বিস্ময়। তবে মেহু খুব স্বাভাবিক।খুব অল্প সময়ে সীট পেয়ে গেছে সেটাই ওর কাছে খুশির বিষয়। ওর বাড়ির অবস্থা এতোটাও ভালো না যে বাইরে বাসা নিয়ে থাকার খরচ বহন করবে। তাই হলে ওঠাটা ওর জন্য খুব জরুরি ছিলো। মেহুর কথায় নিজের বিস্ময় আড়াল করে ভিপির কেবিনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় দু জনে।

ভার্সিটিতে ঢুকেই নিজের কেবিনে এসে পায়ের উপর পা তুলে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ওর হাতে থাকা ফাইলে আটকে থাকা এডমিশন ফর্ম এর দিকে। ফর্ম এর উপরে এক কোনে থাকা ছোট্ট ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে অধরে ঝুড়ে খেলা করে এক চিলতে হাসি।চোখে মুগ্ধতা।নামের যায়গায় হুমায়রা মেহরোজ দেখে চোখ গভীর হয়। মস্তিষ্ক জুড়ে ছুটে বেড়ায় কিছু মনে করার তাগিদ। সামান্য সময় যেতেই ঝিলিক দিয়ে ওঠে গভীর চোখ।অধর গলিয়ে বেড়িয়ে আসে হুমায়রা মেহরোজ -রক্তিম চাঁদের টুকরা।

নিরব কেবিনে দুইজন মানুষের উপস্থিতি থাকলেও নেই কথার উপস্থিতি। তবে রাফিদ এর মুখ থেকে রক্তিম চাঁদের টুকরা শুনতেই চোখ কুচকে নেয় রাফিদের সামনে বসা নিঝুম।কয়েকদিন যাবত বন্ধুর হঠাৎ পরিবর্তন ওর চোখ এড়ায়নি। তবে এই পরিবর্তন এর পেছনের কারন ও ওর অজানা না।নিঝুম তখন ও নিরব থাকে। মেহরোজ নামের মেয়েটির মাঝে বিশেষ কিছুতো আছেই। যার কারনে রাফিদ নামের পাহাড় ও নড়ে গেছে।নিঝুম মুচকি হাসে। তবে সেটা রাফিদের চোখ এড়িয়ে।ছেলেটা ভার্সিটিতে ঢুকেই মেহরোজ এর এডমিশন ফর্ম এনে ওর জন্য হলে বেছে গুছে সীট ঠিক করে প্রিন্সিপাল এর রুমে পাঠিয়েছে অনুমোদন এর জন্য। আর রাফিদ পাঠানো মানেই প্রিন্সিপাল চোখ বুঝে তাতে সাইন করে দিবে। এছাড়াও সকালে উঠে ওকে নিয়ে ছুটেছে রিক্সার গেরেজে। গেরেজের মালিকের সাথে মোটা অংকের টাকায় মেহরোজ এর ভার্সিটিতে আসা যাওয়ার জন্য রিক্সা ঠিক করে পুনরায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে মেহরোজ নামের ভালা লাগার গেটের সামনে।নিঝুম রাফিদের সাথে সাথ দিলেও রয়েছে চুপ। না কোনো প্রশ্ন করেছে আর না নিজের কৌতুহল প্রকাশ করেছে। কারন সব কিছুই উত্তর রাফিদের চোখে স্পষ্ট যেটা পড়তে নিঝুমের সময় লাগেনি। কেবিনের নিরবতা ভাঙে মেয়েলী মিষ্ট ভাষায়। টনক নড়ে নিঝুমের। ভাটা পরে ভাবনায়। চট করে তাকায় রাফিদ এর দিকে। কিন্তু রাফিদের মাঝে নেই কোনো তাড়া। সে আগের ন্যায় ফাইল দেখতে ব্যস্ত। পুনরায় মেয়েলী কন্ঠ শুনে রাফিদ নিঝুমের দিকে তাকায়। নিঝুমের বুঝতে বাকি থাকেনা রাফিদ এর চোখের ভাষা। নিঝুম উঠে দাঁড়ায়।দ্বিতীয় কন্ঠের মানুষটা কে সেটা দেখতে চেয়ার ছাড়ে। কেবিনের দরজার কাছে এসে ভাড়ি পর্দা সরারেই মেহুর পাশে আরো একজনকে দেখে মস্তিষ্কে চাপ বাড়ায়। কিভাবে ওকে এখান থেকে সরাবে সেই ভাবনায় কিছু সময় মস্তিষ্ক খাটালেও কোনো লাভ হয়না

- ভাইয়াকি ভেতরে আছে? আমরা একটু কাজে এসেছিলাম

- কি কাজ?

- ও হলে সীট পেয়েছে সেই বিষয়ে আর কি

শিলার কথা শুনে নিঝুম মেহুর হাতে থাকা কাগজটা নিয়ে চোখ বুলায়। যদিও বা এই কাগজটা ও নিজেই প্রিন্সিপাল স্যার এর কেবিনে পাঠিয়েছিলো।

- তোমাদের কি ক্লাস আছে?

- ওর নেই,আমার আছে।কেনো?

- তাহলে তুমি ক্লাসে যাও ও বসুক। রাফিদ একটু ব্যস্ত। হাতে কাজ আছে একটু বসতে হবে। ক্লাস মিস করে বসে থাকা লাগবেনা

- না না ঠিক আছে। আমার ক্লাস নাই। আমি বইতে পারমু

- না,একটা ক্লাস না করলে কিছু হবেনা। আমিও থাকছি এখানে

- কোনো প্রয়োজন হবে না। ক্লাস মিস দিয়ে এখানে বসে থাকছো শুনলে রাফিদ রেগে যাবে তুমি যাও। এটা ভিপি হলেও রাফিদ এর কেবিন। আশা করছি আর কিছু বলতে হবেনা

নিঝুমের এমন কথায় শিলা ওর অধর গলিয়ে কিছু বলার ভাষা খুজে পায় না। আর যেখানে রাফিদ মেহুকে ওমন একটা বিপদ থেকে রক্ষা করেছে সেখানে শিলার এতো ভয়ের যে কোনো কারন নেই সেটাও ওর যানে। তাছাড়া রাফিদ নামের মানুষটার সম্পর্কে এক আদটু শিলার জানা। শিলা আর কোনো কথা বাড়ায় না। মেহুকে কাজ শেষ হলে ক্লাসে যেতে বলেই নিজে ক্লাস এর উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। শিলা চলে যেতেই মেহু ঘুরে নিঝুমের দিকে তাকায়।

মেহুর তাকানো দেখে নিঝুম মুচকি হাসে। গ্রামীণ ভাষার সাথে মেয়েটার মিষ্টি কন্ঠ শুনলেই কেমন একটা ভালোলাগা ছুইয়ে যায়। অতি দুধে আলতা গায়ের বরন না হলেও চাপা রংয়েই পুরো মুখ ঝুড়ে মায়া আর মায়া। এই মুখে তাকালে মায়ায় বড্ড টানে।নিঝুম হাতের ইশারায় মেহুকে ভেতরে যেতে বলে। নিঝুমের ইশারায় মেহু দরজার পর্দা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। খুব পরিপাটি ভাবে গুছানো কেবিন।কেবিন ঝুড়ে মিষ্টি কাচা লেবুর ঘ্রাণ। সামনে টেবিলের ওপাশে বসে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু দেখতে ব্যস্ত রাফিদ। নিজের ব্যস্ততার মাঝেই হাতের ইশারায় বসতে বলতে মেহু একটা চেয়ার টেনে বসে পরে। তবে রাফিদ তখন হাতে থাকা ফাইলে ব্যস্ত। সময় গড়ায়। পিন পিনে নিরবতায় ছেয়ে আছে কেবিন। মেহু রাফিদের ব্যস্ততা মাঝেই চোখের নড়াচড়া কেবিনের সব কিছু একবার দেখে নিয়েছে। এর পর সামনে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকায়। যতবারি মেহু রাফিদকে দেখেছে কালো পোশাকেই দেখেছে। ফর্সা গায়ে কালো বেশ ভালো মানায়। তবে রাফিদ এর সৌন্দর্যে সব রং এর মানাবে।

- আমাকে না গিলে হাতে থাকা কাগজটা দেও

নিজের উদ্ভট ভাবনার মাঝে হঠাৎ এমন কথা শুনে মেহু লজ্জায় দৃষ্টি নত করে। মনে মনে নিজেকে গালাগালি দিয়েও রক্ষা নেই। হাত বাড়িয়ে নিজের হাতে থাকা কাগজটা রাফিদের কাছে দেয়। রাফিদ নিজের হাতে থাকা ফাইলয়া টেবিলে রেখে মেহুর দেয়া কাগজটায় নীলে ডোবানো সিলমোহর লাগিয়ে সাইন করে দেয়। কাগজটা ফিরিয়ে দিতেই মেহুকে কাচুমাচু করতে দেখে ভ্রু সংকুচিত করে নেয়। মেহুর দিকে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকাতেই মেহু আমতা আমতা করে বলে

- আমার সাথে শিলা আর কনার জন্য কি সীট দেয়া যায়না?

রাফিদ কিছু সময় তাকিয়ে থাকে মেহুর দিকে। অধর গলিয়ে কিছু না বলে টেবিলের ড্রয়ার খুলে আরো দুটো কাগজ বের করে তাতেই নীলে ডোবানো সিলমোহর লাগিয়ে এক সাথে তিনটি কাগজ মেহুর দিকে এগিয়ে দেয়। মেহু কিছুটা বিস্ময় নিয়ে রাফিদের হাত থেকে কাগজ গুলো নিয়ে তাতে চোখ বুলায়। এবার ও বিস্ময় চট করে মাথায় চড়ে বসে। চোখ সরে কাগজ থেকে। রাফিদের দিকে অবাক চোখে তাকায়। সামনে বসে থাকা গম্ভীর গভীর চোখের অধিকারী মানুষটা কি করে ওর মনে কথা বুঝতে পারলো সেটা ভেবেই চোখ ভরে ওঠে। খুব আপন করে কেওতো এসেছিলো ওর জীবনে কিন্তু কই সেতো ওকে বোঝেনি।তবে এই অজানা অচেনা মানুষটা কেনো বুঝলো?

মেহুর এমন অবস্থা দেখে পুনরায় ড্রয়ার খুলে একটা চকলেট এর বক্স বের করে মেহুর সামনে রাখে

- জল যদি চোখের সীমানা ছাড়িয়ে গড়িয়ে পরেতো খবর আছে

চলবে..

(খুব খারাপ সময় পার করছি। সবাই দোয়া করবেন। আল্লাহ যেনো সব কিছু কাটিয়ে ওঠার শক্তি দেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।)
Happy New Year sobai k❤️❤️

31/12/2022

#স্নিগ্ধ_শিশিরে_স্নান
#পর্বঃ_৯
রুবাইদা ইসলাম

নিজের অধিকার এভাবে ছেড়ে দিতে নেই।নিজের স্বামীকে ভালোবাসার আঁচল দিয়ে বেধে রাখতে হয়। তুশান স্যারের আপনার প্রতি পাগল করা ভালোবাসা আমাদের চোখে পরে, আর আপনার চোখে পরেনা! উনি আপনার স্বামী। আপনি ওনার বিয়ে করা বউ ওনার রক্ষিতা না। সেটা কেন বড় গলা করে বলতে পারলেন না ম্যাম।

পাশে বসে কুসুমের কথা গুলো শুনে তোহা ডুকরে কেদে ওঠে। রাইসা, নিশিতা খান চলে যেতেই দেয়াল ঘেসে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পরে তোহা। বাধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পরতেই ওর পাশ ঘেসে বসে পরে এখানে ওর সব কিছু দেখা শোনা করার জন্য রাখা কুসুম নামের মেয়েটি।

তোহার কান্নার কোন পরিবর্তন না দেখে কুসুম আবারো বলে
ম্যাম স্যার সম্পর্কে আপনি কিছুই যানেনা। ওনার কষ্টে ভরা জীবনে আপনিতো একমাত্র আশার আলো। নিজেকে এভাবে সরিয়ে রেখে আর কষ্টে নাইবা বিষিয়ে তুললেন ওনার জীবন। এতক্ষন তোহা আনমনে কাঁদলেও শেষের কথা শুনে তোহা চোখ তুলে তাকায়

কান্নার জর্জরিত ভাঙা ভাঙা গলায় বলে
ওনার আবার কিসের কষ্ট??

কুসুম তোহাকে দুই হাতে ধরে দাড় করিয়ে বলে চলুন আপনার রুমে যাই। তারপর বলছি

তোহা চোখে বিস্ময় নিয়ে কুসুম কে অনুসরণ করে

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কুসুম বাহিরের ঝলমলে সকালের দুরন্ত আলো আলোকিত চারিপাশে চোখ বুলিয়ে বলে

স্যারের যখন ২ বছর বয়স তখন স্যারের মা মারা যায়। সবার কথায় নিজের ছেলেকে মানুষ করতে স্যারের বাবা নিলয় খান পুনরায় বিয়ে করে তুশান স্যারের জন্য নতুন মা নিয়ে আসেন।

কিছু সময় থেমে কুসুম পুনরায় আবার বলতে শুরু করে

কিন্তু যাকে আনা হয় , তিনি তুশান স্যারকে সন্তান হিসেবে মানুষ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তুশান স্যারের বড় চাচি বেশ ভালো মানুষ , ওনার সৎ মা ওনাকে লালন পালন করতে অস্বীকার করলেও ওনার চাচি মেহরিমা খান তুশান স্যারের দায়িত্ব নিয়ে নেন। কিন্তু সেখানেও তুশান স্যারের সুখ সহ্য হলো না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মেহরিমা খানের এক্সিডেন্ট হয় । যার কারনে তুশান স্যারের দেখভাল করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠে না।

অগত্যা নিলয় খান তুশান স্যার কে লন্ডন তার বোন নিশিতা খানের কাছে পাঠিয়ে দেন। নিশিতা খান বরা বরি খুব ঊশৃংখল টাইপের মহিলা। জীবনে ৩ টা বিয়ে করেও কারো সাথেই সংসার নামে বন্ধনে জড়াতে পারেন নি। দুই সন্তানের জননী হয়েও কখনো সত্যিকারের মা হয়ে সন্তানদের মানুষ করতে আগ্রহী ছিলেন না। সেখানে ভাইয়ের ছেলেকে কি মানুষ করবে।

একেতো লন্ডনের মতো যায়গা। তার উপরে নিজের ফুপির ঊশৃংখল জীবনযাপন। কিভাবে মানুষের মতো মানুষ হবে তুশান নামের মানুষটা। ছোট থেকে এমন একটা পরিবেশ মানুষ হয়েছে যেখানে স্বামী স্ত্রী না হয়েও বেড শেয়ার করা সামান্য বিষয়।ছোট থেকে মা, বাবার শাসন, আদর ভালোবাসা কিছুই না পাওয়া তুশান স্যার লন্ডনের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকে।

বৃত্ত, প্রতিপত্তি থাকা শর্তেও প্রতিনিয়ত খুজে বেড়িয়েছে ভালোসাবার মতো কাওকে, কিন্তু পায়নি!যারা কাছে এসেছে সবাই স্যারের টাকাকে ভালোবেসে। তাই স্যার ও তাদের স্রোতে নিজেও গা ভাসিয়েছে।

স্যারের শুধু একটু ভালোবাসা দরকার। একবার ভালোবেসেই দেখনা! তাছাড়া পবিত্র বন্ধনে বাধা পরে গেছো আপনি, চাইলেও কি আর সেটা অস্বীকার করা যায়।সবাইকেই জীবন একটা সুযোগ দেয়া উচিৎ।

এতোক্ষণ ধরে এক ধ্যানে কুসুমের কথা গুলো শুনে যাচ্ছিলো তোহা। তুশানে কষ্টে গল্প শুনে নিজের কষ্ট কখন যে মিলিয়ে গেছে বুজতে পারেনি। তোহাও পায়ে পায়ে কুসুমের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কুসুমের দৃষ্টি অনুসরণ করে আলোকিত সকালের সৌন্দর্য চোখ ভাসিয়ে বলে
তুমি এতো কিছু কিভাবে জানলে?


তোহার প্রশ্নের সহজ উওরে কুসুম বলে আমার বাবা ওনাদের বাসায় কাজ করতেন। বাবার মুখেই ওনার গল্প শুনেছি। বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে বাকিটা চিনেছি তুশান স্যারকে। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে উনি আমাদের সংসারের সকল দায়িত্ব নেন।আমাদের পড়াশোনার ও সকল খরচ উনি প্রতি মাসে লন্ডনে থাকা অবস্থা পাঠাতেন। এখানে আসার পর মা মাঝে মাঝে এসে রান্না করে দিয়ে যেত। যদিও তুশান স্যার বার বার না করেছেন। তবুও কৃতজ্ঞতা বলেতো একটা কথা আছে

আপনি আসার পর মা কে বলে কিছুদিনের জন্য আমাকে আনা হয়েছে আপনার দেখা শোনার জন্য।

তোহা বাহিরে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কেন যেন মনটা খুব ভারী হয়ে আছে।

কুসুক কে এক কাপ কফি দিতে বলে আবারো সামনে তাকায়৷ জীবন মা, বাবা, ভাই, বোন দের নিয়ে অনেক সুখী জীবন কাটিয়ে বড় হয়েছে তোহা।কষ্ট কি বোঝেনি কখনো। তবুও তুশানের কথা ভাবতেই কালো চোখ দুটি জলে চিক চিক করে ওঠে। আনমনেই ভাবতে থাকে, তবেকি ও ভুল করেছে? ওর কি একটা সুযোগ দেয়া উচিৎ তুশান নামের মানুষটাকে?

কতো মানুষ বিয়ের পরেও স্বামীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়।হাজার চেয়েও ভালোবাসায় গড়ে তুলতে পারেনা নিজের সংসার। আর ও নিজেই নিজের সংসার শেষ করে দিচ্ছে।

হঠাৎ নিজের মুঠো ফোনের তীক্ষ্ণ রিংটোনের শব্দে ধ্যান ভাঙে তোহার। বেলকনিতে থেকে রুমের এসে ফোন রিসিভ করর কানে তুলতেই নিজের মায়ের গলা শুনে এতক্ষন মলিন হয়ে থাকা মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।

কেমন আছিস রে মা। বিয়ের পর মাকে এভাবে ভুলেই গেল

কি বল আম্মু, ভুলবো কেন?

তাহলে, না একবার দেখা করতে আসলি, না একবার ফোন করলি

তোহাকে চুপ থাকতে দেখে তাহামিনা বেগম পুনরায় বলেন বাবার উপরে এখনো রেগে আছিস?দেখ বাবা মা কখনোই সন্তানের খারাপ চায়না। আর তোর বাবাতো তার দুই মেয়ে বলতে পাগল। সে কি করে তোর খারাপ চাইতে পারে বল

বাদ দেওনা আম্মু। তা তোমারা সবাই কেমন আছো?

হুম, আমরা সবাই ভালো আছি। তুই ভালো আছিসতো?জামাই কেমন আছে?

হ্যা আম্মু আমিও ভালোই আছি। আর তোমাদের জামাইও ভালো আছে

তোরা একবার আয়না আমাদের বাড়িতে।

না আম্মু এখন সম্ভব না। ওনার ফুপি আসছে। তারা গেলে না হয় একবার যাবো

আরো কিছু সময় মায়ের সাথে কথা বলার পর মাকে বিদায় জানিয়ে কলটা কেটে দেয় তোহা। সত্যি বাবার প্রতি রাগ না থাকলেও কিছুটা অভিমানেই যোগাযোগ করেনি তোহা।আবার বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় ও।বিষাদে ঢেকে থাকা মন নিয়ে খুজে বেড়ায়, না পাওয়া প্রশ্নের উত্তর।

_____________________

হাতে থাকা একের পর এক ফাইল সকালে থেকেই চেক করে যাচ্ছে তুশান। গতকাল নিশিতা খান ও রাইসার হঠাৎ উপস্থিতিতে না চাইতেও হাতের কাজ ফেলে ছুটতে হয়েছিলো বাসায়। তাই আজ এসে এতোটুকু অবসাদ মেলেনি ওর।নিশানের অবস্থাও একি। কাজের চাপে নাজেহাল বেচারা।

ঘাড় ব্যথায় টনটন করে উঠতেই সামনে থাকা ফাইল বছর বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় তুশান। এদিক ওদিক কয়েক বার মাথটা নাড়িয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস নেয়। ওর এখন এক কাপ কফির খুব প্রয়োজন। কফির কথা মনে পরতেই তোহা নামক প্রিয় মুখশ্রী ভেসে ওঠে চোখের পর্দায়।

অধর কিঞ্চিৎ ফাটলে ফুটে ওঠে স্নিগ্ধ ময় প্রশান্তির হাসি। মুহূর্তেই উবে যায় এতক্ষণের সকল ক্লান্তি। কিছু একটা ভেবে এক মুহুর্ত দেরি না করে ব্লেজার হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পরে নিজের কেবিন থেকে।

পথি মধ্যে নিশানের সাথে দেখা হলেও, নিশানের, কোথায় যাচ্ছিস প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়েই বেড়িয়ে পরে।

হঠাৎ তুশানকে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে যেতে দেখে কিছুটা চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে নিশানের কাপালে।

____________

কলেজের সামনে ২ ঘন্টা যাবত দাঁড়িয়ে থেকে, অনেক বার তোহার মোবাইলে কল করে নিরাশ হয়ে বিরক্তিত চোখে বড় একটা সানগ্লাস গলিয়ে নিজের চেহারা আড়াল করে পায়ে পায়ে গেট দিয়ে কলেজে প্রবেশ করে। আসে পাশে একবার তাকিয়ে সোজা হাটা দেয় প্রিন্সিপাল স্যার এর কেবিনের দিকে।

ভেতরে আসতে পারি?

অপরিচিত কন্ঠ শুনে প্রিন্সিপাল দরজার দিকে তালাতেই বিস্মিত হয়।অসময়ে তুশানের হঠাৎ উপস্থিতি তার মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়। নিজের চেয়ার ছেড়ে তুশানের দিকে এগোতে এগোতে বলে আপনি এই সময় হঠাৎ

প্রিন্সিপাল স্যারকে বিচলিত হয়ে দেখে এগিয়ে এসে বলে

না স্যার কোন সমস্যা নেই। আমি আমার একটা ব্যক্তিগত কাজে এখানে এসেছি

তুশানের কথায়, ধরে প্রান আসে প্রিন্সিপালের। উনি তুশান কে বসতে দিয়ে নিজেও বসেন।

তা কি ব্যাপার বলুন

আসলে আমি এখানে এই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়ুয়া দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তাবিয়া তাবাসসুম তোহার সাথে একটু দেখা করতে এসেছি। যদি একটু ডেকে দিতেন

তুশানের বলার সাথে সাথে প্রিন্সিপাল পিয়নকে ডেকে, তোহাকে ডেকে পাঠায়।কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পিয়ন এসে জানায়, তোহা আজ কলেজে আসেনি

সেটা শুনেই তুশান কপাল কুচকে নেয়।সকালে বেড় হওয়ার সময় তো সব ঠিকি ছিলো। তাহলে কলেজে না আসার কারন কি বুজতে না পেরে উঠে দাঁড়ায় তুশান

তুশানকে দাড়াতে দেখেই প্রিন্সিপাল স্যার বলে আপনি দাড়ালেন যে। বসেন চা কফি কিছু খেয়ে তার পর না হয় যাবেন

প্রিন্সিপাল স্যারের কথা শুনে তুশান সৌজন্য মূলক হাসি হেসে বলে

না স্যার আজকে একটু তাড়া আছে, অন্য একদিন এসে চা খেয়ে যাবো

তুশান আর এক মুহুর্ত ব্যয় না করে প্রিন্সিপাল স্যারকে বিদায় জানিয়ে তার কেবিন থেকে বেড়িয়ে আসে।

___________

পুরো রুম পিন পিনে অন্ধকা আর নিস্তব্ধতা ঢেকে আছে। দিনের আলো দেখে আসা তুশানের চোখ হঠাৎ অন্ধকারে হকচকিয়ে ওঠে।

তখন কনিংবেল চাপতেই রাইসা দরজা খুলে অনাকাঙ্ক্ষিত সময় তুশানের উপস্থিতিতে বেশ ঘাবড়ে যায়। তুশান রাইসার সাথে কোন কথা না বলে ওর পাশ কাটিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে আসে। এসেই এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন রুম দেখে বেশ ঘাবড়ে যায়।

রুমে আলো জ্বালতেই খাটে মাথা ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে থাকা এলো মেলো ভাবে নিজের প্রেয়সীকে বসে থাকতে দেখে হাতে থাকা ব্লেজার ছুড়ে ফেলে এক ছুটে তোহার সামনে হাটু মুড়ে বসে।

নিজের পাশে হঠাৎ কারো উপস্থিতি পেয়ে মাথা তুলে তাকায় তোহা। তুশান তোহার ফুলে যাওয়া রক্তিম মুখ, কান্নায় ভেজা চোখ দেখে মুহূর্তেই থমকে যায়

সকালেও যেই প্রশান্তি ভরা মুখ দেখে গিয়েছে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে একি হাল হয়েছে সেই মুখের। হঠাৎ তুশানের চোখ আটকে যায় তোহার বা গালে।ফর্সা গালে স্পষ্ট আঙুলের ছাপ দেখে তুশানের নীলাভ চোখ পরক্ষণেই রক্তিম আভায় ঢেকে যায়

তুশান দুই হাতের মাঝে প্রিয় মুখশ্রী চেপে ধরে কাপা কাপা গলায় বলে

কি হয়েছে তিহু?

তুশানের মায়া ভরা কথায় তোহা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। হাম্লে পরে সামনে থাকা মানুষটার বুকে

এতো দিন যেই মানুষটাকে একটু কাছে পাওয়ার ব্যকুলতা কেটেছে প্রতিটা রাত। যেই মানুষটাকে ভালোবেসে একটু ছুতে দিসেহারায় ছটফট করেছে মন, সেই মানুষটার অপ্রত্যাশিতভাবে বুকে হাম্লে পড়ায় বেশ ঘাবড়ে যায় তুশান। কিন্তু মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে পরম আবেশে দু হাতে আগলে জড়িয়ে ধরে।

তোহার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তোহাকে কোলে তুলে নিতেই তোহার গলা জড়িয়ে ধরা দেখে মুখ টিপে হাসে তুশান

খাটে আধ শোয়া করে বসিয়ে দিয়ে নিজেও ওর পাশে বসে।
এবার বলতো কি হয়েছে

তুশানের আবার জিজ্ঞেস করায় পুনরায় বুক ফেটে কান্না আসে তোহার। তুশান তোহার অবস্থা বুজতে পেরে চুপ করে যায়। এক হাতে তোহাকে নিজের আরো কাছে টেনে নিয়ে বুকের মাঝে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে

যে বা যাদের জন্য তোমার এই হাল হয়েছে কথা দিচ্ছি তাকে বা তাদেরকে আমি ছাড়বো না। তোমার প্রতিটা চোখে জলের হিসাব তাদের দিতেই হবে

#চলবে

26/12/2022

#স্নিগ্ধ_শিশিরে_স্নান
#পর্বঃ_৮
রুবাইদা ইসলাম

কলেজে অবস্থিত ছোট্ট বটগাছের নীচে বসে আড্ডায় ব্যস্ত তোহারা। সবার কথা,খুনসুটিতে মেতে আছে বন্ধু মহল।মাঝে মাঝে একটা দুটো কথায় অংশগ্রহণ করে নিজের উপস্থিতির জানান দেয়া ছাড়া বেশ চুপ চাপি তোহা।

আর পড়াশোনা ভালোলাগেনা। আম্মুকে কতো করে বলি, বয়সতো আর কম হলো না এবার একটা বিয়ে দেও! কে শোনে কার কথা।

হঠাৎ জোহার এমন কথায় উপস্থিত সকলে সকলে কিছু সময় নিরবতা বজায় রাখলেও কিছুক্ষনের মধ্যেই শব্দ করে হেসে দেয়

শুধু মাত্র হাসতে পারেনা তোহা। সবাই হাসিতে মেতে উঠলেও বিয়ের কথা কর্ণদ্বয় হতেই চমকে ওঠে ও।হাজার বার অস্বীকার করলেও সত্যিটাতো আর মিথ্যে হয়ে যাবেনা।যত জোড়ালো কন্ঠে চিৎকার করে বলুক না কেন তবুও ওর গায়ে লেগে যাওয়া বিবাহিতের সিল মুছে যাবেনা। নিজের ব্যাগ কাধে তুলে নিতে দাড়াতে দাড়াতে বলে তোরা থাক তাহলে আমার একটা কাজের কথা মনে পরে গেছে আমাকে যেতে হবেরে

হঠাৎ তোহার এমন ভাবে চলে যাওয়ার কথায় সবাই কিছুটা অবাক হলেও কাজের কথা বলায় আর কথা বাড়ায় না।

তোহা সবাইকে বিদায় জানিয়ে গেটের কাছে এসে দাঁড়ায়। কিছুটা অন্য মনস্ক হয়ে বাসায় ফেরার জন্য চোখ রিক্সা হাতরে বেড়ায়।

এতোটাই অন্য মনস্ক ছিলো যে পাশে কেও দাঁড়িয়েছে সেটা অনুভবের ক্ষমতা ও লোপ পেয়েছে।

নিভ্রান এক ধ্যানে তোহা নামক মানুষটাকে দেখে যাচ্ছে।সেই দিনের পর, মাঝে কেটে গেছে অনেক গুলো দিন। নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে তোহা নামক ভালোবাসার থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব দূরে রেখেছে।কিন্তু নিজের চেষ্টার কাছে হার মেনে আবারো দাড়ালো প্রিয় মুখশ্রীর সামনে।

আমি কি দেখতে খারাপ হয়ে গেলাম নাকি? আগে হা হয়ে দেখা চোখ, আমি পাশে থাকায়ও নিজের মগ্নতায় মগ্ন।

হঠাৎ পরিচয় কন্ঠে এমন কথা শুনে পাশ ফিরে তাকাতেই নিভ্রান কে দেখে দুই পা পিছিয়ে যায় তোহা। আমতা আমতা করে বলে সরি স্যার আসলে আমি আপনাকে খেয়াল করেনি।

নিভ্রান তোহাকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দেখে বলে

কি হয়েছে তোমার এমন আপসেট লাগছে কেন? কোন সমস্যা?

তোহা নিজের মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে বলে না স্যার আসলে সামনে এক্সামতো তাই একটু চিন্তায় আছি। আচ্ছা আমার দেড়ি হয়ে যাচ্ছে আসি বলেই সামনের ফুটপাতের রাস্তা ধরে পা চালায়।

নিভ্রান নিজের ভ্রু সংকুচিত করে তোহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। তোহা যে কিছু লুকি ওকে মিথ্যে বলেছে সেটা ওর বিচক্ষণ দৃষ্টি এড়ায়নি।

_______________________

অফিসের কাজে ব্যস্ত তুশান এক চিলতে অবসাদ পায়নি।কাজের ব্যস্ততায় দুপুরের খাবার খাওয়া সময়টুকুও করে উঠতে পারেনি।এতো ব্যস্ত থাকার সময় হঠাৎ করেই রাইসা ও নিশিতা খান অফিসে এসে হাজির।

তুশান নিজের ফুপি ও ফুপাতো বোনকে দেখে যেমনি অবাক হয়েছে তার চাইতে নিজের মা বোন কে দেখে বেশি বিস্মিত হয়েছে নিশান। ওদের কিছু না জানিয়ে হুট করেই লন্ডন থেকে এভাবে চলে আসবে সেটা দুই ভাইয়ের কেও কল্পনাও কিরেনি।

তুশানের বিয়ে। সেই বিয়ে নিয়ে এতো ঝামেলার মাঝে নিজেরা মা বোনের উপস্থিতি যেন নিশান কে আরো ভাবিয়ে তুলেছে। রাইসা বরাবরি তুশানের গায়ে পরা। যার কারনে তুশান নিশানদের বাসয় খুব প্রয়োজন ছাড়া কখনোই যেতো না। তাতেও যে খুব একটা রেহাই পেতো তুশান তাও না। মাঝে মাঝে হাজার এড়িয়ে চলার পরেও রাইসা নামের ঝামেলায় পরতেই হতো ওকে

রাইসা এসেই হামলে পরে তুশানের ওপর। বিরক্তিতে তেতে ওঠে ও। কিন্তু নিজের ফুপির প্রতি কিঞ্চিৎ কৃতজ্ঞতা থাকার কারনে রাইসার সাথে খারাপ ব্যবহার কখনোই করেনা তুশান। আর সেই সুযোগটাই সবসময় নিয়ে থাকে নি
রাইসা।

তুশান মুখে কিছু না বললেও ভিতরে ভিতরে বেশ চিন্তিত হয়ে পরে। রাইসার সভাব ওর ভালো কিরেই জানা। রাইসাকে নিয়ে চিন্তা না হলেও তোহাকে নিয়ে দেখা দেয় মনের কনে ভয়ের বলি রেখা। আর যাই হোক তোহার সাথে কোন কিছুই ও মেনে নিতে পারবেনা।



তুশান ব্লেজার হাতে নিয়ে কেবিন থেকে বের হতে হতে নিশানের উদ্দেশ্যে বলে আমি কিছু যানিনা সব তুই সামলাবি।

_____________________

অপরাহ্ন পেরিয়েছে বেশ কিছুক্ষন। তুশান নিশানের ঘরে ফেরার বার্তা জানান দিচ্ছেন দেয়ালে টানানো ঘড়িটা।


সবুজ শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে বিকেলের জল খাবারের ব্যস্ততায় ব্যস্ত তোহা। চুলার তাপে মুখে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাতের ব্যস্ততায় মুছে ওঠার অবসাদ মেলেনি চঞ্চল হাতের।

দরজায় কলিংবেলের শব্দের হাতের চঞ্চলতা আরো একটু বৃদ্ধি করে। প্রতিদিনে একি কাজে অভ্যস্ত হয়ে বিচলিত হয়নি ও।দুই ভাইয়ের ক্লান্তিতে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ঠান্ডা কিছু আবদারে আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছে জুস।

ফ্রিজ থেকে জুসের জগটা বের করে ২ গ্লাস জুস ডেলে নেয় তোহা। ট্রে হাতি বেরিয়ে আসে ডাইনিং থেকে।

কিন্তু ড্রইং রুমে ঢুকেই থমকে যায় কিছু অপরিচিত মুখ দেখে।তুশান, নিশাতের সাথে সোফায় আয়েস করে বসে আছে একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা ও একটা অল্প বয়সি মেয়ে।

তোহাকে দেখেই মহিলাটি হাতের ইশারায় ডাকতেই পায়ে পায়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ও।

এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে জুসের গ্লাসগুলো হাতে দেও।

মহিলার কথা বেশ অহংকার মিশ্রিত। তোহা চুপ চাপ জুসের গ্লাস ওনাদের হাতে তুলে দেয়।

জুস মুখে দিয়েই নিশিতা খান বলেন বেশ মজাতো। কতদিন ধরে এখানে কাজ করো?

ওনার কথায় তুশান নিশান দুজনেই তোহার দিকে তাকায়। তোহা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে সামনে বসা মানুষগুলোর দিকে।

তোমার কাজের মেয়েটার হাতে যাদু আছে দেখছি তুশান

কাজের মেয়ে শব্দটা শুনের ভেতরে ভেতরে জ্বলে ওঠে তুশান। যার বাড়ি যার ঘর তাকেই কিনা বলে কাজের মেয়ে।আজ শুধু তোহার শর্ত বেধে রেখেছে তুশানের হাত। নয়তো নিজের একমাত্র ভালোবাসা,বিয়ে করা বউকে কেও কিছু বলবে সেটা চুপ চাপ মেনে নেয়ার ছেলে তুশান নয়।

কি বলছো আম্মু ও এবাড়ির কাজের মেয়ে না ওতো...

নিশানকে থামতে দেখে নিশিতা খান প্রশ্ন করে

তাহলে কে ও?

নিশিতা খানের প্রশ্নে ঘাম ছুটে যায় নিশানের। হাজার হাতরেও হাতের কাছে কোন ভালো উত্তর না মেলায় চট করে বলে

হোম এসিস্ট্যান্ট..

ছেলের কথায় বেশ অবাক হয়েই নিশিতা খান বলে, হোম এসিস্ট্যান্ট?

হুম,তুশানের বাসার সব কিছু উনি দেখেন।

ওওও

মায়ের সন্তুষ্টজনক উত্তরে হাফ ছেড়ে বাচে নিশান

এতোক্ষন ধরে উপস্থিত সকলের কথা শুনে যাচ্ছিলো তোহা। নিশান আর নিশিতা খানের কথা শুনে এতোটুকু বুজতে পেরেছে যারা এসেছে তারা হলেন নিশানের মা আর বোন।

নিশিতা খান একবার ভালো করে তোহাকে দেখে শীতল কন্ঠে বলে আমাদের খেতে দিতে বলবে, আসলে আমাদের কারোই দুপুরে খাওয়া হয়নি

তোহা মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই তুশানের কথায় স্থির হয়ে দাড়িয়ে যায়

আমার খাবারটা রুমে দিয়ে যেও।বলেই সিড়ির দিকে পা বাড়ায়

শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নেজের ভেজা চুলে তাওয়াল চালায় তুশান । এর মাঝেই নিজের প্রেয়সীর উপস্থিত টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায় তুশান। বিয়ের পর থেকে প্রেতিদিন নিত্য নতুন রঙে মেয়েটার ওকে নিজের প্রতিনিয়ত প্রেমে জালে ফেলছে।

খাবারের ট্রে খাটে রেখে তার পাশে বসে পরে তোহা। তোহা বসতেই তুশান ও ওর পাশে গিয়ে বসে।

প্লেল হাতে নিয়ে চামুচ দিয়ে খাওয়া শুরু করে। নিরবতা ভেঙে তোহা বলে

আপনার ফুপি, রাইসা আপু কেও আমার বিয়ের বা শর্তের কথা কিছুই যানেনা। তাই ওনাদের সামনে একি রুমে থাকাটা ভালো দেখাবেনা।

তুশানের খাওয়ার কোন পরিবর্তন না দেখে তোহা আবার বলে। হোম এসিস্ট্যান্ট হয়ে আপনার সাথে একি রুমে থাকলে, তাকে কি বলবে বুজতে পারছেন

তুশান এতক্ষন তোহার কথার উত্তর না করলেও শেষের কথায় খাওয়া বন্ধ করে তোহার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে

যা কিছুই হোক তোমাকে আমার রুমেই থাকতে হবে। ওরা কি ভাববে , কি বলবে সেটা আমার সমস্যা না, তোমার সমস্যা। তাই তাদের কি বলবে সেটাও তুমি বুজবে। আমার তোমাকে নিজের স্ত্রী বলাতে কোন সমস্যা নেই। তুমি কি করবে ভেবে দেখো।

হাতের কাজ শেষ করে গুটি গুটি পায়ে তুশানের রুমের দিকে হাটা দেয় তোহা।রাতের খাওয়া শেষে যে যার রুমে গেছে অনেকটা সময়। চারপাশে একবার ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে তবেই রুমে ঢোকে তোহা।ও কিছুতেই চায়না তুশানের রুমে রাতে থাকা নিয়ে কোন সিনক্রিয়েট হোক।

রুমে ঢুকেই কোথাও তুশান কে না দেখে বুজতে পারে মানুষটা বেলকনিতে আছে। আর কোন কিছু না ভেবেই ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরে তোহা।

______________________

তুমি রাতে তুশানের রুমে ছিলে?

রাইসার এমন কথায় তোহা হকচকিয়ে রাইসার দিকে তাকায়। সকালে ভালোভাবে খেয়াল করেইতো বের হয়েছিলো তাহলে রাইসা সেটা কি করে দেখলো বুজতে পারছেনা ও।

তোহাকে চুপ থাকতে দেখে নিশিতা খান এগিয়ে এসে বলে
তোমার নিরবতাই বলে দিচ্ছে রাইসা যা বলছে তা সত্যি।

হোম এসিস্ট্যান্ট নামে নিজের শরীর বেচে বেড়ানো মেয়ে তাহলে তুমি। কালকে তোমাকে দেখেই বুজতে পারেছলাম যে তুমি থার্ড ক্লাস গরিব ঘরের সস্তা মেয়ে। নিজের রুপে তুশান কে ভোলাতে চাইছো।

নিশিতা খানের কথা শুনে তোহা ওর চোখে পানি ছেড়ে দেয়। নিজের চরিত্র নিয়ে এতো বাজে কথা শুনে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে ওর।

সকালে তোহাকে তুশানের রুম থেকে বের হতে দেখেও তুশানের ভয়ে চুপ থাকলেও রাইসা তুশান, নিশান অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যেতেই নিজের মাকে সাথে করে তোহাকে কথার জালে চেপে ধরে

রাইসা এতক্ষন রাগে ফুসছিলো। গত কাল মেয়েটার জন্য তুশানের টান দেখে এমনিতেই রেগে আছে তোহার উপরে এখন মায়ের আস্কারা পেয়ে আরো তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। তোহার দিকে তাকিয়ে হিস হিস করে বলে বড়লোক দেখে আর লোভ সামলাতে পারোনি, তাই নিজের শরীর দিয়ে বস করতে এসেছো

নিশিতা খান বয়সে বড় বলে চুপ থাকলেও তোহা রাইসার কথা রাগে গজ গজ করে উঠে বলে

খবরদার মুখ সামলে কথা বলবেন

তোহাকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলতে দেখে রাইসার যেন জ্বলন্ত আগুনে ঘি পরে আরো তেতে ওঠে। দুই পা এগিয়ে তোহার গালে কষিয়ে চড় দিয়ে বলে রক্ষিতার গলার জোর এতোটা মানায় না। এবার থেকে রক্ষিতা রক্ষিতার মতোই থাকবি...

#চলবে

26/12/2022

🚇 আন্তঃনগরের_ভালবাসা
লেখকঃ আবির খান
পর্বঃ ১০(শেষ পর্ব)

আমি বাবার সামনে বসে আছি। বাবা বললেন,

-- হুম বল কি বলবি।

আমি বলতে শুরু করলাম,

-- বাবা আমার অনেক দিন আগে থেকেই একটা ইচ্ছা ছিল। কিংবা বলতে পারো এটা আমার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণে লাগবে অনেক টাকা। যার জন্য গত এক বছর ধরে আমি দিন রাত পরিশ্রম করেছি। আমার ইচ্ছাটা হলো, আমার মতো যারা আছে, যারা একটু হলেও কাজ করার মতো যোগ্যতা রাখে তাদের নিয়ে আমি একটা ব্যবসা শুরু করবো। আমি আমার নিজের নামে একটা ব্রান্ড চালু করতে চাই। যেখানে আমার মতো এবং সবধরনের মানুষ কাজ করতে পারবে৷ তাদেরকে সমাজের চাপের মুখে পড়তে হবে না৷ ভালোরা অসহায়দের সাহায্য করবে আর অসহায়রা ভালোদের। এভাবেই তাদের মাঝে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠবে৷। আমার স্টুডেন্টদের এখন সেমিস্টার ব্রেক চলছে। আমি আর দেরি করতে চাই না। আমি দ্রুত আমার স্বপ্নের বাস্তবিক রূপ দেখতে চাই। তুমি একটু সাহায্য করবে আমাকে?

বাবা অসম্ভব খুশি হন আমার আইডি শুনে। তিনি হয়তো ভাবতেই পারেননি আমি আমার মতো অসহায় মানুষদের কথা ভাববো। তাদের জন্য কিছু করতে চাইবো। বাবা আমাকে বললেন,

-- হাজারবার করবো। বল বাবা তোর কি সাহায্য লাগবে?
-- বাবা আমি একটা মাঝারি আকারের ফ্যাক্টরি ভাড়া নিতে চাই। সেখানে তোমার কোম্পানির বানানো র' কাপড় দিয়ে আমি আমার মতো করে বিভিন্ন ডিজাইনের শার্ট প্যান্ট ইত্যাদি বানাতে চাই। এরজন্য আমার ৫০ টি মেশিন লাগবে। কারণ প্রথম দিকে আমি ৫০ জন নিয়ে কাজ করতে চাই। যার মধ্যে ২৫ জন থাকবে আমার মতো আর বাকি ২৫ জন হবে স্বাভাবিক। তাদের সংমিশ্রণেই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো স্বপ্নটা পূরণ করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করতে চাই। তুমি যদি আমাকে একটা ভালো ফ্যাক্টরি আর কোথায় এই মেশিন পাওয়া যাবে বলতে তাহলে আমার জন্য ভালো হতো। আর কত টাকা খরচ হতে পারে সেটাও যদি বলতে তাহলে আরও ভালো হতো।

বাবা আমার কথা শুনে একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন বোধহয়। তিনি চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ গভীর ভাবে ভেবে বললেন,

-- আসলে বাবা তুই যে বিজনেস আইডিয়া নিয়ে এসেছিস সেটা নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু এখানে যে লাখ টাকায় হবে না, কোটি টাকা লাগবে৷ তুই যে মেশিন চাচ্ছিস সেগুলা কিনতে গেলে তোর কাছে যা আছে সব শেষ হয়ে যাবে৷ তাহলে ফ্যাক্টরি ভাড়া আর কাপড় কিনবি কিভাবে? আর শ্রমিকদের বেতনও বা কিভাবে দিবি বল?

বাবার কথা শুনে আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। আসলেই তো এত অল্প টাকায় কি করবো আমি? তাহলে কি আমার স্বপ্নটা আর পূরণ হবে না? এত দূর এসে হেরে যেতে হবে? ভীষণ খারাপ লাগছি। হঠাৎই বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,

-- এত বড়ো পরিসরের ব্যবসা কখনো একার অর্থায়নে করা যায় না৷ কিন্তু তুই যেহেতু চাচ্ছিস আমি বাবা হিসেবে তোকে একটা সুযোগ করে দিতে পারি। তবে সেটা প্রথম সাপ্লাই পর্যন্ত। তারপর কিন্তু আর হবে না।
-- কি বাবা বলো প্লিজ বলো।
-- শোন তাহলে, আমার একজন পরিচিত লোক আছে, যার একটা ফ্যাক্টরি বেশ কয়েকমাস যাবৎ বন্ধ। আমি তার সাথে কথা বলে তোকে সেটা ভাড়া নিয়ে দিতে পারবো। হয়তো ওনাকে তোকে প্রায় দশ লক্ষ টাকার মতো দিতে হবে৷ শুধু আমি বলবো বলে। নাহলে আরও বেশি নিবে। আর রইলো মেশিন আর কাপড়, সেটা আমিই দিব। কিভাবে? বলছি, আমার কাছে ১০০ টা মেশিন আগে থেকেই স্টকে আছে। সেখানে তোকে ৫০ টা দিলে আমার তেমন কিছু হবে না। আর প্রথম সাপ্লাইয়ের কাপড়ও আমি তোকে কোন টাকা ছাড়াই দিব৷ তুই প্রথম সাপ্লাই দিয়ে যা লাভ করবি সেটা থেকে আমার কাপড়ের যে দাম হয় সেটা দিয়ে দিস। আর আস্তে আস্তে তোর ব্যবসা ঠিক ভাবে চালু হলে তখন কিন্তু মেশিন ভাড়াও দিতে হবে আমাকে। রাজি থাকলে বল।
-- আমি রাজি। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি না থাকলে আমার স্বপ্নটাই আজ মাটি চাপা যেত৷
-- শোন আবির, একটা ব্যবসা চালু করা যতটা সহজ দেখায় আসলে বাস্তবে কিন্তু ততটা সহজ না। অনেক সরকারি আইন কানুন মেনে তারপর একটা ব্যবসা চালু করতে হয়। তুই তো সবই জানিস আমি জানি। তাও আবার বললাম। এত বড়ো প্রেসার একা নিতে পারবি?
-- আমাকে পারতেই হবে বাবা। পারতেই হবে। আজ আমি না পারলে আমার মতো অনেকেই জীবনের মায়া ছেড়ে চলে যাবে। আমি তাদের বেঁচে থাকার কারণ হতে চাই।
-- ঠিক আছে, যা আমার দোয়া আর আমি তোর পাশে আছি। দেখি আমার ছেলে আমাকে দেখিয়ে দিতে পারে কিনা৷
-- ইনশাআল্লাহ বাবা আমি পারবো।

সেদিনের পর লেগে গেলাম নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে। এই অচল হাত নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম শুরু করলাম। ফ্যাক্টরি ভাড়া নেওয়া, সেটার ওয়ার্ক ফিল্ড সাজানো, লাইটিং, মেশিন আনা, সেগুলো সেটাপ করা। এরমাঝে সরকারি কাজ তো আছেই। নিজের নামে ব্রান্ড যে চালু করতে হবে। এতদিন বইতে ব্যবসার অনেক কিছু পড়েছি। মনে হয়েছে কত্তো সহজ। কিন্তু বাস্তবে একটা ব্যবসা দাঁড় করানো কতটা যে কঠিন তা বুঝতে পারছি এখন। আজ প্রায় ২০ দিন হবে আমি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র ৪/৫ ঘণ্টা ঘুমাই। খাওয়া দাওয়াও কোন রকম হচ্ছে আর কি। এই কঠিন সময়ে আমার পাশে আমার পরিবার আর জান্নাতকে পেয়েছি। তারা সবসময় আমাকে সাহস দিয়ে এসেছে। সব কিছু গোছাতে গোছাতে এবার শ্রমিক খোঁজার পালা। পেপার পত্রিকা, অনলাইন অফলাইন সব জায়গায় প্রমোশন করি। আমাকে অবাক করে দিয়ে রাতারাতি অনেক শ্রমিক চলে আসে। তাদের মধ্যে আমার মতোও অনেকে ছিল। একটা ব্যবসার সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো শ্রমিকদের হায়ার করা। কারণ তাদের হাতেই সব কিছু৷ প্রায় একসপ্তাহ লেগে যায় আমাকে এদের হায়ার করতে করতে। সাথে এদেরকে কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আবার আলাদা লোক নিতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে ডিজাইনারদের খুঁজতে। কারণ অত সহজে তাদের পাচ্ছিলাম না। আমি মোট চারজন ডিজাইনারকে হায়ার করি। এবং তাদেরকে সব বুঝিয়ে দিয়ে কাজেও লাগিয়ে দিলাম। এর মাঝে আবার আমার স্টুডেন্টদের সেমিস্টার ব্রেক শেষ। সাথে ফ্যাক্টরিটা চালু করার সময়ও চলে এসেছে। নিজেকে মানুষ না রোবট মনে হচ্ছিলো। মনে মনে শুধু আল্লাহকে ডাকছিলাম। সকালে ফজরের নামাজ পড়ে কাজে বের হতাম আর আসতাম যোহরে। কোন রকম সাওয়ার নিয়ে নামাজ পড়ে খেয়ে আবার পড়ানো শুরু। একদম মাগরিব পর্যন্ত দুইটা ব্যাচ পড়িয়ে আবার ফ্যাক্টরিতে যেতাম। আসতাম রাত ১ টায়। এভাবেই আমার কঠোর জীবন চলতে থাকে। একটা হাত নিয়ে কিভাবে এত কিছু করছিলাম জানি না। কিন্তু আমি খুব খুশি ছিলাম। যখন আমার অসহায় শ্রমিকরা আমার ভালো শ্রমিকদের সাথে মিলেমিশে কাজ করছিল, আমি খুশি হচ্ছিলাম যখন তারা আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলো। ডিজাইনাররাও অক্লান্ত পরিশ্রম করছিলো। কারণ তাদের সবাইকে ধরে ধরে বুঝিয়ে দিতে হচ্ছিলো। আমিও তাদের সাথে ছিলাম। একদিকে ড্রেস বানানো হচ্ছিলো অন্যদিকে আমি এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছিলাম অর্ডার নেওয়ার জন্য। আল্লাহর ইচ্ছায় আমি তিনটা বড়ো বড়ো শপিংমল থেকে অর্ডার আনতে সক্ষম হই। এবার চিন্তা হলো ভালো করে প্রোডাক্ট গুলো বানিয়ে সাপ্লাই দেওয়া। সময় যত যাচ্ছে চিন্তা আর ভয় শুধু বাড়ছেই। সে সাথে আমার অক্লান্ত পরিশ্রমও বাড়ছে। এতগুলো মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একদিন ক্লাস শেষ হলে জান্নাত থেকে যায় সবাই গেলে। আমি চেয়ারে বসেছিলাম। খুব ক্লান্ত লাগছিল। জান্নাত আমার পাশে এসে বসে। ওর ব্যাগ থেকে একটা জুসের বোতল আর একটা প্যাকেট বের করে দিয়ে বলে,

~ এগুলো খেয়ে নিন। খাওয়া দাওয়া তো একদম করছেন না৷ কেমন শুকিয়ে যাচ্ছেন দিন দিন৷ আপনাকে এভাবে দেখলে আমার অনেক কষ্ট হয়।

আমি জান্নাতের দিকে তাকাই। দেখি ওর চোখে পানি। আমি মুচকি হেসে ওর চোখ দুটো মুছে দিয়ে বলি,

-- এই বোকা কাঁদছো কেন?
~ খুব ভয় হচ্ছে। আপনি এতগুলো দিন বসে কষ্ট করেছেন। সেই কষ্টের মূল্য যদি আপনি না পান। খুব ভয় হচ্ছে আমার।

আমি ওর আনা নাস্তা খেতে খেতে ওকে আমার সাথে হেলান দিয়ে নিয়ে ওকে বলি,

-- চিন্তা করো না। আমার কপালে যা লিখা আছে তাই হবে। এখন সব আল্লাহর হাতে। তিঁনি যা ভালো মনে করবেন তাই হবে৷ কিন্তু তোমার ভয়ের কারণ এটা মনে হচ্ছে না৷ আসল কারণটা বলো।
~ আপনি না আসলেই..
-- বলো কি হয়েছে?
~ বাবা যদি আপনাকে মেনে না নেয় সেই ভয়েই আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
-- তিনি আমাকে অবশ্যই মেনে নিবেন৷ এই যে এত সৎ হালাল ভাবে পরিশ্রম করছি তার প্রতিদান কি আমি পাবো না? অবশ্যই পাবো। সমাজে আমার একটা আলাদা নাম হলে এই ডান হাতটার দিকে তখন আর কেউ তাকাবে না দেখো। আমি সফল হতে পারলে সবার আগে তোমাকেই বিয়ে করবো। আমার কাছে থেকেই পড়াশোনা করবে। তুমি আস্তে আস্তে তোমার মাকে একটু একটু করে আমার সম্পর্কে বইলো।
~ আচ্ছা।
-- এরপরও যদি তারা আমাদের মেনে না নেয় তাহলে আমরা বারাবাড়ি করবো না। কারণ তাদের দোয়া ছাড়া বিয়ে করলে আল্লাহ কখনো আমাদের মাফ করবেন না।
~ হুম। আপনি সত্যিই অনেক ভালো। আমার আপনার উপর বিশ্বাস আছে। জানেন, মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আপনার এই হাতটা ভালো না হয়ে ভালোই হয়েছে। এই হাতটার জন্যই আমি আপনাকে পেয়েছি, এই হাতটার জন্যই আঙ্কেল আণ্টি এত্তো ভালো একটা ছেলে আর মরিয়ম একটা ভাই পেয়েছে, এই হাতটার জন্যই আপনার মতো কত অসহায় মানুষ আজ কাজ করছে। তাদেরও একটা ভবিষ্যৎ হচ্ছে। এত মানুষের দোয়া আর ভালবাসা আপনার সাথে। আপনি কখনোই হারতে পারেন না। অসম্ভব।
-- আল্লাহ ভরসা। আচ্ছা আজান দিচ্ছে আমি নামাজে যাই। তারপর আবার ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে। পরশু ডেলিভারি করতে হবে৷ তুমিও নামাজ পড়ে যেও। আসি।
~ আচ্ছা।

জান্নাত বাসার ভিতরে চলে গেলে আমি নামাজ পড়ে আবার ফ্যাক্টরিতে চলে যাই। দেখতে দেখতে পরশুদিন চলে আসে। খুব সকাল সকাল ভাড়া করা ডেলিভারির জন্য গাড়ি চলে আসে। আমি নিজেই গাড়ির সাথে গিয়ে পুরো দিন বসে ডেলিভারি দিয়ে আসি। এবার শুধু অপেক্ষার পালা। কারণ আমার ফোনটা যদি না বাজে, নতুন অর্ডার না আসে তাহলে সব শেষ। ঘড়ির কাটা তার আপন গতিতে ঘুরছে। সাথে সময়গুলোও পাড় হয়ে যাচ্ছে। আজ তিন দিন হলো কোন কল আসেনি। আমার খাওয়া ঘুম সব অফ। ফোন নিয়ে শুধু বসে আছি। পাঁচ দিন চলে গেল। কোন খবর নেই কোথাও থেকে। আমার অবস্থা দেখে জান্নাত শুধু কান্না করছে। বাবা-মা বোন শুধু আমাকে ভরসা দিয়ে যাচ্ছে। আজ এক সপ্তাহ চলে যাওয়ার পরও আমি কোন কল পাইনি। মানষিক ভাবে আমি এখন পাগল। চোখের জল গুলো শুকিয়ে দাগ হয়ে গিয়েছে। আমার ওয়ার্কাররা আমার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষায় আছেন। তারা এতো ভালো যে আমাকে একটা বকা দেয় নি। উল্টো আমাকে আশ্বাস দিচ্ছে। মহান আল্লাহর কাছে হাত তুলে শুধু সাহায্য চাচ্ছিলাম। জায়নামাজটা চোখের পানিতে ভিজে গিয়েছে। আর পারছিলাম না। ঠিক তখনই আল্লাহ আমাদের সবার ডাক শুনেন। একে একে কল আসতে শুরু করে। বিশাল বড়ো এমাউন্টের অর্ডার আসে। যারা এতদিন বসে আমাদের ক্লোথ কিনেছিল তাদের এত ভালো লেগেছে যে তাদের আত্নীয় স্বজনরা আবার তাদের আত্নীয় স্বজনরা এভাবে অনেকে এসে আমাদের ক্লোথ কিনতে চাচ্ছে। কিন্তু স্টোক শেষ। তাই মুহূর্তেই এত বড়ো অর্ডার চলে আসে। বিশ্বাস করুন জীবনে এত্তো খুশি হইনি তখন যা হয়েছি। আমাদের কাজ আবার শুরু হয়। একদম নতুন উদ্যমে। এবার শুধু লাভ আসছেই। আগে ছিল তিনটা শপিংমল এবার চার/পাঁচটা শপিংমল থেকে অর্ডার আসছে। শুধু তাই না সুদূর ঢাকা থেকেও অর্ডার আসলো। আমি অবাক হলাম ঢাকায় কিভাবে আমার ব্রান্ডের খবর গেল। পরে জানলাম কেউ একজন এখান থেকে আমাদের ক্লোথ কিনে ঢাকা নিয়ে গিয়েছিলেন। যাকে গিফট করেছিলেন তার আত্নীয় ছিল একজন বড়ো ব্যবসায়ী। তার নাকি আমাদের ক্লোথ কোয়ালিটি এবং ডিজাইন অনেক ভালো লাগে। তাই সে দ্রুত আমাদের খোঁজ লাগিয়ে আমাদেরকে অনেক বড়ো অর্ডার দেন৷ এবার পড়ি আরেক ঝামেলায়। সেটা হলো অর্ডার বেশি কিন্তু ওয়ার্কার কম। তাই আরও ৫০ জন ওয়ার্কার নিতে হয় আমাকে। সাথে আরো ৫০ টা মেশিন৷ যেটা বাবা আমাকে ভাড়া দিয়েছে। আমার এই সফলতার পিছনে সবার প্রথম আল্লাহ আর তারপর বাবার হাত। প্রথম কলটা পেলে মহান আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া আদায় করে সোজা বাবার কাছে চলে যাই। তাকে সুখবরটা জানিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদি। বাবা খুব খুশি হন। তারপর মা, বোন আর জান্নাত জানে। তারাও খুশিতে কাঁদে। সেদিনের পর থেকে মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আমার সফলতা আর কে আটকায়। আস্তে আস্তে সময় যেতে থাকে। আমার বিজনেস বড়ো হতে থাকে। আগে ভাড়া নেওয়া ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম এখন আমার নিজের ফ্যাক্টরি আছে। প্রচুর টাকা আসছিল। এদিকে আমি কিন্তু এখনো আমার ছাত্রীদের পড়ানো অফ করিনি। আমি ওদের বলেছি, আমি ওদেরকে বিবিএ শেষ না হওয়া পর্যন্তই পড়াবো। জান্নাত আর আমার সম্পর্কটা এখন এমন যে শুধু বিয়ে করার অপেক্ষায়। ওর বাবার কানে ইতিমধ্যে আমার নাম চলে গিয়েছে। ও বা ওর মা বলেনি। আসলে শহরে কোন নতুন ব্রান্ড এভাবে এত ফাস্ট নাম করতে শুরু করলে সবার কানেই তার খবর চলে যায়। শুধু রাজশাহী না ঢাকাতেও আমার ব্রান্ডের ক্লোথের প্রশংসা প্রচার হচ্ছিলো। আমার এখানে যারা কাজ করে তাদের ৫০ % শারীরিক ভাবে পার্ফেক্ট না। সেটা হওয়া স্বত্ত্বেও কিভাবে আমরা এত আগাচ্ছি তা অনেকের নজর কারছিল। যার জন্য অনেক গণমাধ্যম থেকে আমার সাথে কথা বলতে আসে। আমার ব্রান্ড নিয়ে নিউজও হয়৷ যার জন্য আমার নাম আরও জোরসে প্রচার হতে থাকে। বিশ্বাস হচ্ছিলো না কিছুই। এ যেন অবিশ্বাস্য কোন স্বপ্ন পূরণের গল্প। একটা অকেজো হাত নিয়ে এতদূর কিভাবে আমি আসলাম জানি না৷

এদিকে,

-- বাবা বাবা এটা দেখো। তাড়াতাড়ি নিউজটা পড়ো...

আমার আপন বাবা নিউজ পেপারটা নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। সেখানে আমার ছবি দিয়ে অনেক বড়ো করে লেখা, "আবির'স ফ্যাশন হাউস" সেখানে আমার ব্রান্ড সম্পর্কে অনেক কিছু লেখা। বাবা আমার নিউজ পড়ে স্তব্ধ হয়ে যান। তারা ভেবেছিলেন আমি সত্যিই মরে গিয়েছি। কিন্তু আমার সফলতা আজ তাদের দুয়ারে নাড়া দিয়েছে। বাবা আর ভাইয়া বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। কারণ সেখানে আমার নতুন বাবার সম্পর্কেও লেখা আছে। যে আমার বাবা এত বড়ো একজন ব্যবসায়ী হওয়া স্বত্ত্বেও আমি নিজ উদ্যোগে এত দূর এসেছি। এত নাম কামাচ্ছি। তারা দুজন পুরো সকড। আমার বিজনেস সেদিন সবে শুরু হয় এরপর দিনের পর সপ্তাহ, সপ্তাহের পর মাস আর মাসের পর বছর কেটে যায়৷ আমার কোম্পানি এবং ব্রান্ডের তিন বছর পাড় হয়। এই তিন বছরে অনেক বাঁধা বিপত্তি, লস মুনাফা ইত্যাদি পাড় করে এসেছি। ঢাকাসহ দেশের বড়ো বড়ো জায়গায় আমার ব্রান্ডের আউটলেট দিয়েছি। সবশেষে এবার ঢাকায় আমার নামেই নতুন শপিংমল উদ্ভাবন করতে আগামী কাল ঢাকায় যাচ্ছি আমরা সবাই। বাবা-মা, মরিয়ম, আমি এবং আমার স্ত্রী জান্নাত। হ্যাঁ এই দৌড়াদৌড়ির মাঝে আমি জান্নাতকে বিয়ে করে ফেলি। ওর বাবা মা খুশি খুশি মনে ওকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। অবশ্য তার আগে আমার পুরো জীবন কাহানী শুনেছেন তারা। আমার বাবা-মাই তাদের সব বলেছেন। জান্নাতের বাবাও একজন ব্যবসায়ী। তিনি জানেন কিভাবে এবং কতটা কষ্ট করে এতদূর আসতে হয়। আমার সমস্যা থাকা স্বত্ত্বেও আমি যে এতদূর এসেছি এটা ভেবেই তিনি অবাক। তাই আর দেরি না করে জান্নাতকে আমার হাতে দিয়ে দিলেন। যাই হোক কালকে বিশাল বড়ো আয়োজন করা হয়েছে আমার নতুন শপিংমল খোলার উপলক্ষে। সেখানে দেশের অনেক বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা আসবে৷ অনেক গণমাধ্যমের লোকেরাও আসবে আমার কথা শুনতে। ঢাকার মতো এই বিষাক্ত শহর থেকে একবার হেরে গিয়েছিলাম আজ প্রতিষ্ঠিত আবার ফিরেছি। তাও আমার নতুন পরিবার আর আমার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে। তাই আমার আপন পরিবারকেও এই অনুষ্ঠানে ডাক দিলাম। তারাও জানুন আমি কিভাবে এতদূর আসলাম।

পরদিন আছরের নামাজ শেষ করে আমার নতুন শপিংমল উদ্ভাবন করি। সবাই আমার অপেক্ষায় আছে। আমি আমার পরিবার নিয়ে সবার সামনেই বসে আছি। আমার চোখের সামনেই আমার আপন বাবা, বড়ো ভাই, ভাবী আর আমার ছোট বোনটা বসে আছে। তাদের সবার মুখ মলিন। মাঝ দিয়ে শুনেছি বাবার কোম্পানিটা বিশাল বড়ো লস করেছে একটা প্রজেক্টে। এরপর কোম্পানির অবস্থা নাকি দিন দিন খারাপই হচ্ছে। আসলে বড়ো ভাইয়া আমাকে দেখিয়ে হিসাব নিকাস করেই কোন প্রজেক্টে ইনভেস্ট করতেন। কিন্তু এবার আমি ছিলাম না। যার ফলে...থাক আর নাই বা বলি। যাই হোক সেই অপেক্ষার পালা এখন শেষ। কারণ এবার আমাকে ডাক দিয়েছে। আমি উঠে মাইকের কাছে গেলাম। আর বলতে শুরু করলাম,

-- আসসালামু আলাইকুম সবাইকে। প্রথমেই মহান আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করছি। আমি আজ এখানে আমার সফলতার গুণগান করতে আসিনি। আমি আজ আপনাদের একটা ছেলের গল্প শোনাবো। গল্পটার একটা নামও দিয়েছি আমি।
"আন্তঃনগরের ভালবাসা।"
তাহলে এবার গল্পটা শুরু করি। আশাকরি সবাই মন দিয়ে শুনবেন। গল্পের শুরুটা একটা মা হারা ছেলেকে নিয়ে। যার আবার একটা হাত প্যারালাইজড। বলতে গেলে একদম অকেজো। সেই অকেজো হাতটি নিয়ে ছেলেটা বড়ো হতে থাকে। আর সে সাথে এই বিষাক্ত সমাজের চোখে সে একটা হাসি, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, মজার এবং বোঝার বিষয় হয়ে যায়। তাকে প্রতি মুহূর্তে সবাই কষ্ট দিতে থাকে। তাকে এটা বোঝানো হয় যে সে একটা বোঝা। সে জীবনে কিছুই করতে পারবে না৷ তার মরে যাওয়া উচিৎ। এমত অবস্থায় ছেলেটার সবচেয়ে বড়ো ঢাল হওয়ার কথা ছিল তার আপন পরিবার। কিন্তু সেই আপন পরিবারও তাকে কোন দিন ভালবাসে নি, তার দিকে মায়া ভরা নয়নে তাকায় নি, সেই আপন পরিবারও তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে মৃত ঘোষণা করে বাসা থেকে বের করে দূরে সরিয়ে দেয়। ছেলেটার আর বেঁচে থাকার কোন ইচ্ছাই থাকে না৷ কিভাবে থাকবে? কি আছে তার বেঁচে থাকার জন্য? কিছুই নেই। ছেলেটা যখন দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই তাকে একজন বাঁচায়। সেই লোকটা তার কষ্টের জীবনের কথা বলে ছেলেটাকে নতুন একটা জীবন উপহার দেয়। ছেলেটা সেদিন মারা যায়নি। চলে যায় রাজশাহীতে। নতুন একটা শহর, নতুন একটা জায়গায়। না আছে কেউ পরিচিত, না আছে কেউ চেনা। কি করবে সে? কোথায় যাবে? কোন উত্তর ছিল না তার কাছে৷ সে শুধু মনে মনে আল্লাহকে ডাকছিল। তার বিশ্বাস ছিল ওই সৃষ্টিকর্তার উপর। আল্লাহ তায়ালা তার বিশ্বাসকে নষ্ট হতে দেয় নি। অলৌকিক কিনা জানি না কিন্তু একজন বাবার চোখ যায় সেই ছেলেটার উপর। সে কেন জানি নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। সে ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করেছিল, কি হয়েছে বাবা? তুমি এখানে একা কেন? ছেলেটার সব শুনে বাবাটা নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। তার আপন ছেলে বানিয়ে ছেলেটাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। নিঃস্ব ছেলেটাকে মহান আল্লাহ তায়ালা মুহূর্তেই একটা বাবা একটা মা আর একটা আদরের বোন দিয়ে দেন। সেদিন থেকেই ছেলেটার জীবনের চাকা আবার ঘুরতে থাকে। ছেলেটার নতুন বাবা অনেক ধনী হলেও সে চেয়েছিল নিজ উদ্যোগে কিছু করবে৷ কিন্তু তার এত পড়াশোনা ডিগ্রি দিয়েও সে একটা চাকরি পায়নি তার এই ডান হাতটা প্যারালাইজড বলে। আবারও সেই হাতের জন্য সে হেরে গেল। ঠিক তখনই ছেলেটার জীবনে একটা মেয়ের আগমন হয়। মেয়েটা ছেলেটাকে আবার সাহস দেয় সাথে সাপোর্টও। ছেলেটা মেয়েটার কথা মতো তার বান্ধবীদের পড়ানো শুরু করে। মাস শেষে মোটা অংকের টাকা চলে আসে তার পকেটে। চাকরি করতে গিয়ে যখন ছেলেটা জানে যে মেধার চেয়ে টাকার মূল্য বেশি তখন সে হেরে গিয়েও আবার সেই মেধাকেই কাজে লাগিয়ে সে অনেক টাকা জমাতে থাকে। ছেলেটার এই টাকা জমানোর মূল কারণ ছিল তার স্বপ্ন পূরণ। যে স্বপ্নের জন্য তার বেঁচে থাকা। এই স্বপ্ন সে আজ পূরণ করেছে। আর এই স্বপ্ন পূরণে তার সাথে ছিল, তার নতুন পরিবার, সেই মেয়েটা যে কিনা এখন তার স্ত্রী, আর তার কোম্পানিতে কাজ করা তার মতোই অসহায় মানুষরা এবং বাকি ওয়ার্কাররা। সবাই তার পাশে ছিল। যার জন্য তার এই বিশাল বড়ো স্বপ্নটা আজ সত্যি হয়েছে। আজ তার কাছে নিজের ব্রান্ড, বাড়ি, গাড়ি, টাকা সব আছে। বাবা-মা, বোনের ভালবাসা, তার স্ত্রীর ভালবাসা, তার ওয়ার্কারদের ভালবাসা। সে এই আন্তঃনগরে অনেক ভালবাসা খুঁজে পেয়েছে। সেই ছেলেটি আর কেউ নয়, সে আমি। আপনাদের আবির আহমেদ। আর এই হলো তার ভালবাসাগুলো। (পাশে থাকা পরিবার আর জান্নাতকে।দেখিয়ে) ধন্যবাদ সবাইকে। অসংখ্য ধন্যবাদ।

আমার আন্তঃনগরের ভালবাসার গল্প শুনে উপস্থিত সবার চোখ জলে ভেসে যায়। আর গল্পের শেষ হয় তাদের করতালি দিয়ে। আমি দেখেছি বাবা, বড়ো ভাইয়া, ভাবী আর বোনটাও কাঁদছিল। খুব ইচ্ছা হচ্ছিলো ওদের কাছে ছুটে যাই। কিন্তু যাইনি। আজ আমি প্রতিষ্ঠিত বলে তারা আমাকে তো চাইবেই। তাহলে আমার খারাপ সময় যারা আমার পাশে ছিল তাদের কি হবে? আমি কোন ভাবেই তাদের সাথে বেইমানি করতে পারবো না। আমি তাদের নিয়েই খুশি। তারাই আমার আপন পরিবার। আমার আআন্তঃনগরের ভালবাসা।

-- সমাপ্ত।

---> "সমাজ যাদেরকে ছুড়ে ফেলে দেয়, তারাও চাইলে জীবনে অসম্ভব কিছু করতে পারে।" - এই শিক্ষার আলোকেই এই গল্পটা লিখা। আশা করি প্রতিটি পর্ব জুড়েই আপনাদের কিছু না কি শিখাতে পেরেছি। এ গল্পে কোন রোমান্টিকতা নেই। জীবনের চরম বাস্তবতাকে কিছুটা কাল্পনিক আর বাস্তবিক সংমিশ্রণে মাখিয়ে আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি। আশা করি ভালো লেগেছে। যদি লেগে থাকে অবশ্যই গঠন মূলক একটা মন্তব্য করে জানাবেন। আর হ্যাঁ ভুল তো কিছু না কিছু হয়েছেই। সেগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। হয়তো আবার ফিরে আসবো কোন এক গোধূলি বিকেলে নতুন কোন গল্প নিয়ে।

Want your public figure to be the top-listed Public Figure in Narayanganj?
Click here to claim your Sponsored Listing.

Videos (show all)

Sorry শব্দটা কী আজব 😥😥

Category

Telephone

Website

Address


Narayanganj

Other Writers in Narayanganj (show all)
LOST STORY LOST STORY
Narayanganj, 1400

@loststory.97

Simanta Prodhan Simanta Prodhan
Shayesta Khan Road
Narayanganj, 1400

I am a very ordinary person. I like to write. If you don't have the patience to read my writing,

Jaan Chummma dibaa Jaan Chummma dibaa
Sanarpar
Narayanganj

গল্প পরতে ভালোবাসলে পেজটি ফলো করুন।🖤

Last Expect Last Expect
ঢাকা, বাংলাদেশ
Narayanganj

Love Is Not Mean For Everyone

Emotion Emotion
Narayanganj

সব কিছুরই দাম বাড়ে শুধু তোমার কাছে আমার দাম ছাড়া!�

هذه هي النفسHadhih-hi-alnafs هذه هي النفسHadhih-hi-alnafs
Narayanganj

هذه هي النفس hadhih hi alnafs Purification of the soul আত্মার পরিশ?

Tarana Afrin Tarana Afrin
Narayanganj

Biplob Hossain munna Biplob Hossain munna
Dhaka Highway
Narayanganj

নিজেকে কবরে রেখে দুনিয়াকে কল্পনা করো

𝑒𝑚𝑜𝑡𝑖𝑜𝑛シ︎ -আবেগ 𝑒𝑚𝑜𝑡𝑖𝑜𝑛シ︎ -আবেগ
Narayanganj

ছোট লেখায় হাজারো অনুভূতি।।

Nasima Akter Nasima Akter
Narayanganj

Life is a beautiful place, here we live to over come, when we lose something that time we earn learn

CreativeGlimmer by tasmiya CreativeGlimmer by tasmiya
Narayanganj
Narayanganj

Stay with me everyone by likeing my page.💖

Md Siam Md Siam
তুমি
Narayanganj, HHDDCF

❤️❤️❤️❤️❤️